মোহাম্মদ আসাদ আলী
——————–
রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র- কোনো তন্ত্রমন্ত্রই যখন পৃথিবীকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-ক্রন্দন ও যুদ্ধ-সংঘাত-শোষণ ছাড়া কিছুই দিতে পারল না তখন মুসলিম নামধারী ১৬০ কোটির জাতির মধ্য থেকে কিছু লোক স্বপ্ন দেখছে প্রচলিত ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করার। তাদের এই চেতনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নয় এই কারণে যে, একদা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার ছায়াতলে পৃথিবীর এক বিশাল ভূ-খণ্ড শান্তি ও সমৃদ্ধির চূড়ান্ত শিখরে আরোহন করেছিল। সে ইতিহাসকে আবারও ফিরিয়ে আনার আশা পোষণ করে প্রায় সকল মুসলিম। তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে একমাত্র ইসলামই পারবে অশান্তিময় বিশ্বকে শান্তিতে প্রতিস্থাপন করতে। ইসলামের পুনর্জাগরণবিষয়ক রসুলাল্লাহর অনেক ভবিষ্যদ্বাণীও রয়েছে যেগুলো তাদের বিশ্বাসকে আরও পোক্ত করছে। যাই হোক, তারা চাইছে ইসলাম পুনরায় স্বমহীমায় উদ্ভাসিত হোক এবং ইসলামের আদর্শে আলোকিত হয়ে বিশ্ব শান্তিময় হয়ে উঠুক। এই চেতনা থেকেই জন্ম জঙ্গিবাদের।
আজ পৃথিবীর বিশাল ভূ-খণ্ড জঙ্গিবাদ নামক ভয়াবহ মহামারীতে আক্রান্ত। এ মহামারী যেন থামবার নয়। পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রপ্রধানদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে জঙ্গিবাদ। মুসলিম নামধারী জাতিটির প্রত্যেকটি রাষ্ট্রনায়ক চিন্তিত ও শঙ্কিত। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে, নতুন নুতন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, জঙ্গিদেরকে জেলে দেয়া হচ্ছে, সাজা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে; অর্থবল, অস্ত্রবল ও মিডিয়া- তিন শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপাতদৃষ্টে এক অসম লড়াই চলছে পৃথিবীব্যাপী, কিন্তু ফলাফল? শুন্য। একজন জঙ্গি মরলে দশজন তৈরি হচ্ছে। ১৮ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে বিবিসিতে প্রকাশিত ‘বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ সূচক- ২০১৪’ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০১২ ও ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের হার শতকরা ৬১ ভাগ বেড়ে গেছে। সেখানে আরও বলা হয়, বিশ্বে কেবল সন্ত্রাসের (জঙ্গিবাদের) তীব্রতাই বাড়ে নি, এর প্রসারও বেড়েছে। এদিকে চলতি বছরে জঙ্গিবাদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- আগের বছরের তুলনায় ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা এক তৃতীয়াংশ বেড়েছে। আর চলতি বছরের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ থেকে এখনই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের ঊর্ধ্বমুখী সূচকে এ বছরটিও নতুন মাত্রা লাভ করবে। এ পরিস্থিতিই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থাগ্রহণ করা হচ্ছে তার অসারতা প্রমাণ করে। পৃথিবী কাঁপানো এই দানবের প্রাণপাখি কোন গহ্বরে লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। সকলেরই এক প্রশ্ন- জঙ্গিবাদের শেষ কোথায়, কোন পথে?
এমনই হতাশাঘেরা পরিস্থিতিতে আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছে হেযবুত তওহীদ। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি যে, পৃথিবীব্যাপী সংক্রমিত হওয়া জঙ্গিবাদকে নির্মূল করার একমাত্র পথ হলো আদর্শিক লড়াই। আদর্শকে অস্ত্র দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় না। যেহেতু আদর্শটি বিকৃত, কাজেই একমাত্র সঠিক আদর্শই তাকে প্রতিহত করতে পারে। আর সেই আদর্শিক লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা আছে একমাত্র হেযবুত তওহীদের কাছেই। এটা যে নিছক আশ্বাসবাণী নয়, প্রকৃতপক্ষেই জঙ্গিদেরকে ভুল প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট যুক্তি, প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্য আমাদের কাছে আছে, সেটাই অতি স্বল্প পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে এই লেখায়।
সাম্রাজ্যবাদের পাতানো ফাঁদ: জঙ্গিবাদ
পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোই এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদ ইস্যুটির জন্ম দিয়েছে। তারপর তা বিশ্বময় রপ্তানি করে নিজেরাই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ যুদ্ধের স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো পররাজ্য দখল করা, পরসম্পদ লুট করা। আর দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো কম্যুনিজমের পতনের পর তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ইসলাম’-কে ধ্বংস করে দেওয়া। এটা এখন পশ্চিমা আগ্রাসনকারীদের আত্মস্বীকৃত বিষয়। অনেকেই স্বীকার করেছেন, অনেকে এ নিয়ে দম্ভোক্তিও করেছেন। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন। তিনি বলেন, “আজকে আমরা যে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি কুড়ি বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমরাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদেরকে অর্থ যুগিয়েছি।’ [১ জুন ২০১৪, ফক্স নিউজ, সি.এন.এন]। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশারফকে বলতে শোনা গেছে- তালেবান আমেরিকার সৃষ্টি, (ডন, ০৫.১২.১৪)। আর বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া আইএস- এর জন্মের প্রেক্ষাপট যারা জানেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না যে, কীভাবে পশ্চিমা জোট আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টায় আইএসকেই একদা সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে শক্তিশালী করেছে। এমনকি ইরাকের বিস্তির্ণ অঞ্চল দখল করার পরও কুর্দীদের অস্ত্র দেবার নাম করে আকাশ থেকে আইএসকে অস্ত্র প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্রই। অবশ্য জঙ্গিরাও অকৃতজ্ঞ নয়; তালেবান, আল কায়েদা বা আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে পৃথিবীব্যাপী শোষণ অব্যাহত রাখতে যতখানি সুযোগ করে দিয়েছে তা অতীতে কেউ পেরেছে বলে মনে হয় না।
আমরা সবাই জানি, আশির দশকে সংঘটিত রুশ-আফগান যুদ্ধটিই হচ্ছে জঙ্গিবাদের সূতিকাগার। এ সময়টিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই. আফগানদেরকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৪ এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে একটি সশস্ত্র বাহিনী তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৫৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। বিভিন্ন মোসলেম দেশ থেকে লাখ লাখ যুবক আফগানিস্তানে ছুটে গিয়েছিল আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য। তারা কি বুঝেছিলেন যে, এটা জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নয়, এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের যুদ্ধ, এ যুদ্ধে আল্লাহ-রসুলের কিছু আসে যায় না? বুঝতে পারেন নি, কারণ এই যুবকদেরকে প্রাণদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পশ্চিমারা মোসলেম দেশগুলোতে হাজার হাজার ধর্মব্যবসায়ীকে ভাড়া করছিল যারা তাদের যার যার দেশের যুবকদেরকে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উত্তেজিত ও সংঘটিত করেছিল। তারা বলত যে এটা যুদ্ধ নয়, জেহাদ ও কেতাল ফি-সাবিলিল্লাহ। এখানে মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি। শুধু তাই নয়, পরবর্তী প্রজন্মকে জঙ্গি হিসাবে গড়ে তোলার জন্য পশ্চিমারা ওই প্রকল্পের আওতায় আফগানিস্তানের বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তকে সন্ত্রাস ও মারণাস্ত্র সম্পর্কিত অনেক প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কোন কোন অস্ত্র ব্যবহার করলে ভালো হবে এমন তথ্য সেগুলোতে অনায়াসে দেওয়া হয়েছিল। তখন ইংরেজি বর্ণমালা পরিচয়ে ‘জে’-তে জেহাদ শেখানো হতো। এমনকি গণনা শেখানোর সময় ৫ বন্দুক + ৫ বন্দুক = ১০ বন্দুক শেখানো হতো। এভাবে হাতে কলমে জঙ্গিবাদের শিক্ষা প্রচার করেছে যারা সেই পশ্চিমারাই আজ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চেচিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন।
এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ যে আসলে পশ্চিমাদের রাজনীতির খেলা, অর্থাৎ চড়ষরঃরপধষ মধসব, সেটাও প্রমাণিত। এতে তাদের লাভ হচ্ছে তারা খনিজ ও তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো দখল করতে পারছে, পাশাপাশি অস্ত্রব্যবসা করে নিজেদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে যেমন বলা হয় কৃষি অর্থনীতি, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বলা হচ্ছে যুদ্ধ অর্থনীতি (ডধৎ ঊপড়হড়সু)। যুদ্ধ না থাকলে তাদের অর্থনীতিতে মন্দা হবে। তাদের প্রয়োজন বিশ্বজোড়া অস্ত্রের বাজার। কিন্তু তারা নিজেরা আর স্বশরীরে যুদ্ধ করতে আগ্রহী নয়। তাদের সৈন্যরা যুদ্ধবিমুখ ও ভোগবাদী। তাই দরকার পড়েছে মোসলেমদের একটি দলকে আরেকটি দলের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া। সুতরাং জঙ্গিরা পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে অতি প্রয়োজনীয় শত্র“ (টংবভঁষ বহবসু)। তারা যেমন জঙ্গিদেরকে জিইয়ে রাখতে চায় চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত তেমনি, অনেক দেশের সরকারও জঙ্গিবাদ নির্মূল হোক এটা চায় না। জঙ্গিরা থাকলে তাদের বহুমুখী স্বার্থোদ্ধারের পথ খোলা থাকে।
সুতরাং জঙ্গি ও জঙ্গি মনোভাবাপন্ন মুসলিমদেরকে যদি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের এই খেলা সম্পর্কে সচেতন করা যায় এবং তারা যদি বুঝতে পারে যে, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড থেকে ইসলামের কোনো উপকার তো হয়-ই না, বরং ইসলামের শত্র“রাই লাভবান হয় তাহলে ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো আর পশ্চিমা ক্রীড়নকে পরিণত হবে না।
বিকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম: ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয়া
জঙ্গিরা যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে, জেলে যাচ্ছে, ফাঁসিতে ঝুলছে, শত্রুর গোলা-বারুদে ঝাঁঝরা হচ্ছে সেই ইসলাম আর আল্লাহর রসুলের ইসলাম এক নয়। বর্তমানে ইসলামের নাম করে যে দ্বীনটি প্রচলিত আছে তা বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রকৃত ইসলামের মতো মনে হলেও, আত্মায় ও চরিত্রে আল্লাহর রসুলের ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। যেটাকে আইএস, বোকো হারাম, আল কায়েদা, তালেবানরা ইসলাম মনে করছে এবং ভাবছে সেটাকে প্রতিষ্ঠা করে স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনবে সেটা বিগত ১৩০০ বছরের ধারাবাহিক বিকৃতির ফল, প্রকৃত ইসলামের ছিটে ফোটাও এর মধ্যে নেই। দীন নিয়ে অতি বিশ্লেষণকারী আলেম, মুফতি, মোফাস্সের, মোহাদ্দেস, সুফি, দরবেশ ও পীর-মাশায়েখদের অপ্রয়োজনীয় তর্ক-বিতর্ক, বাহাস, মতভেদ ও চুলচেরা বিশ্লেষণের পরিণামে দীনের ভারসাম্য হারিয়ে গেছে অনেক আগেই, সেই ভারসাম্যহীন দীনের ভিন্ন ভিন্ন ভাগকে আঁকড়ে ধরে ছিল ভিন্ন ভিন্ন ফেরকা-মাযহাব, দল-উপদল। অতঃপর ব্রিটিশরা এসে জাতির কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকল। আগের শিক্ষাব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে নিজেরা মাদ্রাসা তৈরি করে সেই মাদ্রাসায় ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের তৈরি সিলেবাস ও কারিকুলাম অনুযায়ী তাদের সুবিধামতো একটি বিকৃত ইসলাম এই জাতিকে শিক্ষা দিল। ফলাফল- মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করে রসুলাল্লাহর রেখে যাওয়া ঐক্যবদ্ধ জাতি এখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, তেহাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হয়ে একে অপরের রক্তে হোলি খেলছে। ব্রিটিশদের শেখানো এই বিকৃত ইসলাম পৃথিবীর এক ইঞ্চি মাটিতেও শান্তি আনয়ন করতে ব্যর্থ। সুতরাং একে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যারা জীবন দেবে, সম্পদ দেবে তারা যে ভস্মে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন তাতে সন্দেহ নেই।
ইসলামের প্রকৃত আকিদা বুঝতে হবে
প্রকৃত আকিদার অনুপস্থিতির কারণে জঙ্গিবাদের পথ আরও প্রশস্ত হচ্ছে। ইসলামে আকিদার গুরুত্ব অতুলনীয়। এই দীনের আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও এ ব্যাপারে তারা সকলেই একমত যে, আকিদা সঠিক না হলে ঈমানের মূল্য থাকে না। জঙ্গিদের ঈমান আছে, শুধু আছে বললে ভুল বলা হয়, তাদের ঈমান অন্য আর দশজন সাধারণ মুসলিমের চেয়ে অনেক বেশি। দৃঢ় ঈমান না থাকলে কেউ জান দিতে যায় না। কিন্তু এত প্রবল ঈমানের কী দাম থাকে যদি আকিদা ঠিক না হয়? আকিদা হচ্ছে পড়সঢ়ৎবযবহংরাব পড়হপবঢ়ঃ, সম্যক ধারণা, অর্থাৎ একটি কাজ কেন করা হবে, কীভাবে করা হবে, কখন করা হবে, কোন কাজ আগে কোনটা পরে, কোনটা এখন কোনটা তখন, কোনটা খুব প্রয়োজনীয় কোনটা কম প্রয়োজনীয়, কোনটা না হলেই নয় কোনটা না হলেও চলবে, কোনটার পূর্বশর্ত (ঢ়ৎবপড়হফরঃরড়হ) কোনটা, কোন কাজ দ্বারা মানবতার কী উপকার হবে বা কী ক্ষতি হবে ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা। অথচ এই দীনের নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাতসহ যে জেহাদের কথা বলে জঙ্গিবাদ ছড়ানো হচ্ছে সেই জেহাদ সম্পর্কেও জঙ্গিদের আকিদা সঠিক নয়। উপরন্তু আকিদাকে অনেকে ঈমানের সাথেই গুলিয়ে ফেলছেন, অথচ আকিদা ও ঈমান যে পৃথক বিষয় তা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। ইসলামের জেহাদ কী জন্য, রসুল কখন কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে জেহাদ করেছেন, কখন কিতাল করেছেন সে সম্পর্কে সঠিক আকিদা না থাকায় জঙ্গিরা সন্ত্রাসকেই জেহাদ বলে মনে করছে। কাজেই ইসলামের প্রকৃত আকিদা জানতে পারলে অনেক বিপথগামী জঙ্গিই সন্ত্রাস ত্যাগ করবে তাতে সন্দেহ নেই।
তওহীদহীন জাতিকে আগে তওহীদের জ্ঞান প্রদান করতে হবে
জঙ্গি মনোভাবসম্পন্ন মানুষদেরকে তওহীদের প্রকৃত অর্থ বোঝাতে হবে। দীনের ভিত্তি বা প্রাণ হলো তওহীদ। জীবনের সকল অঙ্গনে যেখানে আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলের কোনো কথা আছে, সেখানে অন্য কারোটা না মানাই তওহীদের একমাত্র দাবী। সেই তওহীদ কি আজকের মুসলিম নামধারী জাতির মধ্যে আছে? নেই। আজ এই জাতি জাতীয় জীবন থেকে আল্লাহ প্রদত্ত সিস্টেম, বিধি-বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সিস্টেম গ্রহণ করেছে। ইসলাম বলতেই এরা বোঝে নামাজ, রোজা, এবাদত-উপাসনা এবং জিকির-আজগার, তসবীহ-তাহলীল, ওযু, গোসল, মেসওয়াক বা লেবাসের মতো তুচ্ছ ব্যক্তিগত জিনিস। অথচ আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, দীনের ব্যক্তিগত ভাগ মেনে ও জাতীয় ভাগ প্রত্যাখ্যান করে এরা যে তওহীদ থেকেই বিচ্যুত হয়ে গেছে, আল্লাহর চোখে এরা আর যে মোমেন নেই, মুসলিম নেই, বরং মোশরেকে পরিণত হয়েছে সে জ্ঞান তাদের নেই। কাজেই যারা পুনরায় ইসলামের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে চায় তাদেরকে একদিকে যেমন নিজেদের অবস্থান বুঝতে হবে, সেই সাথে বুঝতে হবে জাতি বর্তমানে কোন অবস্থানে আছে। যে জাতিতে তওহীদই নেই, যারা জাতীয় জীবনে আল্লাহর প্রদত্ত সিস্টেমকে অস্বীকার করেছে তাদেরকে তওহীদের আহ্বান না জানিয়ে, তওহীদের মর্মার্থ না বুঝিয়ে অর্থাৎ মানসিকভাবে জাতিকে আল্লাহর বিধান গ্রহণ করার উপযোগী না করে আগেই জেহাদের জিগির তোলা সুবিবেচনার কাজ হতে পারে না। জাতিকে আগে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বোঝাতে হবে। ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজ থেকে অশান্তি দূর করার জন্য সংগ্রাম করাই যে একজন মু’মিনের প্রধান কর্তব্য, এবাদত সেটা সকলকে বোঝাতে হবে। তাদেরকে আরও বোঝাতে হবে যে, ধর্মের কোনো বিনিময় চলে না, ব্যবসা চলে না। ধর্মের কাজ হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। এভাবে জাতিকে আগে ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য, তওহীদ, শিরক, কুফর ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে হবে। যুগ যুগ ধরে এদের বিশ্বাসে, আচারে, প্রথায় যে অজ্ঞতা বাসা বেধেছে তা দূরীভূত করতে হবে। তা না করে যাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম, সেই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরা চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় প্রদান করে। এভাবে যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ শান্তি আনয়ন সম্ভব নয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ গত দুই-এক দশকের ভেতরেই পাওয়া যাবে।
ইতিহাসের শিক্ষা
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইরত তথাকথিত জেহাদী গোষ্ঠীগুলো তাদের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য রসুলাল্লাহর জীবনী থেকে বিভিন্ন ঘটনার অবতারণা করে থাকে। আপাতদৃষ্টে তাদের প্রত্যেকটি যুক্তিই গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে কারণ রসুলাল্লাহ তাঁর নবী জীবনের অধিকাংশ সময়ই বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রসুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করাই প্রতিটি মু’মিনের কর্তব্য। কিন্তু আরেকটু গভীরে গেলেই শুভংকরের ফাঁকিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জঙ্গিরা প্রধান যে ভুলটি করে তাহলো- আল্লাহর রসুলের জীবনের দুইটি ভাগ, অর্থাৎ মক্কা জীবন ও মদীনা জীবনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়; অথচ মক্কা ও মদীনায় রসুলাল্লাহর কর্মপদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মক্কায় তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে তওহীদের বালাগ দিয়ে গেছেন। শত অন্যায়, অবিচার সহ্য করেছেন। মুশরিকদের নির্দয় আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন। সঙ্গি-সাথীরা ঘর-বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। অবরুদ্ধ ও একঘরে জীবনযাপন করেছে। কয়েকজনকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। রসুলের সামনে দিয়ে সাহাবীদের টেনে-হিঁচরে নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, রসুলাল্লাহ বাধা পর্যন্ত দিতে পারেন নি। এত নির্যাতনের মাঝেও মক্কা জীবনে যুদ্ধের অনুমতি ছিল না। সেখানে একটাই কাজ- সমস্ত নির্যাতন, নিপীড়ন, ঠাট্টা, বিদ্রুপ উপেক্ষা করে যথাসম্ভব তওহীদের বালাগ চালিয়ে যাওয়া, ঘুমন্ত মানুষগুলোর অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করে তোলা। অতঃপর যখন মদীনায় একটি বিশাল জনসংখ্যা রসুলাল্লাহর আহ্বান গ্রহণ করল, রসুল হেযরত করলেন এবং মদীনার মুসলিম-অমুসলিম সকলকে নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছার ভিত্তিতে সাধারণ চুক্তির মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী ও অস্ত্র-শস্ত্র দরকার পড়েছিল। সেখান থেকেই রাজনীতিক কারণে রসুলাল্লাহ ও তাঁর সাহাবাদের যোদ্ধা জীবন শুরু। সেই যুদ্ধ প্রচলিত রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতি ও ধর্মীয় বিধান কোনো দৃষ্টিতেই অবৈধ ছিল না।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, ব্যক্তি বা দলগতভাবে কেউ অস্ত্র হাতে নিলে সেটা ইসলাম হবে না, কারণ রসুল তা নেন নি। অস্ত্রের ব্যবহার, সেনাবাহিনীর ব্যবহার করতে পারে একমাত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই মুলনীতিকে অগ্রাহ্য করার অর্থ রসুলাল্লাহর কর্মপদ্ধতিকে ভুল মনে করা।
যারা জঙ্গি হচ্ছে এবং যারা আগামীতে সেই পথে পা বাড়াবে তাদের মূল প্রেরণা হচ্ছে কোর’আন-হাদীস, রসুলের ইতিহাস ইত্যাদি। তাদের ইসলামের অপব্যাখ্যা দ্বারা উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এই অপব্যাখ্যা বজায় রেখে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে সফলতার আশা করা যায় না। কারণ, পূর্বেই বলেছি- যারা জঙ্গি হয় তারা জেনে বুঝেই হয়, মৃত্যুকে ভয় পাওয়া তো পরের কথা, মৃত্যুই তাদের আকুল কামনা। এমতাবস্থায় ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা ও শিক্ষা প্রদান করে মানুষকে সচেতন করে তোলা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। এতে সকলেরই কল্যাণ। ব্যক্তি যেমন উপকৃত হবে, সমাজ ও জাতিও উপকৃত হবে। ইহকাল এবং পরকাল উভয়ই সার্থক হবে। হেযবুত তওহীদ যথাসাধ্য সে প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট ও হেযবুত তওহীদের সহকারী সাহিত্য সম্পাদক