এতিমখানার নামে যে মাদ্রাসাগুলো আমাদের দেশের সব জেলায় আছে সেগুলোর যথার্থতা ও সমাজে এর উপযোগিতা সম্পর্কে অনেক আলেমই যুক্তি পেশ করে বলেন, “বাংলাদেশের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে যতগুলো এতিমকে সারাদেশে প্রতিপালন করা হয় একটা জেলা শহরের মাদ্রাসাভিত্তিক লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতে তার চাইতে বেশি এতিম প্রতিপালন করে (বলেছেন আব্দুল হাই মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ, খতিব, মসজিদুল জুম’আ কমপ্লেক্স, পল্লবী, ঢাকা।) এতিম শিশুদের লালনপালনের বিষয়টি খুবই মানবিক বিষয় হওয়ায় বহু মানুষ বিশেষ করে যারা ধনশালী তারা এই মাদ্রাসাগুলোতে দান করে থাকেন। কেউ তাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চায় না। এতিমদের নাম করে যে বিপুল অর্থ উত্তোলন করা হয় তার কত ভাগ এতিমের পেছনে ব্যয় হয়, আর কতভাগ শিক্ষক-পরিচালকদের ভোগে যায় সে সংবাদ সংশ্লিষ্টরা যেমন জানেন তেমনি গণমাধ্যমের কল্যাণে যারা সেই বেড়াজালের বাইরে বাস করেন তাদেরও কমবেশি কানে আসে। এখানে কয়েকটি শিরোনাম উল্লেখ করছি।
১. এতিম লুটছে এতিমের খানা। (দৈনিক আমাদের সময় ১৯ আগস্ট ২০১৯)
২. রাজাপুর এতিমখানায় অনিয়ম- রাজাপুরে এতিমখানার নামে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো এতিমখানায় চার-পাঁচজন এতিম থাকলেও খাতাপত্রে রয়েছে ৩০/৩৫ এতিম শিশুর নাম। এই এতিম শিশুর নামে বরাদ্দ অর্থ ভাগ বাটোয়ারা করে খাচ্ছে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। (দৈনিক যুগান্তর ১৩ আগস্ট ২০১৮)।
৩. এতিম নাই তবু এতিমখানা। সরকারি বরাদ্দ হরিলুট। এতিম নেই, এতিমখানায় বরাদ্দ আছে। (ঢাকা ট্রিবিউন ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯)।
৪. এতিমের অর্থ কর্মকর্তাদের পেটে। প্রতিষ্ঠানের হিসাবে খাতায় ১০ জন ছাত্রের নাম দেখিয়ে ভুয়া খরচের ভাউচার তৈরি করলেও ছাত্রসংখ্যা মাত্র ৩জন। এভাবে আত্মসাৎ করা হয় এতিমের মুখের খাবার। এক বছরে ব্যাংক থেকে এতিম ছাত্রদের জন্য বরাদ্দকৃত ১ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা অধ্যক্ষসহ এতিমখানা পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে। এ ছাড়া এতিমদের জন্য বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠী প্রদত্ত সাহায্যের অর্থের কানাকড়িও জোটেনি এতিমদের কপালে। সব গেছে কর্মকর্তাদের পেটে। (দৈনিক কালেরকণ্ঠ, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯)
মাতা-পিতাহীন এতিমদের প্রতি সকল মানুষই দ্রয়ার্দ্র হবেন, সহানুভূতিশীল হবেন এটাই কাম্য। এতিমদের প্রতি দায়-দায়িত্ব সমাজের প্রত্যেক মানুষের আছে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রসুলের গৃহীত পন্থা কী? আসুন আমরা দেখি এতিমদের প্রতিপালন ও অধিকার রক্ষার জন্য আল্লাহর রসুল (সা.) কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি কি লিল্লাহ বোর্ডিং বা এতিমখানা বসিয়েছিলেন? তিনি কী ত্রাণ প্রকল্প চালু করেছিলেন? না। সামাজিক জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যাপারেও ইসলামের নীতি বর্তমানের ইসলামের নীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে শেষ নবী (দ.) প্রবর্তিত শেষ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে সামাজিক পর্যায়ে এতিমখানা, বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী প্রতিষ্ঠান, পঙ্গু-আবাস, প্রতিবন্ধী-আবাস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কোনই প্রয়োজন হবে না, কারণ, এ সমস্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই মহানবী (দ.) ঐ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন নি। যে এতিমদের সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তার কোর’আনে বহুবার উল্লেখ করেছেন; যে এতিমদের সম্বন্ধে বিশ্বনবী (দ.) এতবার বলেছেন; সেই ইয়াতীমদের জন্য একটি এতিমখানা তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না? যে বিস্ময়কর মহাকর্মী পৃথিবীতে একটা মহাশক্তি সৃষ্টি করলেন তার সামান্য একটি নির্দেশেই তো শত শত এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। তিনি তা করেন নি, তিনি দেখিয়ে দিলে এটা তাঁর সুন্নাহ নয়। তাঁর সুন্নাহ হচ্ছে আগে আল্লাহর দেওয়া সার্বভৌমত্ব জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য তিনি খেয়ে না খেয়ে, জীবন দিয়ে সংগ্রাম করে আগে এই কাজটিই করেছেন। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, যে জীবন ব্যবস্থা তিনি চালু করে গেলেন তা যদি মানুষ তাদের জীবনে চালু রাখে, বিকৃত না করে তবে ঐ সব জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানের কোনই প্রয়োজন হবে না, রাষ্ট্রই সেসব দায়িত্ব নেবে। তিনি জানতেন সকল অন্যায়-অবিচারের উৎস হচ্ছে ভুল সমাজব্যবস্থা, ভুল জীবনব্যবস্থার চর্চা। যদি শিকড় থেকে জাহেলিয়াতের সমাজব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলা যায় এবং তদস্থলে আল্লাহর নাজেল করা সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলেই সমাজে বাসকারী প্রত্যেকটি মানুষ ন্যায় ও সুবিচারের মধ্যে বাস করবে, সমাজের সকল সমস্যা দূর হবে। তাই রসুলাল্লাহ একটিও বৃদ্ধাশ্রম বা এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন নি, বরং তিনি এমন একটি মানবিক বোধে পরিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন যেখানে মানুষ অসহায়দেরকে পরিবারভুক্ত করে নিয়েছিল। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাড়ি থেকে দূরে বৃদ্ধাশ্রমের অনাত্মীয় পরিবেশে ফেলে আসার কথা তারা কল্পনাও করতে পারত না। একটি যুদ্ধরত জাতির মধ্যে স্বভাবতই এতিমের সংখ্যা ছিল প্রচুর এবং ক্রমবর্ধমান। তথাপিও এতিমরা কখনও অভিভাবকহারা হয়নি, অধিকারবঞ্চিত হয়নি। আমরা জানি, দুরারোগ্য কোনো ব্যাধি হলে অনেকসময় রোগীর চুল পড়ে যায়। আসল ব্যাধি নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা না করে যদি চুল পড়ার ওষুধ সেবন করা হয় তাহলে কি চুল পড়া আদৌ বন্ধ হবে? আর যদিও চুল পড়া হ্রাস পায়, তার দুরারোগ্য ব্যাধি তো রয়েই যাচ্ছে। তাই রসুলাল্লাহ সমাজদেহের সকল ব্যাধির উৎস যে ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা তাকেই নিখুঁত আল্লাহ প্রদত্ত দীন (System of life) দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছিলেন। পক্ষান্তরে জাহেলি ব্যবস্থা যদি চালু থাকে তাহলে প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটবে, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে, অন্যায় যুদ্ধ চলবে- আরো আরো বহু উপায়ে শিশুরা এতিম হতে থাকবে। এতিমখানা বানিয়ে কুলানো যাবে না। এজন্যই রসুলাল্লাহ দীন প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার দরুন অন্যান্য সকলের মতো এতিমরাও তাদের অধিকার লাভ করেছে।
ইসলামের স্বর্ণযুগে কোনো এতিমখানা ছিল না, আমাদের ভারতবর্ষেও সুলতানি যুগ মোঘল যুগেও এতিমখানা ছিল না; প্রয়োজন পড়েনি। শাসকরা, সমাজের ধনী মানুষেরা জনকল্যাণার্থে পথিকদের জন্য সরাইখানা, হাসপাতাল, মেহমানখানা, লংগরখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন, কুপ খনন করেছেন। দূর দূরান্তে যাতায়াতকারী মুসাফিরদের আজকের মতো হোটেলে পয়সা খরচ করে থাকতে হতো না, সরাইখানা-মেহমানখানাগুলোতে ধনী-নির্ধন সবাই সম্মানের সঙ্গে আপ্যায়িত হতেন। এই কাজে ব্যয় করাকে মুসলমানেরা দীনি কর্তব্য বলে মনে করতেন। স্থানীয় জনগণ সদকা হিসাবে এখানে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বা রোজগারের একটা অংশ দান করতেন। শাসকবর্গও দেখাশোনা করতেন। হালাকু খানের ধ্বংসযজ্ঞের পরেও মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এসব সরাইখানাগুলো গৌরবের সাথে কীভাবে ইসলামের মাহাত্ম্য ঘোষণা করেছে তা ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনী পড়লে জানা যায়। (Travels of Ibn Batuta – Samuel Lee, Dover Publications (December 17, 2004)
আফগান শাসক শেরশাহ ৯৫২ হিজরীতে দিল্লী থেকে লাহোরগামী সড়কে প্রতি দুই ক্রোশ পরপর সরাইখানা নির্মাণ করেন (তারিখে ফেরেশতা ২য় খণ্ড)। এছাড়া তারীখে ফেরেশতার বিবরণ অনুযায়ী শেরশাহ যখন গ্রান্ড ট্রাংক রোড নির্মাণ করেন তখন এই সড়কের পাশে প্রচুর সরাইখানা নির্মাণ করেন (তারিখে ফেরেশতা ১ম খণ্ড)। সোনারগাঁ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত এই সড়কে প্রায় তিনশো সরাইখানা ছিল। মুঘল সম্রাট আকবরও অনেক সরাইখানা নির্মাণ করেছিলেন (আইন-ই-আকবরী- আবুল ফজল)।
তাহলে আমাদের এলাকায় বর্তমানের মতো এতিমখানাগুলোর চল কী করে হলো? পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব ত্যাগ করে, ঐক্য নষ্ট করে, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেরা নিজেরা যখন কামড়া-কামড়ি করতে লাগল তখন আল্লাহর শাস্তি হিসাবে তারা ইউরোপের ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের কাছে সামরিকভাবে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলো। নতুন প্রভুরা, শাসকরা তাদের এসব উপনিবেশে নিজেদের দেশের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে লাগল। ঐ ইউরোপীয় খ্রিষ্টান প্রভুদের মূল লক্ষ্যই ছিল আমাদের সম্পদ লুণ্ঠন করা এবং জ্ঞানে শিক্ষায় সভ্যতায় এ জাতিকে দাস জাতির ন্যায় দীনহীন, নিকৃষ্ট, পরনির্ভরশীল, হীনম্মন্যতায় আপ্লুত করে দেওয়া। তারা সফলভাবে সেটাই করল। মুসলিম জাতিকে সর্বদিক থেকে হাজার বছর পশ্চাতে নিয়ে গেল। ইউরোপে এতিমখানা বা অরফানেজের চল রয়েছে। সেটার থেকে ধারণা নিয়ে এদেশের ধনী ব্যক্তিরাও মুসলিম এতিমদের জন্য এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করলেন। দানবীর হাজি মোহাম্মদ মুহসিনের কথা কে না জানে? তিনি তাঁর অঢেল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জনকল্যাণে উইল করে দে। এতো সম্পদের মালিক হয়েও মহসিন ছিলেন খুব ধার্মিক ও নিরহঙ্কারী। তিনি সর্বদা সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইমামবাড়া প্রাসাদে বাস করতেন না। বাস করতেন ইমামবাড়ার পাশে একটি ছোট কুটিরে। আর কোর’আন শরীফ নকল করে যা পেতেন তা দিয়েই নিজে চলতেন। নিজ হাতে রান্না করে অধিনস্থদের নিয়ে বসে খেতেন। এই নিঃস্বার্থ-পরায়ণতা ও মানসসেবার প্রেরণা তিনি নিঃসন্দেহে ইসলাম থেকেই পেয়েছেন। এ ধরনের ব্যক্তিদের দানেই প্রাথমিকভাবে এতিমখানার মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এমনই আরেকজন দানবীর ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। পরে বিভিন্ন এলাকায় এসব এতিমখানা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এতিমদের জীবিকা হাসিলের পন্থা হিসাবে সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার অনুকরণে স্বল্পতম ব্যয়ে এমন শিক্ষা দেওয়া শুরু হলো যাতে তারাও কোর’আন খতম, তারাবি, নামাজ পড়ানো ইত্যাদি কাজ করে খেতে পারে। ব্রিটিশরা তো ব্যস্ত সম্পদ পাচারে। অত্র অঞ্চলের ধনবান এমন কি রাজা, জমিদারদেরকেও তারা পথের ফকির বানিয়ে ছেড়েছে সেখানে এতিমদের ভরণপোষণের দিকে তাদের মনোনিবেশ করার অবসর কোথায়? এ জাতীয় বিষয়গুলোকে তারা ছেড়ে দিল ধর্মানুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়ে ধনী সম্প্রদায়ের দান আর ওয়াকফের উপর। দুর্ভাগ্যবশত পরে মাদ্রাসাশিক্ষিত ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটি এই এতিমখানাগুলোকেও তাদের ধর্মব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত করল। আল্লাহ স্বয়ং যে এতিমদের সম্মান করার হুকুম দিয়েছেন সেই এতিমদের নাম ভাঙিয়ে তোলা অর্থ লুটে খাওয়ার চেয়ে নিকৃষ্ট আর অসম্মানজনক কাজ আর কিছু নেই।
পাঠক, এই প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলার একটি উদ্দেশ্য আছে। এতিমখানা বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয় যেটি মানুষের মানবিকতার উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হয়। পাশাপাশি সরকারের কিছু বরাদ্দও থাকে এতিমদের জন্য। কিন্তু যদি কেউ এতিমদের প্রতি মানুষের এই কোমল অনুভূতিকে পুঁজি করে এতিমের টাকা লুটে খায় তাহলে তাদের বিষয়ে ইসলামের কী সিদ্ধান্ত? এরকম দুর্নীতির প্রসঙ্গ নিয়ে মাদ্রাসার বিরুদ্ধাচার কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য না। কিন্তু কথা হচ্ছে এর ব্যবহার নিয়ে, এর উদ্দেশ্য নিয়ে। এখন বিষয়টা আর মানবিক পর্যায় নেই, ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। এতিমখানাগুলো ধর্মব্যবসায়ের একটি শাখা হিসাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে, এখানে ধর্মীয় অনুভূতিকে, সেন্টিমেন্টটাকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করা হচ্ছে। বহু এতিম বঞ্চিত হচ্ছে যার কিছু উদাহরণ ইতঃপূর্বে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় যারা এতিমের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, তারা নিজেদের উদরে আগুন ভিন্ন আর কিছুই পুরে না; সত্বরই তারা জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।” (আল কোর’আন: সুরা নিসা ১০)
পাঠক লক্ষ করুন, আল্লাহ এতিমের সম্পদ ভক্ষণকে কীসের সঙ্গে তুলনা করলেন। তিনি তুলনা করলেন আগুন খাওয়ার সঙ্গে। ঠিক এই একই কথা আল্লাহ বলেছেন ধর্মব্যবসা অর্থাৎ দীনের বিনিময়ে পার্থিব সম্পদ গ্রহণের ক্ষেত্রে। এ আয়াতে আল্লাহ বলেন,“বস্তুত, যারা আল্লাহ কেতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঢুকায় না।” (সুরা বাকারা ১৭৪)। সোবাহান-আল্লাহ। আল্লাহ সোবাহান, নিখুঁত ও পবিত্র। তিনি জানেন কোন শ্রেণির লোকেরা এতিমদের নাম ব্যবহার করে সম্পদ লুণ্ঠন করবে। তাই তিনি দীনের বিনিময়গ্রহণকারীর যে শাস্তি অর্থাৎ আগুন খাওয়া, এতিমদের সম্পদ ভক্ষণকারীর জন্যও সেই একই শাস্তি আগুন খাওয়াকে ঘোষণা করে দিলেন এবং বলে দিলেন এদেরকে কখনও ক্ষমা করা হবে না। কী ভয়াবহ! পাঠককে বিষয়টি আবারো চিন্তা করার অনুরোধ রইল।
কোর’আনে এতিম শব্দটি ২৩ বার ব্যবহৃত হয়েছে এবং প্রত্যেকবার আল্লাহ করুণাভরে তাদের কথা উচ্চারণ করেছেন। সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও এতিমদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে যে, তারা কিরূপে ব্যয় করবে? তুমি বল, তোমরা ধন-সম্পদ হতে যা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকীন ও পথিকদের জন্য কর।” (সুরা বাকারা ২১৫)
এতিমদের অসম্মান করাকে আল্লাহ মানুষের মন্দ স্বভাব হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘কখনোই নয়। বস্তুত তোমরা এতিমকে সম্মান কর না এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না (সুরা ফাজর ১৭-১৮)। এখানে ‘সম্মান করা’ কথাটি বলার মাধ্যমে এতিমের যথাযথ হক আদায় করা ও তার প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার প্রতি এতিমের অভিভাবক ও সমাজের প্রতি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ রসুলাল্লাহর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে সর্বযুগের সকল এতিমের প্রতি সদয় হওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেন, “তিনি কি আপনাকে এতিমরূপে পাননি? অতঃপর আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা, অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন। আপনাকে নিঃস্ব পেয়েছেন, অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন। সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না (সুরা দোহা ৬-৯)।
সমাজে, রাষ্ট্রে আল্লাহর নাজেল করা হুকুম বিধান প্রতিষ্ঠা না করে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করে ধার্মিকতা প্রদর্শন নিষ্ফল। কেননা আজকে এতিমখানাগুলো যতটা না মানবিক ও ধর্মীয় নির্দেশ পালনার্থে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি করা হচ্ছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে। এটা বর্তমানে ধর্মব্যবসারই আরেকটি শাখায় পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায়, যেহেতু এই এতিম অসহায় মানুষের প্রতি সকলের দায়িত্ব রয়েছে তাই এদের দায়িত্ব ধর্মব্যবসায়ী, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রের সরাসরি তত্ত্বাবধানে আনা উচিত। প্রকৃত ইসলামের যুগে এতিমদের দায়িত্ব রাষ্ট্রই বহন করত যেটা ইতোপূর্বে বলে এসেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও একই প্রস্তাবনা রেখে এতিমখানা প্রসঙ্গে এখানেই ইতি টানছি।