রিয়াদুল হাসান:
আজ সারা পৃথিবীতে একটি ঘৃণিত, প্রত্যাখাত ও আতঙ্কের বিষয় হলো জঙ্গিবাদ। কারো বংশের মধ্যে কোনো কারণে কারো নামের সাথে একবার যদি ‘জঙ্গি’ শব্দটা যুক্ত হয়, তাহলে সেই বংশের লোকের আর নিস্তার নেই। এই জঙ্গি শব্দটা কিভাবে আসলো, কিভাবে মুসলমান জাতির গায়ে ‘জঙ্গি’ তকমাটা লেগে গেল, এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করার সময় এসেছে। এ আলোচনা এখন প্রাসঙ্গিক এজন্য যে, জঙ্গিবাদকে ওসিলা হিসাবে ব্যবহার করে একের পর এক সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলিকে পাশ্চাত্যের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলি নিজেদের পেটের মধ্যে টেনে নিচ্ছে। তাদের আগ্রাসনে, বোমাবর্ষণে ধ্বংস¯তূপে পরিণত হচ্ছে শহর, নগর, বন্দর। একই উপায়ে আমাদের দেশেও ক্ষেত্র সৃষ্টি করে আক্রমণ করা হবে না, এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না; বিশেষ করে যখন প্রায়শই ধর্মীয় ইস্যুতে বা রাজনীতিতে ধর্মের অপপ্রয়োগের পরিণামে আমাদের দেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ড তথা জ্বালাও-পোড়াও, বোমা হামলা, মানুষ হত্যা, জাতীয়সম্পদ ধ্বংস, রাস্তাঘাট বিনষ্টকরণ, বৃক্ষকর্তন সব মিলিয়ে দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। এই লেখাটিতে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের এই ভয়াবহ সংকটের উৎপত্তি কোত্থেকে এবং কিভাবে এর সমাধান করা যায় তা তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
দু’টি বৃহৎ জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড
বর্তমান সময়টাকে বুঝতে হলে আমাদেরকে বিগত শতাব্দীতে সংঘটিত দু’টি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সূত্রপাত যদিও হয় বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানৎস [Franz Ferdinand (18 December 1863 – 28 June 1914)] এর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিন্তু এই ঘটনাটি বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ ছিল না। অস্ট্রিয়া এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে দু’দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধের প্রকৃত কারণ ছিল উনিশ শতকে শিল্পবিপ্লবের কারণে সহজে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ স্থাপনে প্রতিযোগিতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল অস্ট্রিয়া, জার্মানি, তুরস্ক, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, যাদের বলা হতো কেন্দ্রীয় শক্তি। আর অপরপক্ষে ছিল প্রধানত সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি। যাদের বলা হতো মিত্রশক্তি। এই বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্গত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূখণ্ডগুলি থেকে সংগৃহীত প্রায় ৪,০০,০০০ (চার লক্ষ) মুসলমান বংশোদ্ভূত সৈন্য ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে (The Guardian, Saturday 2 August 2014) । তখন কিন্তু এই মুসলমানদেরকে জঙ্গি বলা হয়নি।
জঙ্গি শব্দটি এসেছে ফার্সি শব্দ জঙ্গ থেকে। ‘জঙ্গ’ অর্থ যুদ্ধ আর জঙ্গি মানে যোদ্ধা। সুতরাং যারা যুদ্ধ করে তারাই ‘জঙ্গি’। শাব্দিক অর্থ বিবেচনায় নিলে ‘আধুনিক যুগে’ সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ জঙ্গিবাদী কার্যক্রম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এতগুলো দেশ ধ্বংস হলো, পাঁচ কোটির অধিক প্রাণ হারাল, প্রায় তের কোটি মানুষ পঙ্গু-বিকলাঙ্গ হলো, শত শত নগর-বন্দর ধ্বংস হলো। দ্বিতীয় বৃহত্তম জঙ্গিবাদী কার্যক্রম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এতে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে ৬১টি দেশ কিন্তু যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ১০৪টি দেশ। মোট নিহতের সংখ্যা সাড়ে আট কোটি, স্বভাবতই আহতের সংখ্যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানের পক্ষে যুদ্ধ করে খেলাফতের দাবিদার তুরস্ককেন্দ্রিক অটোমান সাম্রাজ্য। তুর্কীরা ‘খেলাফত’ শব্দটি ব্যবহার করলেও এটা প্রকৃত ইসলামের খেলাফত ছিল না। আর আট-দশটা সাম্রাজ্যের মতো এটিও ছিল একটি সাম্রাজ্যমাত্র। একইভাবে ব্রিটিশ শাসকশ্রেণিটি কেবলমাত্র ক্রুশধারণকারী খ্রিস্টান, যিশুখ্রিস্টের আদর্শ ধারণকারী নয়। তারা রাজনৈতিক স্বার্থে ঈসার (আ.) নামকে বিক্রি করে চলছে, কারণ ইউরোপের অধিকাংশ জনগণ খ্রিস্টান। এটি মহাসত্য যে প্রকৃতপক্ষে, ইউরোপিয়ানদের ঈসার (আ.) অনুসারী হওয়ার কোনো ধর্মীয় বৈধতা নেই, কেননা তিনি এসেছিলেন ইসরাইলের নবী হিসাবে, তাই ইহুদি গোত্রের বাইরে ধর্মপ্রচারের কোনো অধিকার তাঁর ছিল না, তিনি তা করেনও নি। তিনি তাঁর জাতিকে বলেছেন, “আমি প্রেরিত হয়েছি শুধুমাত্র বনি ইসরাইলের পথভ্রষ্ট মেষগুলিকে উদ্ধার করতে (ম্যাথু ১৫: ২৪)। তাঁর প্রধান বারো জন শিষ্যকে তিনি যখন প্রচারকার্যে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দিলেন তখন তাদের উপদেশ দিয়েছিলেন- “তোমরা অন্য জাতিগুলির মধ্যে যেওনা এবং কোনো সামারিয়ান শহর নগরে প্রবেশ কর না। শুধু মাত্র ইসরাইলি বংশের পথভ্রষ্ট মেষগুলির কাছে যেতে থাকবে (ম্যাথু ১০:৬)।
তবু একটা সময়ে এসে যে কোনো পরিবেশ পরিস্থিতির কারণেই হোক ঈসার (আ.) অনুসারী দাবিদাররা ইহুদিদের বাইরে ঈসার (আ.) শিক্ষা প্রচারে ব্রতী হন এবং ফলস্বরূপ রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য রাজ্যের রাজন্যবর্গও এই ধর্মমতটি রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করে নেন। তাদের হুকুমে এবং নির্যাতনের ভয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য জনগণও তাদের রাজার ধর্ম মেনে নিতে বাধ্য হয়। অবশ্য খ্রিস্টধর্মকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন এমন লোকও নিশ্চয়ই অনেক ছিল। ধর্মীয় বৈধতা না থাকলেও যুক্তির খাতিরে ধরে নিচ্ছি, আল্লাহ প্রেরিত মহামানবদের শিক্ষা মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে এটাই স্বাভাবিক, তাই কোনো জাতিগোষ্ঠী যদি ঈসার (আ.) প্রকৃত শিক্ষাকে ধারণ করে সেটা অবশ্যই তাদের জীবনকে উন্নত করবে। তাই ইউরোপিয়ানরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ঈসার (আ.) উপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তবে শাসকদের এই খ্রিস্টধর্মধারণের কারণ কোনোকালেই ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। শাসকশ্রেণি যদি ঈসা (আ.)-এর প্রকৃত অনুসারী হতো তাহলে কখনোই তারা ধর্মনিরপেক্ষতা নামক ভয়ঙ্কর মতবাদ মানবজাতির ওপর চাপিয়ে দিতে পারত না। ব্রিটিশ সম্রাট অষ্টম হেনরি ১৫৩৭ সনে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে বহিঃষ্কার করেন যার পরিণামে জন্ম নেয় পাশ্চাত্য বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ দাজ্জাল (Anti Christ) । এই খ্রিস্টান শাসকরা যদি ঈসার (আ.) প্রকৃত অনুসারী হতেন তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিতই হতো না।
ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলিতে কিভাবে ধর্মকে, যিশুর বাণীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে সেটা ইতিহাস। নোবেলজয়ী আফ্রিকান বিপ্লবী ডেসমন্ড টুটুর একটি উক্তিই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘When the missionaries came to Africa they had the bible and we had the land. They said ‘let us pray.’ We closed our eyes. When we opened them we had the bible and they had the land.’
অর্থাৎ-যখন মিশনারিরা আফ্রিকায় এলেন তাদের কাছে ছিল বাইবেল এবং আমাদের কাছে ছিল স্বদেশ। তারা বললেন, ‘এসো আমরা প্রার্থনা করি।’ আমরা চোখ বন্ধ করলাম। যখন চোখ মেললাম, দেখি আমাদের হাতে আছে বাইবেল আর তাদের দখলে আমাদের স্বদেশ।
ভুললে চলবে না যে ডেসমন্ড নিজেও কেবল একজন খ্রিস্টানই নন, তিনি কেপটাউনের প্রধান ধর্মযাজক। তাই খ্রিস্টবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পার্থক্য তিনি সহজেই উপলব্ধি করেছেন। আফ্রিকার মত আমাদের উপমহাদেশেও ব্রিটিশরা খ্রিস্টধর্মের পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকেও তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করেছে।
একইভাবে তুর্কি অটোমানরাও প্রকৃত মোসলেম ছিল না। রসুলুল্লাহর এন্তেকালের ৬০/৭০ বছর পরেই প্রকৃত ইসলামের উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে। প্রকৃত ইসলামের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপ্রতিষ্ঠা আর ৬০/৭০ বছর পরে এর উদ্দেশ্য পাল্টে হয়ে গিয়েছিল রাজ্যবিস্তার। স্রষ্টার প্রেরিত সকল ধর্মের প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য হবে মানবতার কল্যাণ। যে ধর্মের উদ্দেশ্য মানবতার কল্যাণ নয়, সেটা আল্লাহর ধর্মই না। আর যে ধর্মটি শুধু সাম্রাজ্য বিস্তার, আমীর-সুলতান ও তথাকথিত খলিফাদের ভোগবিলাসের রসদ যোগায় সেটা প্রকৃত ইসলাম হতে পারে না, তবু বেশভূষা দেখে বিশ্ববাসী সেটাকে ইসলাম বলেই মনে করতে থাকল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানের পরাজয়ের পর তাদের মিত্রশক্তি তুর্কি খেলাফত আর অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারল না। বিশ্বের পরাশক্তিগুলির ষড়যন্ত্রের কারণে তুর্কি সাম্রাজ্যের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ইসলাম-বিদ্বেষী পাশ্চাত্যের দালাল একটি শ্রেণি। এরাই দেশটিকে স্বাধীনতা ও আধুনিকতার ছদ্মাবরণে পাশ্চাত্যের বুটের নিচে ঠেলে দিল। তুর্কি সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেল, খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল মধ্যপ্রাচ্যও। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই বিশ্বের বুকে ক্যান্সাররূপে জন্ম নিল ইহুদি জাতীয়তাভিত্তিক ইসরাইল রাষ্ট্রটি। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে বিশ্বমানবের হৃদয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে প্রধানতম পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একই পক্ষে থেকে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু যুদ্ধের শেষে তারা নিজেরাই হয়ে দাঁড়াল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী তথা ঘোরশত্র“। কারণ উভয়ের হাতেই আছে পারমাণবিক অস্ত্র আর একবনে দুই বাঘ থাকতে পারে না। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারল না কেবলমাত্র নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই যাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় দাতাঁত (Deterrent) । তারা শুরু করল কূটনৈতিক দাবাখেলা, যার নাম দেওয়া হলো ঠাণ্ডা যুদ্ধ। সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে যদি ব্যর্থ প্রমাণ করা যায় তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকবে না এটাই ছিল পুঁজিবাদী মার্কিনি ও তার দোসরদের মূল কর্মপন্থা। এটা করতেও তেমন বেগ পেতে হলো না, কারণ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রবল বিদ্রোহ সৃষ্টি হলো সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশও সর্বশক্তি নিয়োগ করল সমাজতন্ত্রবিরোধী প্রচারণায়। নব্বইয়ের দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে গেল। (চলবে ইনশা’ল্লাহ)