উত্তর দিয়েছেন- মো. মশিউর রহমান:
আমাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগগুলো করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমরা সনাতন ধর্মের অবতার মনু, শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির – এঁদেরকে নবী হিসেবে দাবি করি কেন? আমাদের এমামুয্যামান তাঁদের নামের শেষে সম্মানসূচক (আ.) ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে নাকি তিনি ইসলামের অবমাননা করেছেন, ইসলামকে অবজ্ঞা করেছেন। এমনকি এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই ১৯৯৫ সালে এমামুয্যামানের নামে একটি মামলাও করা হয়েছিল।
আমাদের মাননীয় এমামুয্যামান সম্পর্কে আপনাদের ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরী। আমাদের এমামুয্যামান ছিলেন একজন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। তিনি এছাড়াও একজন লেখক, দার্শনিক ও গবেষক ছিলেন। এর পাশাপশি তিনি ছিলেন বিখ্যাত রাইফেল শুটার ও একজন দুর্ধর্ষ শিকারী। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল অসখ্য বই এবং সেগুলো তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার (ঠবৎংধঃরষব এবহরঁং) অধিকারী। একজন গবেষক হিসেবে তিনি বহু বিষয় নিয়েই গবেষণা করেছেন। এটিও তাঁর একটি গবেষণালব্ধ জ্ঞান। শুধু তিনিই নন অনেক বড় বড় লেখক, সাহিত্যিক, চিন্তাশীল মানুষ একই মতামত দিয়েছেন। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দ্যা ক্রিড অভ ইসলাম বইয়ের লেখক, পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পদক আবুল হাশেমও একই মতামত দিয়েছেন। তাদের মতেও সনাতন ধর্মের অবতারগণ আল্লাহর প্রেরিত নবী হতে পারেন। আমাদের এমামুয্যামান ও যে সকল গবেষক এই মতমত দিয়েছেন তাদের এই মতামতের একটি ভিত্তি তো অবশ্যই রয়েছে, তাদের এই মতামতের ভিত্তি কী?
পবিত্র কোর’আনের বেশ কিছু আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আমি প্রত্যেক জনপদের জন্য তাদের নিজেদের ভাষায় পথপ্রদর্শক প্রেরণ করেছি (সুরা রাদ ৭, সুরা ইউনুস ৪৭)।” অতএব এ কথা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে দুনিয়ায় এমন কোন জনপদ নেই যেখানে আল্লাহ নবী বা পথপ্রদর্শক প্রেরণ করেন নি। আমাদের এই উপমহাদেশে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই জনগণ বসতি স্থাপন করে বসবাস করছে। সত্য যুগ, ক্রেতা যুগ পার হয়ে বর্তমানে কলি যুগে এসে পৌঁছেছে। এই এত বড় সভ্যতা এখানে রয়েছে অথচ এখানে কোন নবী আসেন নি, একথা কোর’আনের আয়াতের সাথে মিলে না। অতএব এ কথা স্পষ্টত যে এই উপমহাদেশেও নবী এসেছেন। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে মাত্র ২৫-২৭ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তাহলে এ উপমহাদেশে যারা এসেছেন তাঁরা কারা?
আমরা জানি যে কালপরিক্রমায় অনেক নবী-রসুলের নাম বিকৃত হয়ে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে আল্লাহর নবী ও রসুল ঈসা (আ.) এর কথা। তাঁর উপর মহান আল্লাহ ইঞ্জিল শরীফ নাযিল করেন। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের একটি বড় অংশ তাঁকে যীশু খ্রিষ্ট নামে সম্বোধন করে। তাঁর মায়ের নাম যেখানে মরিয়ম সেখানে মারিয়া বা মেরি ও ইঞ্জিল শরীফকে বাইবেল নামে সম্বোধন করা হয়। এছাড়াও খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন যে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। আবার ইহুদিরা তাঁর মায়ের সম্পর্কে নোংরা দোষারোপ করে। এরকম শত শত বছর ধরে হওয়া অপপ্রচারের ফলে সত্য ঢাকা পড়ে যায়। যদি এই ভারতবর্ষের কথা চিন্তা করি তবে বিবেচনা করতে হবে মহাভারতের কথা, মনুসংহিতার কথা। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের সাথে নিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধর্মকে পুনঃস্থাপন করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আরেক মহানায়ক যুধিষ্ঠিরও মহামানব ছিলেন। এই যুধিষ্ঠিরের সাথে ইদ্রিস (আ.) এর নামের এবং জীবনের ঘটনাবলীর সাদৃশ্য রয়েছে। হাদিসের থেকে আমরা পাই যে ইদ্রিস (আ.) জীবিত অবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করেছেন, তেমনি যুধিষ্ঠির জীবিত অবস্থায় স্বর্গে প্রবেশ করেছেন। মনুসংহিতায় মনু, যেখান থেকে মানুষের উৎপত্তি, তিনি হচ্ছেন নুহ (আ.)। ইঞ্জিলে, কোর’আনে, হাদিসে যেমন মহাপ্লাবনের ঘটনার উল্লেখ রয়েছে ঠিক একইরূপ ঘটনা মনু সংহিতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে প্রতিটি বিষয়ই আমাদের বেশ কিছু নবী-রসুলদের জীবনীর সাথে মিলে যাচ্ছে। এই মিল দেখার পর এই মনুই যে আমাদের নুহ (আ.) সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না।
আমাদের এমামুয্যামান বলেছেন এই জ্ঞান তার গবেষণা লব্ধ ফসল। তিনি সনাতন ধর্মের এসকল অবতারদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য, অশ্লীল কথা বলতে নিষেধ করেছেন। কালের বিবর্তনে ঐতিহাসিক বিবরণ পাল্টে পৌরাণিক রূপ ধারণ করেছে, সেসব কাহিনীতে বহু অশ্লীলতা পর্যন্ত প্রবিষ্ট হয়ে গেছে। তাঁদের রেখে যাওয়া শিক্ষাগুলোও মানুষের মুখে মুখে যুগের পর যুগ প্রবাহিত হয়েছে, শত সহ¯্র বছর পরে গিয়ে সেগুলো গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এ সময়কালে তাঁদের আনীত সত্যের সঙ্গে বহু মিথ্যার মিশ্রণ ঘটে গেছে। এখন মিথ্যা কিছু মিশ্রিত হয়েছে বলে সেই গ্রন্থগুলো যে পুরোটাই মিথ্যা, বা এগুলো ¯্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত নয় এমন কথা বলা যায় না। আমরা সেই ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মহামানবগণ সম্পর্কে বাজে ধারণা পোষণ করতে পারি না, বিদ্বেষ ও ঘৃণা বিস্তার করতে পারি না। আমরা তাদের নবী হিসেবে মেনে না নিলেও তাদের গালি-গালাজ করার অধিকার আল্লাহ দেন নি। আল্লাহ মো’মেনদের যে সাতটি বিষয়ে ঈমান আনতে বলেছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সকল নবী রসুলদের প্রতি কান মন্তব্য করতে পারি না কারণ আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, “তোমরা তাদের উপাস্যদের গালিগালাজ কর না তাহলে তারাও ঈমান আনা ও আল্লাহ প্রেরিত সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনা। তাই মো’মেন হওয়ার জন্য আমাদের এই দুটি বিষয়ের ঈমান আনতেই হবে। সকল কিতাবের নাম কি আমরা জানি? জানি না। আমাদের তাহলে বিশ্বাস করতে হবে আল্লাহর পক্ষ থেকেই সকল জনপদের জন্য নবী রসুল ও কিতাব এসেছে। গবেষকরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে সনাতন ধর্মের এই মহামানবদের নবী বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এ বিষয়টি বলার জন্য আমরা হিন্দু হয়ে যাই নি। ইসলাম এতটা সংকীর্ণ নয়। ইসলামের প্রকৃত অনুসারী হতে হলে আমাদের এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জ্ঞানী যারা রয়েছেন তারা চিন্তাভাবনা করে এরপর এই ব্যাপারে মন্তব্য করবেন।
এটি আমাদের প্রচারণার বিষয়বস্তু নয়। অপর কাউকে এ বিষয় মানতেই হবে এমন কোনো জোরও আমরা করি না। সনাতন ধর্মের অনুসারীদের সাথে যখন আমরা কথা বলতে যাই তখন আমরা বলি যে তাদের এই ধর্মের সনাতন শব্দটির অর্থ হল চিরন্তন, শাশ্বত, চিরসত্য। ইসলামেরও একটি নাম দীনুল কাইয়্যেমা যার অর্থ সনাতন, শ্বাশ্বত জীবনবিধান। আমরা তাদের এক আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানি না এ কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই। নুহ (আ.) যেহেতু আল্লাহর নবী সেহেতু দ্বিতীয় আদমের সূত্র ধরে তারা আমাদের ভাই। সনাতন ধর্মেও আদম (আ.) ও মা হাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। সেখানে মা হাওয়াকে হব্যবতী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। তাদের গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়ে বিবিধ বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে ঐক্যের কথা আছে, মানবতার কথা আছে। তাদেরকে আমরা আহ্বান করি যেন তারা আল্লাহর রসুলকে অবমাননা না করে, কোর’আনের অবমাননা না করে। আমরাও তাদের কেতাবকে অবমাননা করতে পারি না। আমরা সবাই এক বাবা মা এর সন্তান সেই সূত্রে পরষ্পরের ভাই। তাই আমাদের এখন সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। যদি আমরা ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি তবে আমাদের মধ্যকার সকল সমস্যা দুর হয়ে যাবে। আমরা একজন আরেকজনকে বোমা মারবো না, একজন আরেকজনের অনিষ্ট করা থেকে বিরত থাকব।
আজ আমরা যে অবস্থায় রয়েছি সে অবস্থার জন্য ইবলিস দায়ী। বর্তমানে যে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ সমস্যার কথা শুনা যায়, যা শুধু মুসলমানরা করে বলে প্রচলিত, তা সকল ধর্মেই দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমারে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের হামলায় কতলোক মারা যাচ্ছে। ভারতে হিন্দু সন্ত্রাসীদের হামলায় মারা যাচ্ছে হাজার হাজার আদম সন্তান। ইউরোপে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীদের হামলায় মরছে শত শত। আর মুসলমানদের মধ্যেও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী তো রয়েছেই। এক ধর্মের লোকের অন্য ধর্মের লোকদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা না থাকার ফলে তারা এ কাজ করছে। একজন আরেকজনের নবীকে গালি দিচ্ছে, গ্রন্থকে অবমাননা করছে।
আমারা হেযবুত তওহীদ তাই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সকলের সামনে তুলে ধরছি। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের ফলে প্রতিটি মানুষের মধ্যে সঠিক মুল্যবোধ সৃষ্টি হবে। তখন আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রেষারেষী থাকবে না এবং আমরা অন্য ধর্মের প্রতি অবমাননাও করা থেকে বিরত থাকব। পরিশেষে আমি বলবো সনাতন ধর্মের অবতারদের নবী মানা না মানা পুরোটাই ব্যক্তিগত বিষয়, গবেষণা লব্ধ ফল। অতএব এটাকে কেউ বিশ্বাস করতেও পারে নাও করতে পারে সেটা যার যার ইচ্ছা। কিন্তু মো’মেনদের সকল নবীদের উপর ঈমান আনা সবসময়ই বাধ্যতামূলক।