মো. মোস্তাফিজুর রহমান শিহাব:
বর্তমান সমাজে অনেক মানুষই পাশ্চাত্যের অনুকরণে ধর্মহীনতার চর্চার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। কিন্তু একজন মানুষ কী সত্যিই সম্পূর্ণভাবে ধর্মহীন হতে পারে?
আলোচনার শুরুতেই ধর্ম কি তা বলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি। কারণ বর্তমানে মানুষ ধর্ম বলতে শুধু মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডায় গিয়ে নামায, রোযা, পূজা, প্রার্থনা ইত্যাদিকে মনে করে। কিন্তু ধর্ম শুধু কোন আনুষ্ঠানিকতা পালন নয়। সত্যিকার অর্থে ধর্ম হচ্ছে কোনো আদর্শ বা বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করা এবং কর্মে ও আচরণে তা প্রকাশ করা। উদাহারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি আগুন, যার ধর্মই হচ্ছে পোড়ানো। কোনো দাহ্য পদার্থ পেলেই আগুন তা পুড়িয়ে দেয়, এভাবে সে তার ধর্ম প্রকাশ করে। ধর্মের এই সংজ্ঞাই বলে দেয় একজন মানুষ কখনোই সম্পূর্ণভাবে ধর্মহীন হতে পারে না। কারণ তাকে ভালো অথবা মন্দ, সত্য অথবা মিথ্যা যে কোন একটি আদর্শ ধারণ করতেই হয়। তবুও তর্কের খাতিরে ধরে নিই একজন মানুষ আল্লাহতে অর্থাৎ স্রষ্টাতে অবিশ্বাসী। সে স্রষ্টাকে বিশ্বাস করেন না। তার কাছে বস্তুতান্ত্রিক ধর্মহীন মতবাদই মুখ্য। সে সর্বদা নিজেকে ধর্মের বিষয়গুলো থেকে দূরে রাখতে চায়। কিন্তু সে তার পর্থিব জীবনে মিথ্যা, অন্যায়, অশ্লীলতা ইত্যাদি খারাপ বিষয়গুলোকে ঘৃণা করে। অন্যের খারাপ আচরণ ও কর্মে সেও ব্যথিত হয়, আবার অন্যের ভালো আচরণে ও সৎকর্মে সে আনন্দিত হয়। এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ একজন ধর্মহীন ব্যক্তি যদি কারো সাথে অন্যায়, অবিচার করে, খারাপ আচরণ করে ঐ ব্যক্তির যেমন খারাপ লাগবে ঠিক তেমনি ঐ ধর্মহীন ব্যক্তির সাথেও যদি কেউ অন্যায় করে, অবিচার করে তখন তারও ঠিক তেমনি খারাপ লাগবে। একইভাবে কেউ একজন ধর্মহীন ব্যক্তির সাথে ভালো আচরণ করলে, তার উপকার করলে তার ভালো লাগবে। খারাপ কাজ করার পর একজন ধার্মিক যেমন অনুতপ্ত হন ঠিক তেমনিভাবে একজন ধর্মহীনও তার মন্দকাজের জন্য অনুতপ্ত হন। এই যে ভালো কাজে ভালো লাগা আর মন্দ কাজে মন্দ লাগার বা অনুতপ্ত হওয়ার উপলব্ধি, এটাই বিবেক।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায় তার মধ্যকার এ অনুতাপের কারণ কী? তার মধ্যকার এ সংশয় কোথা থেকে আসলো? এর জবাব দেয়ার পূর্বে বলা প্রয়োজন যে, মানুষ স্রষ্টাকে অবিশ্বাস করতে পারলেও কখনই তাঁর প্রদত্ত সেই মন্দ লাগা ভালো লাগার অনুভূতিকে অর্থাৎ বিবেককে অস্বীকার করতে পারবে না। এই বিবেকের কথা স্রষ্টা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সেই আদম থেকে শুরু করে শেষ রসুল হযরত মোহাম্মাদ (দ:) সবার মাধ্যমেই জানিয়েছেন। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই স্রষ্টা সৎকাজের আদেশ ও মন্দকাজে নিষেধ করেছেন। ধর্মহীনদের ভালো কাজে ভালো লাগার অনুভূতি আর মন্দ কাজে মন্দ লাগার অনুভূতির প্রধান কারণ হলো মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে স্রষ্টার দেওয়া সেই বিবেক বিদ্যমান। যারা নিজেদেরকে ধর্মহীন মনে করে তারা মূলত স্রষ্টাকে অবিশ্বাস করে কিন্তু তারা নিজেরা কখনই স্রষ্টাকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারে না কারণ ঐ বিবেক আমৃত্যু তার সাথেই থাকে।
কিভাবে স্রষ্টার সেই বিবেক মানুষের মধ্যে আসলো? স্বাভাবিকভাবেই ধর্মহীনদের মনে এই প্রশ্ন জাগতে পারে। পবিত্র কোর’আনের সুরা হিজরের ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মানুষের মধ্যে আল্লাহ নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। অর্থাৎ মানুষের মাঝে আল্লাহর রুহ বিদ্যমান। যা মানুষকে ঐ বিবেক দান করে। এজন্য দেখবেন একটি পশুর মানুষের মতো ঐ বিবেক বা মূল্যবোধ থাকে না। ক্ষুধা লাগলে সে তার সন্তানকেও খেয়ে ফেলে। এটার কারণ হল পশুর মধ্যে আল্লাহর রুহ নেই, সেই বিবেক নেই। আর একজন মানুষ সে ধর্মে বিশ্বাসীই হোক আর ধর্মে অবিশ্বাসীই হোক তার মাঝে আল্লাহ্র রুহ থাকায় সে যতই আল্লাহ অর্থাৎ স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাস স্থাপন করুক না কেন সে কখনই তার মধ্যকার মূল্যবোধ, বিবেক ইত্যাদির থেকে মুক্ত হতে পারে না। তাকে এগুলোর বন্ধনে আবদ্ধ থাকতেই হয়। এ ব্যাপারগুলোই ধর্মের অংশ। কারণ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধর্ম মানুষকে শালীনতা, মূল্যবোধ, সততা ইত্যাদি গুণাবলীর শিক্ষা দিয়ে আসছে। মানুষের মধ্যকার স্রষ্টার এই অংশ তাকে সবসময় অন্যায় থেকে বিরত রাখে। সে এগুলোকে চর্চা করে ও এগুলো মাধ্যমে নিজের জীবনকে বিকাশিত করে। এ প্রতিটি বিষয় এসেছে ধর্মের থেকে। আর ধর্ম মানেই স্রষ্টার অস্তিত্ব।