কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন সত্যদীন ইসলামের পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী অগ্রসৈনিক। তিনি আত্মা দিয়ে চেয়েছেন প্রকৃত ইসলাম আবার ফিরে আসুক, মোসলেম উম্মাহ তার হৃত গৌরব ফিরে পাক। তিনি ইসলামের ধারক-বাহকদেরকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। জাতির মুক্তির জন্য কি করা যায় এ জন্য তিনি তাদের কাছে ছুটে গিয়েছেন। কিন্তু তাদের অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতা, স্বার্থপরতা দেখে চরম হতাশ হোয়েছেন এবং তাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হোয়েছেন। অত:পর ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা ইসলামের কী অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হোয়েছে তা নিজের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ কোরেছেন। এটা তাকে কোরতে হোয়েছে, কারণ তিনি সত্যকে প্রকাশ কোরতে চেয়েছেন আর সত্য সর্বদাই চরম আগ্রাসী ও উদ্ধত, তা মিথ্যার মগজকে চুরমার কোরে দেয় (সুরা আম্বিয়া ১৮)।
বর্তমানে পৃথিবীতে বিরাজমান সবগুলি ধর্মই উপাসনা কেন্দ্রিক। মানবজাতির জাগতিক সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা যে বিষয়গুলির উপর নির্ভর করে, সে বিষয়গুলি সম্পর্কে প্রচলিত ধর্ম নির্বিকার। ধর্মের আলোচ্য বিষয় যেন কেবলমাত্র জন্মের আগে আর মৃত্যুর পরের বিষয়গুলি নিয়ে। মধ্যের সময়টুকু নিয়ে কথা বলার অধিকার কেবলমাত্রই ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার যা সম্পূর্ণরূপেই পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার নিয়ন্ত্রণাধীন। তাদের তৈরি করা রাজনৈতিক মতবাদগুলি তারা অস্ত্র, অর্থ আর প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বের উপর চাপিয়ে দিয়েছে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে মানুষ দিন দিন বস্তুবাদী, আত্মাহীন জানোয়ারে পরিণত হোচ্ছে। সর্বপ্রকার অপরাধ লাফিলে লাফিয়ে বাড়ছে, নতুন নতুন অপরাধের সঙ্গে মানবজাতির পরিচয় হোচ্ছে। অর্ধপৃথিবী জুড়ে মোসলেম দাবিদার ১৬০ কোটির যে বিরাট জনগোষ্ঠী আছে তাদের উপর গত কয়েক শতাব্দী ধোরে চোলছে অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন ও আগ্রাসনের স্টিম রোলার। পৃথিবীতে যে কয়টি প্রধান জাতি আছে তার মধ্যে এই মোসলেম দাবিদাররাই নিকৃষ্টতম। অন্য সবগুলি জাতি মিলে তাদেরকে পৃথিবীর সর্বত্রই অপমানিত, অপদস্থ কোরছে, আক্রমণ কোরে হত্যা কোরছে, ধন-সম্পদ লুটে নিচ্ছে, তাদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দিচ্ছে, মা, মেয়ে, বোনদের ওপর পাশবিক অত্যাচার কোরে সতিত্ব নষ্ট কোরছে। মুসলিমদের নিজেদের মধ্যেকার ফেরকা-মাজহাব নিয়ে যে দাঙ্গা সহস্রাধিক বছর ধোরে চোলছে তাতেও লক্ষ লক্ষ মুসলিমের প্রাণ ও রক্ত ঝোরছে। ইরাকে, সিরিয়ায়, পাকিস্তানে ভিনদেশি শত্র“ নয়, তারা নিজেরাই নিজেদেরকে গণহত্যা কোরে চোলেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হোচ্ছে আমাদের সমাজের যে শ্রেণিটি নিজেদেরকে আলেম বোলে পরিচয় দিয়ে থাকেন তারা মুসলিমদের এই দাসত্ব ও হীনতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। তারা ধর্ম-কর্ম ও সংসারধর্ম নিয়েই ব্যস্ত, এগুলির গুরুত্বই তারা সবার সামনে তুলে ধরেন। কারণ এসব ধর্মকর্ম দ্বারা তাদের অর্থপ্রাপ্তি ও জীবিকা নির্বাহ হয়। তারা ভুলে গেছেন যে আল্লাহর রসুল এসেছিলেন এবং উম্মতে মোহাম্মদী জাতির উন্মেষ ঘোটিয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে শান্তি দেওয়ার জন্যই, মানব সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগশোক, হতাশা, সর্বপ্রকার অবিচার, অন্যায় ও বৈষম্যকে চিরতরে কবর দেওয়ার জন্য। এটা করাই ছিলো সেই মহান জাতির এবাদত। কিন্তু সেই জাতির আলেম সমাজ সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্য বহু আগেই বাদ দিয়ে ধর্মকে একটি বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ কোরে নিয়েছেন। এই ধর্মব্যবসা তাদেরকে কোথায় নিয়ে গেছে সেটাও তারা বুঝতে সক্ষম নন। তারা সমাজের একটি পরজীবী ও পরভোজী শ্রেণিতে পরিণত হোয়েছেন। তাদের নৈতিক মেরুদণ্ড বোলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই, সমাজের কোনো প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার মত সাহসিকতা তাদের নেই, কারণ সমাজের ঐসব দুর্নীতিপরায়ণ, সন্ত্রাসী শ্রেণিটির কাছে তারা ভাতের জন্য মুখাপেক্ষী। তাদের এই হীনতার কারণ তারা দীনের বিনিময় গ্রহণ করেন এবং নিজেদের সম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় দান করেন না। আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাকৃতিক নিয়ম হোল, দান ও কোরবানি মানুষকে পবিত্র করে, আল্লাহর সান্নিধ্য এনে দেয় (সুরা তওবা ১০৩)। পক্ষান্তরে দীনের কোন কাজ কোরে পার্থিব বিনিময় গ্রহণ মানুষকে অপবিত্র করে। এই অপবিত্রতা এতই নিকৃষ্ট যে আল্লাহ তা হাশরের দিন পবিত্র কোরবেন না বোলে পবিত্র কোর’আনে জানিয়ে দিয়েছেন (সুরা বাকারা ১৭৫)। কিন্তু ধর্মব্যবসা এমনই একটি জঘন্য কাজ যা মানুষকে দীনের বিনিময় নিতে অভ্যস্ত কোরে তোলে এবং সম্পদ দান থেকে বিমুখ কোরে দেয়। ফলে সে আসমানের নীচে সর্বনিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়, তার ক্ষমার দরজাও বন্ধ হোয়ে যায়। উপরন্তু সে হোয়ে পড়ে চূড়ান্ত কৃপণ। আল্লাহর রাস্তায় সে এক কপর্দকও ব্যয় করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে কিন্তু ওয়াজে বক্তৃতায় তারা অন্যদেরকে ম
সজিদে, মাদ্রাসায়, এতিমখানায় দানের ফজিলত বোঝায় এবং সেই দান থেকেও নিজেদের হিস্যাটা বুঝে নেয়।
আমরা যামানার এমামের অনুসারীরা সুস্পষ্টভাবে বোলছি যে, নামাজ রোজা করা মানুষের প্রকৃত এবাদত নয়। যখন মানবতা ভূলুণ্ঠিত, আর্ত মানুষের ক্রন্দনে আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত, নিষ্পাপ শিশুর রক্তে সিক্ত পৃথিবীর মাটি, ধর্ষিতার লজ্জায় জগত অন্ধকার তখন যারা মসজিদে বসে হালকায়ে যিকিরের রব তুলছেন, যারা নিভৃত গৃহকোণে এতেকাফ কোরছেন, যারা হজ্বে গিয়ে সাফা-মারওয়া কোরছেন, যারা গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদ গুজারি হোচ্ছেন তারা মনে রাখবেন এ সব পণ্ডশ্রম। যে মসজিদ-মন্দিরকে ধর্মব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত করা হোয়েছে সেখানে আল্লাহ নেই। তিনি হাদিসে কুদসীতে বলেছেন, ‘আমি ভগ্নপ্রাণ ব্যক্তিদের সন্নিকটে অবস্থান করি।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘বিপদগ্রস্তদেরকে আমার আরশের নিকটবর্তী করে দাও। কারণ আমি তাদেরকে ভালোবাসি।’ (দায়লামী ও গাজ্জালী)। অথচ ধর্মব্যবসায়ীরা এই নির্যাতিত মানুষের শান্তি-অশান্তির দায়িত্ব শয়তান, অত্যাচারী দুর্বৃত্তদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য মসজিদ, মন্দির, গির্জায়, প্যগোডায় ঢুকে বোসে আছেন। তাদের উদ্দেশ্যে কবি নজরুল তার শহীদী ঈদ কবিতায় এই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন যে,
নামাজ-রোজার শুধু ভড়ং,
ইয়া উয়া প’রে সেজেছ সং,
ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম!
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কর জড়,
ত্যাগের বেলাতে জড়সড়!
তোর নামাজের কি আছে দাম?
ধর্ম এসেছে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। যে সমাজে মানুষের কোনো অধিকার নেই, তার রক্তের কোনো মূল্য নেই সেখানে একজন মোমেনের প্রথম এবাদত হোচ্ছে মানুষকে এই বিভীষিকাময় অবস্থা থেকে উদ্ধার করা। এর আগে নামাজ রোজা কোরে আসমান জমিন ভর্তি কোরে ফেললেও লাভ নেই। আল্লাহ বোলেছেন, “প্রত্যেক সালাত আদায়কারীর সালাতই আমি কবুল কোরি না। আমি শুধু সেই ব্যক্তির সালাত কবুল কোরি, যে আমার মহত্বের নিকট নম্রতা প্রকাশ করে, আমার নিষিদ্ধ কাজ করা থেকে নিজের প্রবৃত্তিকে সংযত কোরে রাখে, আমার অবাধ্যতার কাজ বারংবার করা থেকে বিরত থাকে, ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান করে, উলঙ্গকে বস্ত্রদান পরিধান করায়, বিপদগ্রস্তের প্রতি দয়াপরবশ হয় এবং আগন্তুক অতিথিকে আশ্রয় দান করে এবং এইসব করে আমারই উদ্দেশ্যে (হাদিসে কুদসী, হারিসা ইবনে ওয়াহাব (রা.) হতে দায়লামী)।
তাহোলে নামাজ রোজা কি কোরতে হবে না? হ্যাঁ, নামাজ রোজা তাদেরই জন্য যারা মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরত থাকবে। এসব প্রশিক্ষণ তাদের সেই কাজ করার চরিত্র সৃষ্টি কোরে দেবে। যেমন একটি বাড়িতে খুঁটি দেওয়া হয় ছাদকে ধোরে রাখার জন্য। যদি ছাদই না দেওয়া হয়, তাহোলে শুধু খুটি গেঁড়ে কোন লাভ নেই। আগে আমাদের প্রকৃত এবাদতে ফিরে যেতে হবে। মানবজাতিকে সেদিকেই ডাকছে হেযবুত তওহীদ।