রিয়াদুল হাসান:
সাফল্যের সঙ্গে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দিল পশ্চিমা বিশ্ব
পূর্ব প্রকাশের পর: সুতরাং আফগান যুদ্ধ থেকেই জঙ্গিবাদের শুরু। এই যে আফগানফেরতা যোদ্ধারা যার যার দেশে ফিরে গেলেন, সেখানে গিয়ে তারাও ছোট ছোট দল গঠন করতে লাগলেন অথবা পূর্বে থাকা কোনো ইসলামী দলে যোগ দিয়ে তার গতিপথকে প্রভাবিত করতে লাগলেন। বিশ্বের যতদেশে মুসলমান আছে মোটামুটি সবদেশেই এমন দলের সৃষ্টি হলো। উইকিপিডিয়ার একটি অসম্পূর্ণ তালিকায় বর্তমানে সক্রিয় সশস্ত্র ইসলামী দলের নাম পাওয়া যায় ১০৪টি। তাদের উদ্দেশ্য প্রধানত ভৌগোলিক স্বাধীনতা হলেও ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রেরণাই তাদেরকে শক্তি যুগিয়েছে। আফগান জেহাদের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের একটি বড় উদাহরণ চেচনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলিম আন্দোলন। প্রথম ও দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় প্রায় তিন লক্ষ চেচেন মুসলমান।
আরেক ট্রাজেডি অনুষ্ঠিত হয় চীনের উইগুড়ে। আফগান জেহাদের সূচনালগ্ন থেকেই চীন তার নিজস্ব ভূকৌশলগত কারণে আফগান সংলগ্ন সিনজিয়াং প্রদেশের মুসলমান প্রধান উইগুড় অঞ্চল এবং পাকিস্তানের আরো উত্তরোস্থিত রাশিয়ান কিরগিজ মুসলমানদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে আরম্ভ করে। এই প্রশিক্ষণ এবং জেহাদীদের অস্ত্রায়নসহ যাবতীয় বিষয়ে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পূর্ণ খরচ CIA বহন করে। এ সময়ে চীন প্রায় ৫০,০০০ মোজাহেদদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। এই প্রশিক্ষণার্থী মুসলমানের সন্তানেরা একবারও ভাবল না যে, কম্যুনিস্ট দানব সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে এসেছে আরেক কমুনিস্ট দানব চীন, এখানে তারা কেন জীবন দেবে? যদি সোভিয়েত হারেও জয়ী হবে আমেরিকা-চীন, মুসলমানদের কি লাভ? কিন্তু এসব ভাবার অবসর তাদের হয় নি, এটাই ইতিহাস। CIA-র কাছে আত্মবিক্রিত আলেমদের হৃদয় কাঁপানো উদ্দীপক ওয়াজে তারা জেহাদের জন্য এতটাই উদ্বুদ্ধ যে তাদের এই সাধারণ জ্ঞানও লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল যে তাদের যুদ্ধ আল্লাহর রাস্তায় হচ্ছে না, উল্টো তারা এবং ইসলাম উভয়েই পরিণত হয়েছে দুই দানবের যুদ্ধের হাতিয়ারে। এই দানবেরা চায় না এ যুদ্ধে নিজেদের লোকক্ষয় হোক, এজন্যই মূল্যহীন মুসলমানদেরকে এত প্রশিক্ষণ দেয়ার ঘনঘটা। মুসলমানদেরকে দিয়ে যুদ্ধ করাতে প্রয়োজন তাদের ধর্ম ইসলামের। তাই যখন যুদ্ধ শেষ হবে, তখন ইসলাম ও মুসলমান ধ্বংস হলেও তাদের কিছু এসে যায় না, বরং ধ্বংস হওয়াই বুদ্ধিমান শত্র“র কাম্য হওয়া স্বাভাবিক।
নিষ্ঠুর পরিহাস হচ্ছে, সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তান ত্যাগের পর সেই চীনারা এখন ঠিকই যুদ্ধ করছে। তবে সেটা করছে সেই উইগুড় মুসলমান জেহাদীদের বিরুদ্ধেই, যাদেরকে তারা নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি বানিয়েছে। এজন্য তারা একটি অজুহাত দাঁড় করিয়েছে যে উইগুড় মুসলমানদের এ বিচ্ছিন্নতাবাদ আন্দোলনে তালেবানরা সহযোগিতা করছে। এ অভিযোগ তুলে ২০০১ সনে আবার চীন আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী জোটের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে যারা উভয়েই কিছুদিন আগে ছিল মুসলমানদের ‘পরম বন্ধু’।
১৯৮৫ সনের মাঝামাঝি ওসামা বিন লাদেনের সান্নিধ্যে আফগান জেহাদে সামিল হবার জন্য CIA-এর হিসাব অনুযায়ী আরব-মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যথা সৌদি, ইয়ামেন, আলজেরিয়া, মিশর, তিউনেশিয়া, ইরাক, লিবিয়া, জর্ডান থেকেই এসেছিল ১৫,০০০ জেহাদী। পরে এ সংখ্যা বেড়ে ৩০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। আফগান যুদ্ধের শেষে এদের মধ্যে এক থেকে দেড় হাজারের মতো আলজেরিয়ার সরকারবিরোধী ইসলামী কট্টরপন্থী বলে কথিতদের সাথে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রণের জন্য আলজেরিয়ায় চলে আসে। স্মরণ থাকে যে, আলজেরিয়ার ব্যাপক সন্ত্রাসের মধ্যেই ১৯৯২ সনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট (FIS) প্রথম পর্যায়ের ভোটে ১৮৯ আসন দখল করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকে এগুচ্ছিল, কিন্তু সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষমনা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট সরকার এবং সেনাবাহিনী এ ফলাফল বাতিল করলে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী পশ্চিমা পরাশক্তিগুলি সেদিন গণতন্ত্র বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। কারণ সালভেশন ফ্রন্ট একটি ইসলামী আন্দোলন। ১৯৯২-৯৮ পর্যন্ত চলমান এ গৃহযুদ্ধে প্রায় ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) লোকের প্রাণহানী হয়। আলজেরিয়ার এ যুদ্ধ এখনো চলছে আর ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট- এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে আর্মড ইসলামিক গ্র“প CIA।
আফগান ফেরত যোদ্ধারা মিশরে ফিরে আল-জেহাদ এবং আল জামিরার মত সংগঠনগুলোতে যোগ দেয়। এর মধ্যে প্রায় ২০০ আরব-আমেরিকান স্পেশাল ফোর্স দ্বারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত আফগান জেহাদ ফেরত সদস্যরা নিউ ইউর্কের নিউজার্সি এরিয়াতে ফিরে আসে। ক্রমেই আল-কায়েদা আর তালেবান একই সূত্রে সমগ্র মধ্য এশিয়ায় জেহাদের প্রতিকরূপে গড়ে ওঠে। এদের যোদ্ধারা আজারবাইজান থেকে শুরু করে চেচনিয়া, নগরনো-কারাবাগ, কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান, দাগেস্তান এবং উইগুড়সহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আফগান মোজাহেদরাও কোনো না কোনো পর্যায়ে কাশ্মিরে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে’ জাড়িয়ে পড়লে পাক-ভারত সম্পর্ক অবনতির নিুধাপে পৌঁছে।
যে দেশগুলিতে এককালে ইউরোপিয়রা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল এবং তাদের সিস্টেম চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, সে দেশগুলিতেই জঙ্গিবাদ বেশি প্রসারিত হলো। ‘কালো মানুষের দেশ’ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ গেড়েছিল ব্রিটেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন, জার্মান, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, সুইডেন ইত্যাদি দেশগুলি। শোষণ করতে করতে যখন দেশগুলি ছিবড়ে হয়ে গেল, তখন উপনিবেশগুলিকে গুটিয়ে নিল শোষক জাতিগুলি, কোথাও কোথাও পরাধীনগোষ্ঠী দ্বারা বিতাড়িত হলো। এই দেশগুলিতে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতাকামী একটি শ্রেণি যারা শাসকের নির্যাতন নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু সর্বত্রই তারা যাওয়ার সময় তাদের প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ‘আধুনিক’ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গড়ে ওঠা, তাদের পদলেহনকারী দাসমনোবৃত্তির শিক্ষিত শ্রেণির হাতে শাসনক্ষমতা দিয়ে নিজেদের রচনা করা সিস্টেম এই দেশগুলির উপর চাপিয়ে দিয়ে গেল। যেমন আমাদের উপমহাদেশের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ইত্যাদি দলের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে চাপিয়ে দিয়ে গেছে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, অন্য কোথাও দিয়ে গিয়েছিল একনায়কতন্ত্র, কোথাও সমাজতন্ত্র ইত্যাদি।
আফগানযুদ্ধের পরে বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলিকে ইসলামের জেহাদী চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ করা হলো, যদিও সেটা প্রকৃত ইসলাম ছিল না। এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, লেবানন, ইয়ামেন ছিল ফ্রান্সের অধীন, বাহরাইন, ইরাক, কুয়েত, ওমান, কাতার, প্যালেস্টাইন, দক্ষিণ আরব, ট্রান্সজর্ডান ইত্যাদি ছিল ব্রিটেনের অধীন, রাশিয়া আর পর্তুগিজের অধীনেও ছিল উল্লেখযোগ্য এলাকা। এসব এলাকাগুলিতেই জঙ্গিবাদ বিরাট আকার ধারণ করেছে, যার প্রধান কারণ শতবর্ষের নির্যাতন, নিষ্পেষণ, পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তিকামী মানুষের জীবনতৃষ্ণা; ঠিক যেভাবে একাত্তর সনে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণমূলক বিষমনীতির বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মুক্তিপাগল জনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
১৯৯১-৯২ সনের মধ্যেই আল-কায়েদার শাখা বিভিন্ন মোসলেম দেশে গড়ে উঠতে থাকে আর সে সাথে নতুন রিক্রুটদের আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাঠাতে থাকে। গড়ে ওঠে সোভিয়েত রাশিয়ার পরিত্যাক্ত সেনা ছাউনি এবং ওসামা বিন লাদেনের নিজস্ব তৈরি কেন্দ্রগুলোতে সামরিক প্রশিক্ষণ। এসব নব সদস্যদের বেশিরভাগকেই CIA এবং স্পেশাল ফোর্সের ম্যানুয়েল মোতাবেক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হলে এসব জেহাদীরা প্রশিক্ষণে আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। এ ধাপটি হলো, বেশিরভাগ আল কায়েদা জেহাদীদের আত্মঘাতী হবার মানসিকতা অর্জনের প্রশিক্ষণ। আর এ কারণেই এসব জেহাদীরা খোদ সি.আই.এ এবং আমেরিকান স্পেশাল ফোর্স থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকে। কারণ আত্মঘাতী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। (চলবে….)