মোহাম্মদ আসাদ আলী
মুসলমানদের মধ্যে বর্তমানে যে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরি হয়েছে, তার পেছনের ইতিহাস খুঁড়তে গেলে ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করতে হয়। ঔপনিবেশিক যুগে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা আটলান্টিকের তীর থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বকেই সামরিক শক্তিবলে দখল করে, জোর করে কয়েকশ’ বছর শাসন-শোষণ করে এবং তা করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের রক্ত ঝরায়, মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়, অত্যাচার-উৎপীড়নের স্টিম রোলার চালায়। এরপর থেকে মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডগুলোর রক্তের দাগ আর শুকোয়নি। ইতিহাসের পাতা পুনঃপুনঃ রঞ্জিত হয়েছে কেবল মুসলমানের রক্তে।
ইহুদি, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু যারাই এই জাতিকে হাতের কাছে পেয়েছে, এদেরকে নিশ্চিহ্ন করার উন্মত্ত নেশায় মেতে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ঠুনকো অজুহাতে হামলা করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে গণকবর বানিয়ে ফেলেছে, কিন্তু জাতিসংঘসহ মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা সামান্য হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজনবোধ করেননি, অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তারা নিহতদের তালিকা শুধু হালনাগাদ করে গেছেন।
কত চিৎকার চেঁচামেচি, কত আহাজারি আর্তনাদ, কত নির্যাতিতের ফরিয়াদ! সব ব্যর্থ হয়েছে, বিচার চেয়েও পাওয়া যায়নি। জঙ্গলের হরিণ হত্যা করলে, খরগোশ হত্যা করলে বিচার পাওয়া যায়, মুসলমানদের পুরো দেশ ধ্বংস করে ফেললেও বিচার হয় না, গণহত্যার পর কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। এভাবে সমস্ত পৃথিবীর অবহেলা, বঞ্ছনা আর শত্রæতার কষাঘাতে জর্জরিত মুসলিমদের পিঠ আজ দেয়ালে ঠেসা পৃথিবীর বাতাস ভারি হয়ে গেছে নির্যাতিত মুসলমানের দীর্ঘশ্বাসে, কান পাতলেই বাতাসে নিষ্পাপ শিশুর আর্তচিৎকার শোনা যায়। মুসলিম নারীদের উপর যে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
এই নির্মম চিত্র দেখে কার না হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়? কার না হৃদয়ে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে? এই বিক্ষুব্ধতা থেকেই জন্ম নিয়েছে ইসলামের নামে চরমপন্থা তথা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড! পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সার্থকতা হচ্ছে তারা ওই বিক্ষুব্ধ মুসলমানের ঈমানকে অতি কৌশলে ইসলামের বিরুদ্ধেই কাজে লাগাতে সক্ষম হচ্ছে।
আফগানিস্তান ধ্বংসের পর তালেবান ও আল কায়েদার উত্থান হলো। বিশ্বের দেশে দেশে মাথাচাড়া দিল জঙ্গিবাদ। দ্বিতীয় দফায় ইরাক/সিরিয়া/লিবিয়া ধ্বংসের পর আইএসের উত্থান হলো। জঙ্গিবাদের পালে আবারও লাগল দমকা হাওয়া। এভাবে খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, যেখানেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ঘাঁটি গাড়ে সেখানেই উগ্রপন্থার বিস্তার হয়, কেন হয়? এর কারণ বুঝতে পণ্ডিত হবার প্রয়োজন পড়ে না। জঙ্গিবাদী দলগুলোকে অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ দিয়ে তাজা রাখে কারা- তা এখন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানেন ও বোঝেন। আর তাতে কার কী ফায়দা তাও পরিষ্কার।
জঙ্গিরা ভাবে তারা প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিতাল করে আল্লাহ ও রসুলকে খুশি করছে। উম্মাহর বীর সন্তানের দায়িত্ব পালন করছে। আদতে তারা সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসী নীলনকশা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিচ্ছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে পুরো মুসলিম দুনিয়াকে। প্রথমে সন্ত্রাসের উত্থান ঘটানো, তারপর সন্ত্রাসবাদের অপবাদ দিয়ে মুসলিমদের জীবন বিপন্ন করে তোলা- একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন হয়ে আসছে দেশে দেশে। সেই দেখে আরও হাজার হাজার তরুণ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে সন্ত্রাসের দিকে ধাবিত হচ্ছে, বাড়ছে লাশের সারি আর ধ্বংসের স্তুপ।
এদিকে সমস্তকিছুর দায়ভার পড়ছে ইসলামের ওপর, পবিত্র কোর’আনের ওপর। সাম্রাজ্যবাদীদের সফলতা এখানেই, তারা একই সাথে মুসলিমদের ধ্বংস করতে পারছে এবং ইসলামকেও বিতর্কিত করে তুলতে পারছে। যার ফলে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে এই জাতির নবজাগরণের শেষ সম্ভাবনাটুকুও।