ধর্ম এসেছে সকল মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য। এটি তাই কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম হতে পারে না। ধর্মের কাজ করতে গেলে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয় এবং বিনিময় কেবল আল্লাহর নিকট থেকে আশা করতে হয়। অথচ আজ একশ্রেণীর আলেম নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলামকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করছেন। তারা ইসলামের বিভিন্ন কাজ করে যেমন- নামাজ পড়িয়ে, মিলাদ পড়িয়ে, মোনাজাত করিয়ে, জানাযা পড়িয়ে, কবর জিয়ারত করে, তারাবি পড়িয়ে, কোরআন খতম দিয়ে, মসজিদের ইমামতি করে অর্থাৎ ধর্মের কাজ করে বিনিময় গ্রহণ করছেন, ধর্মকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করছেন। যখনই দেখা যাবে কেউ ধর্মের নাম দিয়ে ব্যক্তিগত বৈষয়িক স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি করছে তখনই বুঝতে হবে যে এটা ধর্মব্যবসা।
পূর্ববর্তী সকল নবী-রসুল এই ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে ছিলেন। তারা ধর্মের কাজ করে কোন অবস্থাতেই বিনিময় গ্রহণ করতেন না। এ বিষয়ে পবিত্র কোর’আনে বহু আয়াত রয়েছে। আমরা আজকে যেভাবে সুদ খাওয়াকে হারাম মনে করি, শুকরকে হারাম বলে ঘৃণা করি ঠিক তেমনি তাঁরাও ধর্মব্যবসাকে হারাম মনে করতেন এবং ঘৃণা করতেন। অথচ আজকে আমাদের সমাজে ধর্মব্যবসার মতো এই ঘৃণ্য কাজটিকে বিভিন্ন অসিলায় বৈধ বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। এক শ্রেণির আলেম কীভাবে এই হারাম ধর্মব্যবসাকে জায়েজ করে নিয়েছেন তা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। ধর্মের পণ্ডিতগণ কী সূক্ষ্ম কলাকৌশলের মাধ্যমে পার্থিব স্বার্থে ইসলামের বিধানকে কেবল বিকৃত নয়, বিপরীতমুখী করে দিতে পারেন তা বোঝার জন্য একটি হাদিস নিয়ে আলোচনা করাই যথেষ্ট।
আসহাবে সুফফার অন্যতম সাহাবী উবাদাহ বিন সামিত (রা.) বলেন, “আমি আহলে-সুফফার কিছু লোককে লেখা এবং কোর’আন পড়া শেখাতাম। তখন তাদের একজন আমার জন্য একটি ধনুক হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করে। তখন আমি ধারণা করি যে, এ তো কোনো মাল (সম্পদ) নয়, আমি এ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় তীরন্দাযী করবো।
এরপর রসুলাল্লাহর (সা.) নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি: ইয়া রসুলাল্লাহ (সা.)! আমি যাদের কোর’আন পড়া এবং লেখা শিখাই, তাদের একজন আমাকে হাদিয়া হিসেবে একটি ধনুক প্রদান করেছেন, যা কোনো সম্পদই নয়। আমি এ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় তীরন্দাযী করবো। এ কথা শুনে আল্লাহর রসুল বললেন, তুমি যদি তোমার গলায় জাহান্নামের কোনো বেড়ি পরাতে চাও তবে তুমি তা গ্রহণ করো।’ (হাদিস: উবাদা ইবন সামিত (রা.) আবু দাউদ চতুর্থ খণ্ড, হাদিস নং- ৩৩৮১ সুনানে আবু দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
সম্মানিত পাঠক, এখানে কয়েকটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করুন।
প্রথমত, কোর’আন শিক্ষাদানের বিনিময়ে ঐ সাহাবি যখন ধনুক উপহার পান তখন তিনি সেটা এই ভেবে গ্রহণ করেন যে ধনুকটি তো তিনি নিজের কাজে ব্যবহার করবেন না, বরং জেহাদের কাজে এটি ব্যবহার করবেন। সুতরাং এটা গ্রহণ করা হারাম হবে না। তবু তাঁর মনে সন্দেহের একটি কাঁটা থেকে গেল। কারণ সব সাহাবীই জানতেন কোর’আন শেখানোসহ দীনের যে কোনো কাজের বিনিময়ে পার্থিব মূল্য গ্রহণ করা মানে আগুন ভক্ষণ করা। সুরা বাকারার ১৭৪ নম্বর আয়াতটি তাদের অজানা ছিল না, যেখানে আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ যে কেতাব অবতীর্ণ করেছেন যারা তা গোপন করে এবং বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে তারা- (১) নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া কিছুই পুরে না, (২) কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, (৩) আল্লাহ তাদের পবিত্রও করবেন না, (৪) তারা ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে, (৫) তারা হেদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা বা গোমরাহী ক্রয় করেছে, (৬) তারা দীন সম্পর্কে ঘোরতর মতভেদে লিপ্ত আছে, (৭) আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল”। আর সুরা ইয়াসিনের ২১ নম্বর আয়াতে তিনি এও বলেছেন, “তোমরা তাদের অনুসরণ করো যারা তোমাদের কাছে বিনিময় আশা করে না এবং যারা সঠিক পথে আছে।” (আল কোর’আন: সুরা বাকারা ১৭৪)। তাই সাহাবি ওবায়দাহ বিন সামিত (রা.) নিশ্চিত হওয়ার জন্য রসুলাল্লাহর (সা.) কাছে জিজ্ঞাসা করলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি কিন্তু ধনুকটি চেয়ে নেন নি বরং সেটা তাঁকে হাদিয়া হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। তথাপি রসুলাল্লাহ (সা.) সেটা গ্রহণ করতে দিলেন না। সুতরাং ইসলাম শিক্ষা দেওয়ার প্রেক্ষিতে উপহারও গ্রহণ করা যাবে না। করলে সেটা জাহান্নামের কারণ হবে।
এত সাংঘাতিক একটি বিষয়কেও পরবর্তী যুগের আলেম ওলামারা ইজমা কিয়াস করে জায়েজ বানিয়ে নিয়েছেন, দীনের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত করেছেন। দীনের বিনিময় গ্রহণের বিপক্ষে কোর’আনে অন্তত অর্ধশত আয়াত আছে, তারপরও এ নিয়ে ইজমা কিয়াস করে ভিন্ন ফতোয়া আবিষ্কারের সুযোগ আদৌ থাকে কি? অবশ্যই থাকে না। কারণ স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা (র.) বলেছেন, “আমার কোনো মতামত যদি কোর’আন সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আমার ফতোয়াকে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারবে।” তাহলে যেটা জাহান্নামের বেড়ি হয় সেটা জায়েজ হয় কী করে? সেটা নিঃসন্দেহে কুফর এবং হারাম তো বটেই।
ইমাম আবু হানিফা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কিন্তু ধর্মব্যবসায়ী ছিলেন না, তিনি ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। আর তার পরবর্তী বহু বিখ্যাত মনীষী ব্যবসায়ী অথবা কারিগর ছিলেন। তারা জানতেন ধর্মব্যবসা অর্থাৎ ইসলামের কাজ করে অর্থোপার্জনের মতো নিকৃষ্ট জীবিকা আর কিছু হতে পারে না। ইমাম আহমদ ইবনে আমর (আবু ইউসুফ) ছিলেন জুতা প্রস্তুতকারী। তিনি একদিকে জুতা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, আবার অপরদিকে খলিফা মুহতাদি বিল্লাহর জন্য “কিতাবুল খারাজ” বা “ইসলামের রাজস্বনীতি” প্রণয়ন করছিলেন। এই সময়ে তিনি ফেকাহ শাস্ত্রের ওপর নিজের মূল্যবান গ্রন্থাবলী প্রণয়ন সমাপ্ত করতেন।
শাফেয়ী মাজহাবের অন্যতম ইমাম আবু বকর মোহাম্মদ কাফফাল শাশী এর হাতে তালা বানানোর দাগ পরিদৃষ্ট হতো, ইবনে কাহতান দুবাগা দর্জির কাজ করতেন, খ্যাতনামা ইমাম জাসসাস ছিলেন কাঁচপাত্র নির্মাতা। যারা তাদের ক্ষুরধার মেধাকে কাজে লাগিয়ে ইসলামের বিধিবিধানকে সন্নিবেশন করে ফেকাহ শাস্ত্রগুলো তৈরি করে গেলেন তারা ওগুলোর বিনিময়ে এক পয়সাও রোজগার করেন নি। তারা ওগুলো করেছেন সমাজের প্রয়োজনে। বিচার করতে আইনের বই লাগবেই, রাজস্বের কাজ করতে অর্থনীতির বই লাগবেই। তখন ইসলামের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাই এই মানুষগুলো কষ্ট করে এই গ্রন্থগুলো প্রণয়ন করেছেন মানুষের কল্যাণার্থে।
এবার আসি বর্তমান সময়ে। এ সময়েও অনেক ওলামায়ে কেরাম আছেন যারা এই পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেন। ভারতবর্ষের বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার শায়েখুল হাদিস মুফতি সাঈদ আহমেদ পালানপুরি সেখানকার নবীন আলেমদের উদ্দেশে প্রদত্ত উর্দু বয়ানে বলেন, “আলেমগণ জীবিকা উপার্জনের জন্য মসজিদ-মাদরাসা নির্ভর না থেকে অন্য যেকোনো পেশা গ্রহণ করতে পারেন। বর্তমানে মাদরাসায় পড়ানো কিংবা মসজিদে ইমামতি করার পাশাপাশি রোজগারের জন্য কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়ানো অনেকেই খারাপ মনে করে থাকেন। ভাবেন, আলেম মানেই তো শুধু মাদরাসা, মসজিদ, খানকা নিয়েই পড়ে থাকা। সাধারণের পাশাপাশি এমনটা আলেমরাও ধারণা করে বসছেন আজকাল। অথচ নিজ হাতে জীবিকা উপার্জন করা একটা উত্তম কাজ। এটা তাকওয়া, পরহেজগারির বিপরীত কোনো বিষয় নয়। বোখারি শরিফের ২৭৮ নম্বর পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ও রয়েছে।
তাছাড়া নবী-রসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরাম ও আকাবিরদের প্রায় প্রত্যেকেই ধর্মীয় কাজের পাশাপাশি সংসার পরিচালনার জন্য কোনো একটি পেশা বা কাজ বেছে নিয়েছিলেন। দাউদ (আ.) রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি লৌহবর্ম তৈরি করতেন। সোলাইমান (আ.) ঝুড়ি বানাতেন। এই তো কয়েক শ’ বছর আগেও বাদশাহ আওরঙ্গজেব (রহ.) নিজ হাতে কোর’আন শরিফ লিপিবদ্ধ করতেন এবং তা বিক্রি করতেন। আজও দারুল উলুম দেওবন্দের কুতুবখানায় তার হাতে লেখা কোর’আনে কারিমের সেই কপি বিদ্যমান।
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার আগে শাইখুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতুবি (রহ.) মিরাটের একটি ছাপাখানায় প্রুফ দেখার কাজ করতেন। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর তা ছেড়ে দেওয়ার তাগাদা দিয়ে চিঠি দেওয়া হলো। তিনি আরজ করলেন, ‘সব ছেড়ে দিলে আমার পরিবারের খরচ বহন করব কী করে!’ তাহলে কি তার মাঝে কোনো তাকওয়া, পরহেজগারি ছিল না? অবশ্যই ছিল। অধিক তাকওয়ার ফলেই দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে তিনি কোনো দিনও বেতন গ্রহণ করতেন না।
বর্তমানে আমাদের পথপ্রদর্শক দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষকবৃন্দ অধ্যাপনার পাশাপাশি কোনো না কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। আমি নিজেও বহুদিন কুতুবখানায় কাজ করেছি। ছাপানো, বাইন্ডিং সব নিজ হাতে করেছি। কারো সহযোগিতা নেইনি কখনো। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ভাতা গ্রহণ করে আবার লিল্লাহ ফান্ডে ওয়াকফ করে দিই আজ অবধি।
আলেমরা মাদরাসা-মসজিদ, মক্তব, খানকা সবই দেখবেন। পাশাপাশি প্রয়োজনমাফিক জীবিকা উপার্জনের জন্য যেকোনো একটি কাজে লেগে যাবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেন ধর্মীয় কাজে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। পড়া, পড়ানো, খাওয়া, ঘুম ছাড়া আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় থাকে। সে সময়টা অযথা নষ্ট না করে উপার্জনের উদ্দেশ্যে কোনো না কোনো কাজে ব্যয় করা উচিত। কাগজ কিনে লেখালেখি করা বা সেলাই মেশিন কিনে ঘরে বসে কাজ করে হলেও। এতটুকু শ্রমও সংসার পরিচালনার জন্য যথেষ্ট। এজন্য জীবিকার উদ্দেশ্যে শুধু মাদরাসায় পড়ানো বা মসজিদে ইমামতি করার ওপর ভরসা করা উচিত নয়। এতে কোনো বুজুর্গি নেই; বরং নিজ হাতে উপার্জন করে বৈধপন্থায় সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করাই মো’মেনের উত্তম কাজ।”
অথচ আজকের মাদ্রাসাগুলোতে এমন নিঃস্বার্থ ফকিহ ও আলেমদের লেখা বই পাঠ করে আলেম সনদ নিয়ে যারা বেরিয়ে আসেন, ফেকাহর কেতাব পাঠ করার অহঙ্কারে তাদের পা জমিন স্পর্শ করে না। অথচ তারা আল্লাহর রসুল, আসহাবসহ সেই প্রাথমিক যুগের ইমামদের আদর্শকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে বহু দূরে নিক্ষেপ করে, পৌরোহিত্য করাকে, দীনের জ্ঞান বিক্রি করাকে, ইমামতি করাকে পেশায় পরিণত করেছেন। আদর্শচ্যুতির কী করুণ দৃষ্টান্ত!
ইসলাম নিয়ে ব্যবসা করার কারণে ইসলাম আজ বিকৃত হতে হতে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। বিপরীত ইসলাম পালনকারী মুসলিম জাতির পরিণতিও হয়েছে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী জাতির বিপরীত। প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী ছিল পৃথিবীর সেরা জাতি, আর আমরা হয়েছি পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে নিকৃষ্ট, সকল জাতির গোলাম। আল্লাহর হুকুম পরিত্যাগ করে আমরা পাশ্চাত্যের রচিত জীবনবিধান মেনে চলছি। আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চলছে তাদের তৈরি করা নিয়ম দিয়ে। আমরা সর্বত্র সকল জাতির দ্বারা অপমানিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত। এই দুর্দশা থেকে যদি আমরা মুক্তি পেতে চাই তাহলে আমাদেরকে তওহীদের পক্ষে, আল্লাহর হুকুমের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটি যারা ইসলামকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। তাই ধর্মব্যবসার মুখোস আজকে খোলা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, মুসলিম জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে, মানবজাতির কল্যাণের স্বার্থে।