রিয়াদুল হাসান
মানুষ সমাজ থেকে শেখে। কোনো সমাজে যে মূল্যবোধের চর্চা হয় মানুষ সেটাই নিজের জীবনে ধারণ করে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব পাশ্চাত্য সভ্যতাকে তাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছে, তাদের জীবনবিধান ও জীবনযাত্রাকে অনুসরণ করার প্রতিযোগিতা করছে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোও পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতা দাজ্জালের প্রবর্তিত গণতন্ত্র, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতিকে অনুসরণ করছে। কেউ অনুসরণ করতে রাজি না হলে তাদের উপর অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক অবরোধ এবং প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা মূলত প্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো উৎকর্ষ দিয়ে মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করছে। এমন সব কাজ করে দেখাচ্ছে যা আগের মানুষ কল্পনাও করতে পারত না। মানুষের জীবনযাত্রাকে সে অনেক সরল করেছে। মানুষ মনে করছে যে সে এখন অনেক সভ্য ও শিক্ষিত হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষও আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এখন এমন আরাম ভোগ করছে যা অতীতের রাজা বাদশাহরাও পারতেন না। সে মুহূর্তেই পৃথিবীর অপরপ্রান্তে কথা বলতে পারছে, বিদ্যুৎশক্তিতে চাকরের মত কাজে লাগাতে পারছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের জীবনব্যবস্থা বা দীন অনুসরণের ফলে কী চরিত্রের মানুষ তৈরি হচ্ছে সেটা একবার ভেবে দেখা দরকার। কেননা দিনশেষে কোনো সমাজ সভ্যতার মানুষ যদি স্যুটবুট পরা পশুতে পরিণত হয় তাহলে সভ্যতা কথাটারই কোনো মানে থাকে না।
দাজ্জাল শব্দের অর্থ চোখ ধাঁধানো, চাকচিক্যময় প্রতারক। মাকাল ফল যেমন দেখতে সুন্দর কিন্তু খেতে কুৎসিত ঠিক তেমনি। পাশ্চাত্য সভ্যতার সুন্দর কথার প্রলোভনে পড়ে কেউ যদি তাকে গ্রহণ করে তাহলেই সে এর ভিতরের জঘন্য রূপের দর্শন পায়।
এই যে কথিত আধুনিক সভ্যতা, এর আদর্শিক ভিত্তি ছিল মানবতাবাদ যা রোমান হিউমিনিটাসের ধারণা থেকে উদ্ভূত। যেমন প্রোটোগোরাস বলেছিলেন, “Man is the measure of all things- মানুষই সমস্তকিছুর মানদণ্ড।” এর আগে ঐশ্বরিক বিধানই ছিল সবকিছুর মানদণ্ড। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পণের সময়ে অর্থাৎ ১৪০০-১৭০০ সন পর্যন্ত এই বৃহৎ সময়ে ইউরোপে নতুন এই কথিত ‘মানবতাবাদী’ চিন্তার বিকাশ ঘটে। এর মাধ্যমে মধ্যযুগের সংকটের পর যে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয় তাকে রেনেসাঁ (Renaissance) বা নবজাগরণ বলা হয়ে থাকে। শিল্প, স্থাপত্য, নৈতিক দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও সাহিত্যে এই নতুন চিন্তার প্রকাশ ঘটে। ধর্মের কর্তৃত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করাই ছিল রেনেসাঁর মূল লক্ষ্য, যদিও শুরুতে চেষ্টা করা হয়েছিল মধ্যযুগে ইউরোপময় চালু থাকা বিকৃত খ্রিষ্টীয় মোল্লাতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে নিউ টেস্টামেন্টের মূল শিক্ষায় ফিরে যেতে। ১৫২৭ সালে মার্টিন লুথার তাঁর ‘দ্য নাইন্টি ফাইভ থিসিস’ গ্রন্থে রোমান ক্যাথেলিক যাজকীয় নীতি, তাদের প্রচলিত খ্রীস্ট বিশ্বাস নিয়ে অনেক ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেন। খ্রিষ্টধর্মের মধ্যেই প্রথাবিরোধী মানবতাবাদীরা প্রোটেস্ট্যান্ট নামক সংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলেন। মানুষ সর্ব উপায়ে খ্রিষ্টধর্মের যাজকশ্রেণির অবদমনমূলক শাসন-ত্রাসনের হাত থেকে নিস্তার চাচ্ছিল। রেনেসাঁর ‘মানবতাবাদ’ ছিল মধ্যযুগীয় সংকীর্ণ যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি জাগরণ। এই রেনেসাঁর স্রষ্টা মানবতাবাদীরা (যাদের অধিকাংশই ছিলেন নাস্তিকতার দায়ে অভিযুক্ত) চেয়েছেন এমন একটি সভ্যতা গড়ে তুলতে যেখানে একটি জাতি তার বেসামরিক জীবনে তাদের স্বাধীন মতের প্রতিফলন ঘটাতে পারবে। এটা ছিল তাদের একটি স্বপ্ন যা কোনোদিন অর্জিত হয় নি। আজ ৫০০ বছর পর সেই বস্তুবাদী সভ্যতার মানবতাবাদী বুলি মিথ্যা পরিহাসে পরিণত হয়েছে। সেই সভ্যতা এক অতিকায় মহাশক্তিশালী দানব দাজ্জালের রূপ নিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করে চলেছে। সে কথা পরে হবে।
রেনেসাঁ কেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তা বুঝতে মধ্যযুগীয় বর্বরতার (Dark Ages) পটভূমি জানা জরুরি। এ সম্পর্কে এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা, অক্সফোর্ড ডিকশনারি ও উইকিপিডিয়ায় যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ হচ্ছে- ৫ ম শতাব্দি থেকে ১৫ শ শতাব্দি পর্যন্ত যখন ইউরোপের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে জর্জরিত ছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে অনেক দুরে অন্ধকারে ছিল। এ সময়টিতে ইউরোপে খ্রিষ্টধর্ম প্রবল পরাক্রান্তভাবে রাজকীয় ক্ষমতার অংশীদার ছিল। ৩১৩ খ্রিষ্টাব্দের রোম সম্রাট কন্সটানটাইন ও বলকান অঞ্চলের সম্রাট লিসিনিয়াসের মধ্যে সম্পাদিত ‘এডিক্ট অব মিলান’ চুক্তির মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের সর্বত্র রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে কায়েম হয়ে যায়। সম্রাট খ্রিষ্টধর্মকে সার্বজনীন বা ক্যাথেলিক হিসাবে ঘোষণা করেন এবং পাদ্রিদেরকে উচ্চবেতন, ক্ষমতা ও পদমর্যাদা প্রদান করেন। কিন্তু খ্রীষ্টধর্মে জাতীয় জীবনের কোনো বিধান না থাকায় বাধে বিপত্তি। এতে আছে কেবল স্রষ্টার স্তব, ঈসা (আ.) এর জীবনের নানা ঘটনা, পূর্বের নবীদের ইতিহাস, প্রার্থনা, নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী ইত্যাদি যা মানুষের মানবিক গুণাবলিকে সমৃদ্ধ করবে, কিন্তু যা দিয়ে একটি জাতীর জাতীয়, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, বিচারিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি অঙ্গনের কোনো সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ এ বিষয়ে বাইবেলের নতুন নিয়মে কোনো আলোচনাই নেই। কেননা ঈসা (আ.) এর শিক্ষা কেবল বনি ইসরাইল গোত্রের জন্য প্রযোজ্য ছিল। ইহুদিদের বাইরে এই ধর্ম প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। ঈসা (আ.) বলেছিলেন, শুধুমাত্র ইসরাইলের পথভ্রষ্ট মেষগুলি ছাড়া অন্য কারো জন্য আমাকে পাঠানো হয় নাই (বাইবেল- নিউ টেস্টামেন্ট, ম্যাথু ১৫:২৪)। কিন্তু তাঁর অন্তর্ধানের তিন শতাব্দি পর খ্রিষ্টধর্মকে যখন রাজধর্ম তথা জীবনব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করা হল, তখন নিউ টেস্টামেন্টে জাতীয় জীবনের বিধানের অনুপস্থিতি একটি বিরাট ঘাটতি হিসাবে দেখা দিল। আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতিহীন একটি ব্যবস্থা দিয়ে একটি সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা অসম্ভব এটা সাধারণ জ্ঞান। অথচ পোপ ও ইউরোপীয় রাজারা সেই ব্যর্থ চেষ্টাই করলেন কারণ ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ বাদ দিয়ে অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেরা সার্বভৌম হয়ে নতুন সংবিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি প্রণয়ন করে নেয়া তখনও মানুষের কাছে অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার ছিলো। এই চেষ্টা করতে যেয়ে প্রতিপদে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের ব্যাপারে সংঘাত আরম্ভ হলো এবং ক্রমশ তা এক প্রকট সমস্যারূপে দেখা দিলো। এই সমস্যার কিছু বিবরণ দেওয়া আবশ্যক।
ব্রিটেনে আজ থেকে মাত্র দেড়শ বছর আগেও পুরুষরা জনসমাগমে স্ত্রীর ঘাড়ে, বাহুতে বা কোমরে লাগাম (Halter) বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াত এবং নিলামের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রি করে দিত। ছবি: ঝবষষরহম ধ ডরভব (১৮১২–১৮১৪), থমাস রোল্যান্ডসন
ঈসা (আ.) এর শিক্ষায় জাতীয় জীবনব্যবস্থার ঘাটতি পুরনে এগিয়ে এলেন ধর্মযাজকরা, যারা কিনা নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন। ক্ষমতা ও ঐশ্বরিক পদমর্যাদাবলে পাদ্রিরা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত দিতে লাগলেন এবং জনগণকে তা ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিতে হল। তারা রাজার সকল অন্যায়-অত্যাচারকে ধর্মীয় বৈধতা দিতে লাগল। এভাবেই সমগ্র ইউরোপে চলতে থাকল দ্বৈতশাসন- একদিকে রাজা ও জমিদার শ্রেণির শাসন, অপর দিকে গির্জার শাসন।
গির্জার নিপীড়নের ভয়াবহতা ও সীমাহীন অন্ধত্বের চর্চা নিয়ে বহু বই লেখা হয়েছে রেনেসাঁর যুগে। সে যুগের বর্বরতা কতটা তুঙ্গস্পর্শী ছিল তা বোঝানোর জন্য ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ একটি বাগধারায় পরিণত হয়ে গেছে। তবু কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়- যেমন ডাইনি শিকার বা Witch-hunt. ৭৮৫ সালে চার্চ অব প্যাডেরবর্ন ডাকিনীবিদ্যা নিষিদ্ধ করে। এই বিধানের আওতায় প্রায়ই ডাইনি শিকার করা হত। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে সে বিচার দেখত এবং ডাকিনীবিদ্যা বা শয়তান উপাসনায় জড়িত থাকায় বা ধর্ম-অবমাননার দায়ে অভিযুক্তদেরকে ধরে পুড়িয়ে মারা হত। সারা ইউরোপে প্রায় ১২,০০০ জনকে ডাইনি বিচারের নামে হত্যা করা হয়েছিল যাদের অধিকাংশই ছিল নারী। এছাড়া বহু বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজবিপ্লবীকে ডাইনি সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে এবং বিশ্বজগৎ একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে বলায় বিজ্ঞানী জিওর্দানো ব্রুনোকে রোমের রাজপথে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। উল্লেখ্য, যিশু রক্তপাতের ঘোর বিরোধী ছিলেন; তাই পাদ্রীরা বিনা রক্তপাতে মৃত্যু ঘটানোর জন্য ফাঁসি দেওয়া, বৃহদাকৃতির কড়াইতে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ফেলে দিয়ে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে মারার পক্ষপাতি ছিলেন। বিজ্ঞানী ব্রুনোকে সমর্থন করার অপরাধে গ্যালিলিও গ্যালিলিকে দীর্ঘ আট বছর অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়েছিল।
মধ্যযুগে ইউরোপে নারী নির্যাতন প্রবল আকার ধারণ করেছিল। ১৭৫৩ সনে বিবাহ আইন প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপে বিয়ে করতে যথাক্রমে ১২/১৪ বছরের নারী পুরুষের সম্মতিই যথেষ্ট ছিল, কোনো সাক্ষী লাগত না, কোনো লেখাজোখা থাকত না। ফলে ব্যভিচার চরম আকার ধারণ করেছিল। নারীদের জীবনের কোনো মূল্যই ছিল না। খোদ ব্রিটেনে আজ থেকে মাত্র দেড়শ বছর আগেও পুরুষ তার স্ত্রীকে বিক্রি করতে পারে। স্বামীরা জনসমাগমে স্ত্রীর ঘাড়ে, বাহুতে বা কোমরে লাগাম (Halter) বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াত এবং নিলামের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রি করে দিত। ১৮৬৯ সালে এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়। (দেখুন Wife Selling – Wikipedia)
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; ইমেইল: mdriayulhsn@gmail.com; ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১]