শাকিলা আলম:
ধর্মব্যবসা মানুষকে সুবিধা গ্রহণ করতে শেখায়, কিন্তু আল্লাহ চান মানুষ আত্মত্যাগ করুন, অপরকে দিয়ে পরিশুদ্ধি অর্জন করুক। জান্নাতের জন্য ত্যাগস্বীকার করতে হয়। আল্লাহ কোর’আনে মুসলমান জাতির জীবন পরিচালনার দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। এই জীবনব্যবস্থার অন্যতম নীতি হলো দান যার মাধ্যমে সমাজ থেকে অর্থনৈতিক অবিচার, বৈষম্য বিদূরীত হয়ে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সম্পদ কোথাও পুঞ্জীভ‚ত হবে না। ফলে সমাজের প্রত্যেকের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত হবে। সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন ও সম্পদ উভয়ই সমানভাগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর যেহেতু উম্মতে মোহাম্মদীর জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা তাই, মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যেই আল্লাহ সম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে সংগ্রাম করাকে অঙ্গীভ‚ত করে দিয়েছেন (সুরা হুজরাত ১৫)। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ উৎসর্গ করা কেবল ইসলামের একটি আমল নয়, এটি মো’মেন হওয়ার অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, একত্ব অর্থাৎ তওহীদের পরে পবিত্র কোর’আনে সম্পদ দান করার নির্দেশই সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হয়েছে। পবিত্র কোর’আনে অন্তত ২২টি খাতে সম্পদ দান করার নির্দেশ পাওয়া যায়।
জান্নাত কান্নাকাটি করে দোয়া করে পাওয়ার বিষয় নয়। এটি একটি লেনদেনের বিষয়। মো’মেন নিজের জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে, বিনিময়ে আল্লাহ তাকে জান্নাত দেবেন। সে যদি স্বার্থপরের জীবনযাপন করে, আল্লাহর রাস্তায় জীবন-সম্পদ ব্যয় না করে তাহলে তাকে আল্লাহ জান্নাত দিবেন না। আল্লাহ অন্তত দুটো আয়াতে এই সাফ কথাটি জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“হে মো’মেনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে? তা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবনপণ করে জেহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম; যদি তোমরা বোঝ। তিনি তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন এবং এমন জান্নাতে দাখিল করবেন, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত এবং বসবাসের জান্নাতে উত্তম বাসগৃহে। এটা মহাসাফল্য। (সুরা সফ ৬১:১২ )
অন্যত্র তিনি আরো সুস্পষ্টভাবে এই কেনাবেচার কথাটি উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মো’মেনদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা সংগ্রাম করে আল্লাহর রাস্তায় পথে …. সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের উপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হল মহান সাফল্য। (সুরা তাওবা ৯:১১১ )
এ বিষয়ে আল্লাহর চূড়ান্ত ঘোষণ হচ্ছে, “কস্মিনকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না করো।” (সুরা আল ইমরান: ৯২)
সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে গ্রহণ করার মধ্যে জান্নাত নেই, স্বার্থপরের জন্য জান্নাত নেই, জান্নাত হচ্ছে দেওয়ার মধ্যে। মানুষ যখন অন্যকে দিতে শেখে তখন সে নিজে পরিশুদ্ধ হয়, তার জাতি সমৃদ্ধ হয়। আর যদি সবাই নিতে চেষ্টা করে তাহলে সকলেই আত্মকেন্দ্রিক হবে, স্বার্থপর হবে। আজকে এটাই হয়েছে। তখন বিপুল সম্পদ থাকলেও তাতে টান পড়বে। সম্পদ এক জায়গায় পুঞ্জিভ‚ত হয়ে যাবে। স্বভাবতই ইসলামর কোন কাজ করার ক্ষেত্রেই বিনিময় লেনদেনের কোনো সুযোগ নাই। যারা ইসলামের কাজের বিনিময় নেবে তার জন্য কোন জান্নাত নাই। আজকের পৃথিবীটা স্বার্থকেন্দ্রিক। ধর্মের অঙ্গনটি এককালে নিঃস্বার্থ ছিল। মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধর্মপ্রচার করত, দীনের কাজ করত। এখন যারা ধর্মের ধারকবাহক তারা টাকা ছাড়া একটি কাজও করেন না। নামাজ পড়াবেন – তাতেও টাকা, অন্যের জন্য দোয়া করবেন – তাতেও টাকা, সমাজের কেউ মারা গেছেন, জানাজা পড়াবেন, দাফন করবেন – তাতেও টাকা। ধর্মব্যবসা চিত্র এখন নির্লজ্জতা, বেহায়াপনার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। যারা তাদেরকে দিচ্ছেন তারা সওয়াব মনে করে দিচ্ছেন, যারা খাচ্ছেন তারা অধিকার মনে করে খাচ্ছেন। বহু জায়গায় এই লেনদেন নিয়ে মারামারি পর্যন্ত হওয়ার খবর আছে।
আজকের বৈশ্বিক ভয়াবহ সংকটে মুসলিম দাবিদার জনগোষ্ঠীটি নিপতিত। এ থেকে উদ্ধার পেতে হলে ধর্মব্যবসার বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে হবে। এছাড়া ধর্মের অনাবিল রূপ, প্রকৃত রূপ মানুষ কোনোদিন দেখতে পাবে না। ধর্মব্যবসায়ীরা সেটা প্রকাশিত হতেই দেবে না।