সুলতানা রাজিয়া কণিকা
গত শতকের প্রথম দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯) চল্লিশ এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) সংঘটিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯২০ সালে ১০ জানুয়ারি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘লীগ অব নেশনস’ বা জাতিপুঞ্জ সৃষ্টি হয়েছিল। জাতিপুঞ্জ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী জাতিসমূহের প্রতিষ্ঠান, বিজিত দেশগুলির নয়। বিজয়ী দেশগুলি বিজিত দেশগুলির ওপর নিজেদের ইচ্ছামতো কতকগুলি অন্যায় সন্ধির শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল, যেগুলি তখনকার মতো তারা মেনে নেয়। কিন্তু এজন্য প্রথম থেকেই তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল। পরে সুযোগ মতো তারা প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর হয়। এজন্য বলা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সন্ধির শর্তাবলির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে এবং ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী একনায়কতন্ত্রের উত্থান হয়, যার ফলশ্র“তিতে বিশ্ববাসী আরও একটি ভয়াবহ ও নৃশংস বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হয়। দুইটি বিশ্বযুদ্ধে ১১ কোটি মানুষ নিহত হয়। অসংখ্য মানুষ আহত, গৃহহারা হয় এবং পঙ্গুত্ববরণ করে। প্রতিটি দেশ হারায় তার কর্মক্ষম যুব সম্প্রদায়কে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ব বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তৎকালীন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য আরো একটি নতুন আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করতে উপলব্ধি করেন। কিন্তু এটি ছিল মূলত উত্তর ঔপনিবেশিক যুগের বিশ্বকে শাসন ও শোষণ করার নতুন কৌশল মাত্র। এরই প্রেক্ষাপটে চৌদ্দটি মিত্রশক্তি শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্য লন্ডনে এক সমাবেশে মিলিত হয়। এর কিছু দিনের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষর করেন। তার পর ১৯৪৩ সালে তেহরানে ও মস্কোতে চারটি প্রধান শক্তির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের প্রতিনিধিবর্গ সম্মিলিত জাতিসংঘ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সিদ্ধান্ত অনুসারে ওয়াশিংটনে ১৯৪৪ সালে চারটি মিত্রশক্তির বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সান ফ্রান্সিসকোতে ৫০টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গ দীর্ঘ দুই মাস আলোচনার পর খসড়া দলিল অনুমোদন করেন যা ইউ.এন.ও চার্টার নামে খ্যাত। অবশেষে ১৯৪৫ সালে ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ আত্মপ্রকাশ করে আর ১৯৪৬ সালে ২০ এপ্রিল লীগ অব নেশন আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষিত হয় যদিও তার ১০ বছর আগেই কার্যকারিতা হারায়।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পরপরই সংগঠনটিকে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে উত্থান হওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উন্নয়নশীল ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে দুটি দেশই নিজ নিজ বলয়ে টানা শুরু করে। ষাটের দশকে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন দেশের আবির্ভাব ঘটে, পরিচিতি পায় ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামে। জাতিসংঘের আসল কাজ শান্তিরক্ষা হলেও মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের পক্ষে সর্বত্র তা কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। তাই সত্তরের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের তেল অস্ত্র ব্যবহার ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে জাতিসংঘের কার্যত কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে ১৯৮১ সালে আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে ব্রিটেন ও আর্জেন্টিনার যে বিরোধ হয়, তার শান্তিপূর্ণ সমাধানে উদ্যোগ নিয়ে সফল হন সংস্থাটির তৎকালীন মহাসচিব হেভিয়ার পেরেজ দ্য ক্যুইলার। আশির দশকে যেসব সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘ আপাতদৃষ্টিতে সফল হয় সেগুলো হল- নামিবিয়া সমস্যা, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা অপসারণ, কম্বোডিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলে বিশ্ব হয়ে ওঠে একমেরুকেন্দ্রিক। তখন থেকে জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে চলেছে যা জাতিসংঘের ব্যর্থতার পরিচায়ক। মাত্র ১০টি উদাহরণ দিচ্ছি।
১. দশ-এগারো বছর স্থায়ী সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধ মূলত পরিচালনা করে ব্রিটিশ মেরিন, যুগোস্লাভিয়ায় ৭৮ দিন বিরামহীন বোমাবৃষ্টি ও বিখণ্ডায়ন প্রক্রিয়া সম্পাদন হয় জাতিসংঘের অনুমোদন ব্যতিরেকে; কিন্তু ন্যাটোর তত্ত্বাবধানে।
২. আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতিসংঘের ব্যর্থতা ষ্পষ্ট। পাকবাহিনীর বর্বর হামলা, নারী ও শিশু নির্যাতন ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নামে নির্বিচারে গণহত্যা কোনটির জাতিসংঘ নিন্দা করেনি। বরং গণহত্যাকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নীরবভাবে সমর্থন করেছিল।
৩. বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও যুদ্ধের মারাত্মক উপকরণ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা আজও বন্ধ হয় নি। ইন্দোচীন সমস্যা, বসনিয়ার সার্ববাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন, কাশ্মীর সমস্যা, আফগানিস্তানের তালেবান সমস্যা, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা, সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি আজও বিশ্বকে আতঙ্কিত করে রেখেছে।
৪. বৃহৎশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটকৌশলের কারণে ইসারাইল কর্তৃক গোলান মালভূমি, গাজা ও পশ্চিমতীর দখল এবং মধ্যপ্রাচ্যের হানাহানি বন্ধ হয় নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাড়াবাড়ি ও ষড়যন্ত্রের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহৎ শক্তিবর্গের নীরব ভূমিকার কারণে ফিলিস্তিনি জনগণ কামান ও বোমারু বিমানের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত অথচ জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে।
৫. ২০০১ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ ও যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়টি ন্যাটোর তত্ত্বাবধানে থাকে। ২০০৩ সালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ইরাক হামলায়ও জাতিসংঘের অনুমোদন ছিল না। ন্যাটো সেনারা ইরাকে সরকার পতন নিশ্চিত করতে অগণিত লোক হত্যা করে।
৬. লিবিয়ার ঘটনাও অনুরূপ। একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার কর্ণধার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো লিবিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক গাদ্দাফির পতন ঘটিয়ে নিজেদের অনুগত শাসক বসায়।
৭. শুধু লিবিয়া নয়, গোটা আরব বিশ্বে একবিংশ শতাব্দীতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আর এ ‘আরব বসন্ত’র ক্রীড়নক ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। এসব বিষয়ে জাতিসংঘ অসহায় দর্শকের ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘ এসব দেশে শান্তি স্থাপনে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি মূলত বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও কোথাও সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং কোথাও কোথাও অনাগ্রহের কারণে। ফলে এ সময়টাতে জাতিসংঘের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
৮. সিরিয়া ইস্যুতে জাতিসংঘ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সাড়ে ৪ বছর স্থায়ী সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি সিরীয় প্রাণ হারিয়েছে। ১ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এতে বিশ্ব মুখোমুখি হয়েছে অবৈধ অভিবাসনের নয়া সংকটের।
৯. ১৯৪৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ ১ হাজার ৯০০টি প্রস্তাবনা এনেছে। এর কোনোটি পাস হয়েছে, কোনোটি কার্যকর হয়েছে। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় এগুলো পাস করায় জাতিসংঘকে একাধিকবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও দেয়া হয়েছে। ১৯৯৪ সালে রেজুলেশন-১২৬৭ ও ১৩৩৩ পাস হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল রুয়ান্ডার জাতিগত সংঘাত নিষ্পত্তি। রুয়ান্ডায় ১০০ দিনে ১০ লাখ টুটসিকে হত্যা করে হুথিরা, জাতিসংঘ তা থামাতে পারে নি।
১০. সর্বপ্রথম বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছিল, সেটি রেজ্যুলেশন ১৮১ নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ওই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের ভূমি ট্রান্স জর্ডান দখলদারিত্বের মাধ্যমে ইসরাইল নামের ‘জায়নবাদী’ রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়। পরিণামে এ অঞ্চলের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে ১৯৪৯, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ৪টি আরব-ইসরাইল যুদ্ধ।
বিগত বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে জাতিসংঘ যেসব রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে সুস্পষ্ট হয় যে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পঞ্চশক্তির অস্তিত্ব কাগজে কলমে থাকলেও এ আন্তর্জাতিক সংগঠনটি আদতে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২০০৯ সনের অধিবেশনে ভাষণ দান কালে বলেন, “সনদে বলা হয়েছে ছোট হোক কিংবা বড় হোক সকল দেশ সমান। যে উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে জাতিসংঘ সৃষ্টি হয়ে ছিল আজ সেই জাতিসংঘ তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।” তিনি দৃঢ়চিত্তে ভেটো দেয়ার ক্ষমতাকে বিলুপ্ত করার জোর দাবি জানিয়ে বলেন, “নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো প্রদানকারীরা কেবল সন্ত্রাস জন্ম ও অবরোধ আরোপ ব্যাতিত বিশ্বকে কোন নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে নাই”। গাদ্দাফি তার ১০ মিনিটের বক্তৃতার মধ্যবর্তী সময়ে এসে উত্তেজিত হয়ে সনদ বইটির পাতার কিছু অংশ ছিড়ে ফেলেন এবং বারবার বইটি নিচে ফেলে দেন। অতঃপর বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে এসে বইটি তার পেছন দিক লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারেন।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিমাদের স্বার্থরক্ষাকারী সমিতি হিসাবে। কারণ কোনো দেশ এককভাবে মোড়লিপনা করলে সেটা স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো মেনে নিতে আপত্তি করবে, তাই কৌশলে সবাইকে সদস্য করে একটি বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল জাতিসংঘের সৃষ্টির লক্ষ্য। নিয়ইয়র্কের বিখ্যাত ইহুদী আইন ব্যবসায়ী হেনরী ক্লায়েন তার বই Zions rule the world New York, 1948, এর এক জায়গায় লিখেছেন- “জাতিসংঘ ইহুদীবাদের নামান্তর মাত্র। ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে জারিকৃত বিজ্ঞ ইহুদীবাদী মুরুব্বীদের প্রোটকল পুস্তকে যে সুপার গভর্নমেন্টের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে এটা তাই।”
তবে সরকার চালাতে দান-দক্ষিণাও করতে হয় তাই ইউনিসেফ, ইউনেস্কো ইত্যাদি এনজিও ধাঁচের সেবামূলক সংস্থা তারা পরিচালিত করেছে কিন্তু মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। নিরাপত্তা পরিষদের জায়গাটি এখন কার্যত দখল করে নিয়েছে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো। ন্যাটোর প্রবল প্রতাপের সামনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ম্রিয়মান হতে হতে এখন অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের প্রতিক্ষায় আছে। জাতিপুঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয় তার জন্মের ২৬ তম বর্ষে আর জাতিসংঘ পার করেছে ৭০ বছর। তার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি এখনও হয় নি।