মোহাম্মদ আসাদ আলী:
ডিসেম্বর মাস হচ্ছে বিজয়ের মাস, গৌরবের মাস। প্রতি বছর এই মাসটি স্মরণ করিয়ে দেয় দেশের জন্য মানুষের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা কী অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। তাঁদের সেই আত্মত্যাগের বিনিময়েই আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক পরিচয় দিতে পারছি। তাঁরা যদি সেদিন নিজেদের সমস্ত মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারতেন তাহলে আমাদের ইতিহাস হয়তো গৌরবের হতো না, শোচনীয় হতো। এই যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, এটা কিন্তু মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। তা সম্ভব হয়েছে কেবল এই কারণে যে, তাঁরা তাঁদের জাতীয় সঙ্কটকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যদি তৎকালীন মূল সঙ্কট তাঁরা উপলব্ধি করতে না পারতেন, এ ব্যাপারে তাঁদের মনে ধোঁয়াশাভাব থাকত, তাহলে স্বাধীনতার প্রশ্নে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত না। বস্তুত সমকালীন সঙ্কটকে উপলব্ধি করতে পারাই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বাধীনতার পূর্বে আমাদের মূল সঙ্কট কী ছিল? শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য, অশিক্ষা, দারিদ্র্য ইত্যাদি। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা আমাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করত। এতবড় একটি জনগোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করে সুযোগ-সুবিধা তারা নিজেদের করে নিতো। আমাদের কর্মক্ষম বিশাল জনশক্তি ছিল, আমাদের যথেষ্ট উৎপাদন ছিল, কিন্তু দিনশেষে দেখা যেত পূর্ব পাকিস্তানের জীবনমানের কোনো উন্নয়ন নেই। একই দেশের নাগরিক হওয়া সত্তে¡ও আমাদেরকে বসবাস করতে হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হতে লাগল।
চিন্তাশীল মানুষ লেখার মাধ্যমে, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বক্তৃতার মাধ্যমে জাতিকে সচেতন করতে লাগলেন। বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার বুঝে নিতে প্রেরণা যোগালেন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মত অবিসংবাদিত নেতৃত্ব জাতির মনে আকাশচুম্বী সাহসের সঞ্চার করল। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণে বাঙালি বুঝে গেল এখন তাদের শত্রু কে, মুক্তি কোথায় ও করণীয় কী। রক্তসাগর পাড়ি দিয়ে হলেও দেশকে স্বাধীন করা হলো। সঙ্কটের অবসান ঘটল।
কিন্তু আজ ২০১৭ সাল। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৪৬টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে পদ্মা, মেঘনায় গড়িয়ে গেছে বহু জল। দারিদ্র্য এখন আর সর্বপ্রধান সঙ্কট নয়। প্রতিনিয়ত গ্রামে-গঞ্জে পাকা দালান উঠছে। ঘরের কাছে ব্যাংক হয়েছে, বুথ হয়েছে। রাস্তা পাকা হয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যুৎ এসেছে। ঘর ঘরে চলছে টিভি, শোভা পাচ্ছে ফ্রিজ, দামী আসবাবপত্র। হাতে হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট। ডিশ এন্টেনার সংযোগ সর্বত্র। সাইকেল বেচে কেনা হচ্ছে মোটর সাইকেল। পায়ে ঠেলা ভ্যানের দখল নিচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, সিএনজি। না খেয়ে রাত পার করে এমন মানুষ আজ চোখে পড়া দায়। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি না করেও স্ত্রী-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার মতো অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। দেশে কর্মসংস্থান খুঁজে না পেলে মানুষ প্রবাসে চলে যাচ্ছে। প্রায় এক কোটি তরুণ বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। হাজার খোঁজাখুঁজি করেও ক্ষেতের শ্রমিক পাওয়া যায় না। বাচ্চারা এখন বাঁশের পাতার নৌকা খেলে না, তারা খেলছে ব্যাটারিচালিত রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি, হেলিকপ্টার নিয়ে। অর্থাৎ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমরা কিছুটা হলেও সফল হয়েছি। কিন্তু এরই মধ্যে জন্ম নিয়েছে হাজারো নতুন সঙ্কটের। বলা চলে, ইতিহাসের সবচাইতে অনিরাপদ সময় অতিক্রম করছি আমরা। আমাদের এই নতুন সংকটসমূহ যদি আমরা উপলব্ধিই করতে না পারি, তাহলে তাকে মোকাবেলার প্রশ্নই উঠে না।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি আমাদের সামাজিক অপরাধ ধাঁই ধাঁই করে বেড়েছে। বর্তমানে তা রীতিমতো মহামারীর রূপ নিয়েছে। সামান্য স্বার্থের বশবর্তী হয়ে মানুষ পাশবিক আচরণ করতে দ্বিধা করছে না। বাবা সন্তানকে গলাটিপে মারছে। সন্তান বাবার গলায় ছুরি চালাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে খুন, ধর্ষণ, ব্যাভিচার প্রতারণা, জালিয়াতি। অফিস, আদালত, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ তো বটেই, এমনকি নিজ বেডরুমেও মানুষ নিরাপত্তাবোধ করে না। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অজানা আতঙ্ক, অজানা আশঙ্কা মানুষের নিত্যসঙ্গী। ছোট ছোট শিশুদেরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে, গলা কেটে, শ্বাসরোধ করে, ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হচ্ছে। নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি অপরাধ শত আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না। শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। রক্ষকরা হয়ে উঠছে ভক্ষক। দুর্নীতি, প্রতারণা আর শঠতার মধ্য দিয়ে কে কাকে ঠকিয়ে, কিভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ লুট করে নিজে লাভবান হতে পারে সেই চেষ্টা করছে। সমাজের দুর্নীতিবাজ, খারাপ মানুষগুলো নেতৃত্বের আসনে আসছে। রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার সম্পদ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে।
এ তো গেল একটা দিক। অন্যদিকে রাজনৈতিক কোন্দল যেন এক চিরাচরিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর আমাদের গত ৪৬ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস জাতির মধ্যে অনৈক্য, রক্তারক্তি, হানাহানি আর ক্ষমতার কামড়াকামড়ির ইতিহাস। গণতন্ত্রের নামে, সমাজতন্ত্রের নামে এক জাতিবিনাশী খেলা চলছে। রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল মানবতার কল্যাণে, কিন্তু তার বদলে রাজনীতির নামে আমরা যেটা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি সেটাকে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর ‘নৈতিকতাবর্জিত ক্ষমতার লড়াই’ বলা ছাড়া অন্য কোনো নামে অভিহিত করা যায় না। এই অপরাজনীতি একটি দিনের জন্যও জাতিকে শান্তিতে থাকতে দেয় নি, ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেয় নি। আরেকদিকে ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের নামে বিভিন্ন মত-পথ, দল-উপদল, ফেরকা সৃষ্টি করে জাতির ঐক্য নষ্ট করে চলেছে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে বারবার ভুল খাতে প্রবাহিত করছে এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে জাতিকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। মানুষে মানুষে, সম্প্রদায়ে সম্প্র্রদায়ে বিদ্বেষ ও ঘৃণার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে নতুন বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘সন্ত্রাসবাদ’। এই সন্ত্রাসবাদ যেখানেই গিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদও সেখানে গিয়েছে এবং কিছুকালের মধ্যেই সেই দেশকে গণকবর বানিয়ে ছেড়েছে। সিরিয়া, লিবিয়ার শুরুটা কিন্তু এভাবেই হয়েছিল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসবাদের অনুপ্রবেশ, অতঃপর সাম্রাজ্যবাদীদের রঙ্গমঞ্চ হয়ে ওঠা। কে বাংলাদেশকে সেই পথ থেকে সরাবে? কে এই ধান্দাবাজির রাজনীতিতে যবনিকাপাত টানবে? কে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে মানুষের ঈমানকে ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করবে? কে সকল ধর্মের মানুষকে দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত করে ঐক্যবদ্ধ করবে? কে মানুষকে আত্মাহীন বস্তুবাদী সভ্যতার করাল গ্রাস থেকে উদ্ধার করে নৈতিক গুণসম্পন্ন মানবিক মানুষে পরিণত করবে? আবারও বলছি, ৪৬টি বছর পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও পাল্টে গেছে অনেকখানি। প্রতি মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সামরিক শক্তির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সীমান্তে সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে, রাষ্ট্রনায়করা একে অপরের সাথে হুমকির ভাষায় কথা বলছেন। আঞ্চলিক ভূরাজনীতিও আগের জায়গায় নেই। এক সময় মনে হত সবাই বুঝি বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ভিন্ন হিসাব নিকাশ। প্রত্যেকটি রাষ্ট্র তাদের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
এমতাবস্থায়, ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে ভূখণ্ডটি অর্জন করেছি, সেটার নিরাপত্তা নিয়ে আমরা ভাবছি তো? আমরা যদি যুগের এই সঙ্কটগুলো উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই, এগুলোর সমাধান করতে না পারি, তাহলে কেবল দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন করে কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ করে জাতিকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহলসহ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত প্রত্যেককে উপলব্ধি করতে হবে, ১৯৭১ এর বাস্তবতা আর ২০১৭ এর বাস্তবতা এক নয়। তখনকার সঙ্কট আর আজকের সঙ্কটও এক নয়। আমাদের বর্তমান সঙ্কটকে যদি আমরা উপলব্ধি করতে না পারি তাহলে একাত্তরের অর্জনকে ধরে রাখায় আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।