আতাহার হোসাইন:
গত ৫ই জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে দেখা দিয়েছে এক গুরুতর প্রশ্ন। কারণ, গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ গ্রহণযোগ্য সংখ্যক জনসাধারণের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি এই নির্বাচনে। সরকার তরফ থেকে তা ৪০ শতাংশ বলে প্রচার হলেও নির্বাচন বর্জনকারী অন্যতম প্রধান বিরোধী শক্তিটির দাবি মোতাবেক তা ১০ শতাংশেরও কম। এত স্বল্প সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অল্প কয়েকটি দেশ এই নির্বাচনের মাধ্যমে নবগঠিত সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে বটে তবে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ দেশই সমর্থন দান করেনি। তাই অদূর ভবিষ্যতে নবগঠিত ক্ষমতাসীন দলটি বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে কতটা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আপাতত নবগঠিত সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা সহজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্ষমতার সিঁড়িতে আরোহন এবং বিরোধী দলগুলোর কোনঠাসা হয়ে যাওয়ায় উৎফুল্ল মেজাজে থাকলেও বিপদ মোটেই দূর হয়নি। তাই একটি স্থিতিশীল পরিবেশের অন্তরায় হয়ে সবচেয়ে বড় বিপদটিই এখন সামনে অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্র শিক্ষা এবং চর্চা করা দেখতে চান তারা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অবশ্যই নাখোশ। তাই এই অংশটি চাইবে সাম্প্রতিক নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়ে বিরোধী জোটের দাবি পূরণার্থে নতুন করে নির্বাচন করার। এর মধ্য দিয়ে তাত্ত্বিকভাবে হয়তো দেশ গণতন্ত্রের শর্ত পূরণ করবে, কিন্তু আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি গণতন্ত্রের তত্ত্ব পূরণ করা হলেও কখনো আমরা প্রকৃত উন্নতি, প্রগতি ও স্থিতিশীলতা দেখিনি। গণতন্ত্রের নামে সরকারের সব কাজেই বিরোধী দলের বিরোধিতা, বাধা দেওয়া আমাদেরকে শুধু পিছিয়েই দিয়েছে। অথচ আমাদের সমসাময়িক দেশগুলো স্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার কল্যাণে উন্নতি ও প্রগতির শীর্ষে উঠে গেছে। এক মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়াকে তুলে দিয়েছেন প্রথম কাতারের উন্নত দেশগুলোর সারিতে। থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াও এগিয়ে গেছে সমান তালে। অথচ স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও আমরা এখনো ডুবে আছি দলভিত্তিক কোন্দলের ঘেরাটোপে। এ অবস্থায় আটকে পড়ে আমরা এক পা আগাই তো অব্যাহত সংঘাত, রাজনৈতিক হানাহানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, নৈরাজ্য অর্থাৎ গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে যার যা করার অধিকারের নামে ইঁদুর বিড়াল খেলায় দশ পা পিছিয়ে পড়ি। তবে এই মুহূর্তে প্রকৃত বিরোধী দলগুলো কোনঠাসা হয়ে পড়লেও অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের তত্ত্ব বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে পারে ঐ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আমরা আবারো পিছিয়ে যাবো অতীত অবস্থায়। কিন্তু আমরা কি তাই চাই? আমরা কি চাইনা সবুজে শ্যামলে ভরা উর্বর এই দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে? নাকি আমরা চাই বিদেশিদের কাছ থেকে গণতন্ত্র আমদানি করে এদেশের বুকে চাপিয়ে দিয়ে চিরজীবনের মত দাসত্বে শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে?
বিদেশি শক্তিগুলো আমাদের কাছে গণতন্ত্রের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে কি চায় সে সম্বন্ধে নিশ্চয় আমরা অনবহিত নই। তারা চায় আমাদেরকে ‘ভাগ কর এবং শাসন কর’ (উরারফব ধহফ জঁষব) নীতির মাধ্যমে বিভক্ত করে ঘোলা পানিতে ফেলে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে নিতে। পানি ঘোলা করার এই কর্মে তারা ব্যর্থ হলে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে চাইবে। এমনকি তারা বিরোধী পক্ষকে উস্কে দিয়ে দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আজকে আমরা তাই দেখছি। অতীতেও অনেক দেশে বিদেশিদের হস্তক্ষেপে অনুরূপ কর্মকাণ্ড বহুবার হয়েছে। কিন্তু বাকিরা এ থেকে কোন শিক্ষাই নেয় না। খাল কেটে কুমির নিয়ে আসে। প্রথমত ক্ষমতা ভোগ করার জন্য বিদেশিদের ডেকে নিয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেরাসহ গোটা দেশটাকেই গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। আজকেও আমরা গৃহযুদ্ধের হুমকি শুনি এদেশেরই মানুষের মুখ থেকে। কিন্তু কেন, কেন নিজেদের মধ্যে এই বিভেদ? আমরা কি পারিনা সকলে মিলে মিশে আমাদের সমস্যা আমরাই বসে সমাধান করতে? কেন বিদেশিদের ডেকে আনতে হবে আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় নাক গলাতে? বিদেশিদের হস্তক্ষেপে কি হচ্ছে আজ সিরিয়ায়, কি হচ্ছে ইরাকে, কি হচ্ছে আফগানিস্তানে আর কি হচ্ছে আফ্রিকার দারিদ্রপীড়িত ক্ষুধার্ত দেশগুলোতে- তা কি আমরা দেখি না? আজ আমরা যদি বিদেশিদের প্রেসক্রাইব করা গণতন্ত্রের তত্ত্ব বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে বিদেশিদের প্রভুত্ব, স্বীকার করে নিতে হবে বিদেশিদের সরাসরি উপস্থিতি। মেনে নিতে হবে যা করার লাইসেন্স মোটেও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। কারণ আজকের ষোলকোটি মানুষের মধ্যে জীবিত মুক্তিযোদ্ধা এবং নতুন প্রজন্মের পূর্ব পুরুষগণ কি ১৯৭১ সালে একতাবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানিদের শাসন আর শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল এভাবে আবারো কোন শক্তির অধীনে চলে যাওয়ার জন্য নয়। নতুন শক্তির কাছে পরাধীনতার আগেই অর্থাৎ আরো একটি যুদ্ধ না করেই কি আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে গড়ে তুলতে পারি না?
সুতরাং গণতন্ত্র নয়, আগে দরকার বিদেশি হস্তক্ষেপের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করা। আর বিদেশি শক্তির থাবা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে ১৬ কোটি মানুষের এক কঠিন ঐক্য। আমরা কেউ যদি তাদেরকে না ডাকি এবং তারা নিজ উদ্যোগে যদি আসেও তাহলে তারা আমাদের এখানে এসে কোন স্থান পাবে না। ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাত একতাবদ্ধ হলে কোন শক্তিই আমাদেরকে অবদমিত করে রাখতে পারবে না। আমাদেরকে ভয় দেখানো হয় আমাদের শ্রমিকদেরকে বিদেশে না নেওয়ার, আমাদেরকে ভয় দেখানো হয় আমাদের পোশাক আমদানি না করার। কিন্তু তারা আমাদের দেশের মত সস্তা জনশক্তি ও কাঁচামাল আর পৃথিবীর কোথাও না পেয়ে বাধ্য হবে আমাদের কাছেই আসতে। সুতরাং কোন হীনমন্যতা নয়, নয় কোন নতজানু নীতিও। এদেশের সকল মানুষকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে দল, মত নির্বিশেষে সবাইকে আগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঁচতে হবে। এরপর এদেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে কোন জীবনব্যবস্থা তারা নিজেদের জাতীয় জীবনে কায়েম করবে আর কোনটাকে প্রত্যাখ্যান করবে। সুতরাং আপাতত গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না বন্ধ করে আগে দেশ বাঁচান, মানুষ বাঁচান। ঐক্যবদ্ধ হোন।