মো. আসাদ আলী
প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় আর পত্রিকায় শিরোনাম হয় ‘পাস করতে না পারায় তিন/চার/পাঁচ কিশোরীর আত্মহত্যা’। আমি ‘কিশোর’ না লিখে সচেতনভাবেই ‘কিশোরী’ শব্দটা লিখলাম কারণ এই প্রবণতা কিশোরীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করে আদু ভাইয়ের মত দুই/চার বছর একই ক্লাসে পড়ে থাকতে পারার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে পুরুষরা জন্মগ্রহণ করে। নারীর ক্ষেত্রে তা হয় না। তাদের কুসুমকোমল হৃদয় শক্ত আঘাত নিতে পারে না, সহজেই কাহিল হয়ে পড়ে। তখন নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মত নিজের জীবন ধ্বংস করে হলেও অন্যদের অপরাধের প্রতিশোধ নেয় তার অভিমানী মন।
অবশ্য এটাও ঠিক যে, কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট না হলে কিশোরদের যে পরিমাণ হেনস্থার শিকার হতে হয়, কিশোরীদের হতে হয় তার কয়েক গুণ বেশি। এমনিতেই ছেলেরা সাত খুন মাফ পেয়ে যায়। মেয়েদের বেলায় পদে পদে কাঁটা। খারাপ রেজাল্ট করা ছেলেকে প্রথমে থাপ্পড় দিয়ে বাড়ি ছাড়া করলেও একটুপরেই খুঁজে আনা হয়। কোথাও চিরদিনের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হয় না। কিন্তু হতভাগা মেয়েদের বেলায় যেন ভেঙে যায় সমস্ত ধৈর্যের বাধ। একটা ছেলে খুঁজে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চিরদিনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়ি। অনেকে বলবেন, শ্বশুরবাড়ি যাওয়া কি খারাপ কিছু? না, অবশ্যই খারাপ কিছু নয়, তবে ফেল করার শাস্তিস্বরূপ বিয়ে দিয়ে শশুরবাড়িতে নির্বাসন দেওয়াটা অগ্রহণযোগ্য। এমনিতেই এই বয়সী মেয়েদের চাল-চলন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, ঘোরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে আমাদের সমাজে একটা ট্যাবু কাজ করে। এরা হাসলেও সমস্যা, কাঁদলেও সমস্যা। জোরে কথা বললেও সমস্যা, আস্তে কথা বললেও সমস্যা। এই অবস্থায় যখন তাদের কেউ পরীক্ষায় ফেল করে তখন এক শ্রেণির পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মুখে পরনিন্দার তুবড়ি ছুটতে থাকে। সামান্য একটি পরীক্ষার ফলাফলকে কেন্দ্র করে একটি মেয়েকে যেভাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তাতে মনে হতেই পারে, পরীক্ষার ব্যর্থতার সাথেই তার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন, আশা, আকাক্সক্ষা ও মমতার জায়গাগুলো আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে, হতাশা আর গ্লানিই তার জীবনের একমাত্র সম্বল!
সেই আপত্তিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে যারা বিপত্তি বাঁধিয়ে বসে তাদের জন্য কিছু কথা। তোমাদের কাছে যদি মনে হয় স্রষ্টা মানুষ নামক আশরাফুল মাখলুকাতকে নিছক ‘এসএসসি পরীক্ষায় পাস করার জন্য’ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, এর চাইতে মহৎ কোনো লক্ষ্য বা এর চাইতে বড় কোনো অর্জন মানুষের হতে পারে না, তাহলে একজন অকৃতকার্য শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে শেষ করে দিতে পারো- আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ যে কাজের জন্য কোনোকিছু তৈরি করা হয় সেটাই মুখ্য বিষয়। ওই বস্তুকে দিয়ে ওই কাজ না হলে তা অর্থহীন হয়ে যায়। ব্লু হোয়েল গেমের উদ্ভাবক নাকি বলেছিল- ‘যারা এই গেম খেলে আত্মহত্যা করেছে তারা সমাজের জঞ্জাল। এদের আগেভাগে মরে যাওয়াই ভালো।’ কথাটা আমার যথেষ্ট ভালো লেগেছে। তোমাদের কাছে জীবনকে এতই ঠুনকো বিষয় মনে হলে জঞ্জালের মতই সাফ হয়ে যাও, জগৎ পরিশুদ্ধ হোক।
আর যদি মনে কর যে- না আমি সমাজের জঞ্জাল নই। আমি মানুষ। সৃষ্টির সেরা আমি। আমার জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য আছে, লক্ষ্য আছে। বৃক্ষের সফলতা যেমন ফলদানে, সূর্যের সফলতা আলো প্রদানে, তেমনি মানুষের সফলতা মানবতার কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারায়। এইসব স্কুল-কলেজ ইত্যাদি আমার জীবনের আনুষঙ্গিকতা মাত্র, জীবনের সারবস্তু মোটেও নয়। আমাদের দেশকে যারা যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছিলেন তাদের সবাই মেধাবী এ প্লাসপ্রাপ্ত ছাত্র ছিলেন না, তবু তারা আমাদের জাতীয় বীর। আমাদের আখেরী নবী মোহাম্মদ (সা.) লেখাপড়াই জানতেন না, তবু তিনি সমস্ত বিশ্বজাহানের নয়নের মনি, কোটি মানুষের আলোকবর্তিকা। মানুষ শিক্ষিত হয় তাঁর জীবনী পড়ে। যদি এই বোধ তোমাদের থাকে তাহলে বলব- খবরদার! কারো কথায় কান দিবে না। কেবল শপথ নাও- এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে/ এই দিনেরে নিয়ে যাব সেই দিনেরও কাছে।