রিয়াদুল হাসান:
রসুলাল্লাহকে (দ:) মে’রাজে নিয়ে আল্লাহ তাকে স্থান ও কালের বিকৃতি (Dimension of Time and Space) থেকে মুক্ত কোরেছিলেন। তাই অতীত ও ভবিষ্যতের যতটুকু তাকে জানিয়েছিলেন তাতেই তার উম্মাহর ভবিষ্যতের অনেক কিছুই তিনি জানতে পেরেছিলেন। তার ওফাতের ত্রিশ বছর পর খেলাফত পরিত্যক্ত হোয়ে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে পরিণত হবে তা তিনি জানতেন, বোলেও গেছেন এবং তা যে সত্য হোয়েছে তা ইতিহাস- ঠিক ত্রিশ বছর পরে মুয়াবিয়ার (রা:) ছেলে ব্যপের পর খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হোল। জাতির মধ্যে এই বিকৃতি একদিনে আসে নি। সর্বপ্রথম রসুলাল্লাহর আদর্শ বিচ্যুত হোয়েছেন এ জাতির নেতৃত্ব। আল্লাহর রসুল বোলছেন- তোমরা কি জান, ইসলামকে কিসে ধ্বংস কোরবে? এই প্রশ্ন কোরে তিনি নিজেই জবাব দিচ্ছেন- শিক্ষিতদের ভুল, মোনাফেকদের বিতর্ক এবং নেতাদের ভুল সিদ্ধান্ত (মেশকাত)। একটি ঘটনায় এ বিকৃতির প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাই।
আলী (রা:)-এর খেলাফতের আমল। তার ভাই আকিল একদিন এসে বোললেন: ‘আমি বড় অভাবে পোড়েছি, আামাকে সাহায্য দিন’।
আলী (রা:): ‘একটু সবুর, ভাই আমার মাসোহারাটা আসুক’।
খলিফাসহ যাদেরকে প্রশাসনিক কাজে সার্বক্ষণিকভাবে ব্যস্ত থাকতে হোত, তাদের জীবনধারণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা বরাদ্দ ছিল। আকিল বোললেন,
‘হুকুম পাঠিয়ে আপনার মাসোহারাটা আগেই আনিয়ে নিন’।
আলী (রা:): তা হয় না। খলীফার মাসোহারাও অন্যান্য সকলের মাসোহারার সঙ্গেই আসবে।
আকিল-বায়তুল মাল হোতে কিছু দিয়ে দিন।
আলী (রা:): বায়তুল মাল গরীব-দুঃখীর জন্য। তোমার-আমার জন্য নয়। আর কয়েকদিন অপেক্ষা করো। মাসোহারাটা পেয়ে নেই।
আকিল- কিন্তু আমি তো অতো দেরি কোরতে পারবো না। এখনই একটা কিছু ব্যবস্থা কোরে দিতে হবে।
আলী (রা:) বেশ, একটা লোক সাথে দিই, সে বাজারে গিয়ে একটা দোকান ঘর দেখিয়ে দিক, তুমি তালা ভেঙ্গে কিছু নিয়ে এসো।
আকিল- বটে! তবে আপনি আমাকে চুরি কোরতে বলেন?
আলী (রা:) আর দেশের তহবিল ভেঙ্গে তোমাকে অর্থ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তুমি আমাকে খুব সাধু হবার পরামর্শ দিচ্ছো!
আকিল- আমি আজই মোয়াবিয়ার কাছে রওয়ানা হোয়ে যাবো। তখন খুব ভালো হবে তো?
আলী (রা:)- তোমার ইচ্ছা যদি হয়- অনায়াসে যেতে পারো।
আকিল- বেশ, তবে তাই চোললাম।
আল্লাহর রসুল একজন নেতার অধীনে একটি লোহার মতো ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি রেখে বিদায় নিয়েছিলেন এবং এই ঐক্যকে যে কোন মূল্যের বিনিময়ে আঁকড়ে ধোরে রাখতে হুকুম দিয়েছিলেন এবং ঐক্য নষ্টের ব্যাপারে চূড়ান্ত সতর্কবাণী উচ্চারণ কোরেছেন যে ঐক্যভঙ্গ করা কুফর অর্থাৎ যারা ঐক্য নষ্ট করে তারা কাফের। কিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানের (রা:) সময় জাতির ঐক্যের উপর বিরাট আঘাত হানে জাতির মধ্যে মিশে থাকা মোনাফেকরা। তাদের প্ররোচনায় একদল বিদ্রোহী ওসমানকে (রা:) হত্যা করে। এরপর খলিফা হন আলী (রা:)। ওমরের (রা:) সময় থেকেই মোয়াবিয়া (রা:) ছিলেন সিরিয়ার প্রশাসক বা গভর্নর। ওসমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিকে কেন্দ্র কোরে মোয়াবিয়া ও তার অনুসারীরা আলীর (রা:) আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করেন। তার লক্ষ্য আলীকে (রা:) ক্ষমতাচ্যুত কোরে মোসলেম উম্মাহর খেলাফত লাভ করা। স্বভাবতই এজন্য তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে জিনিসটি তা হোল জনপ্রিয়তা ও লোকবৃদ্ধি। এমন সময় আকিল গেলেন মোয়াবিয়ার দরবারে।
মোয়াবিয়া (রা:):- আকিল, বেশ, তোমার ভাই তোমাকে কিছু দেয় নি, আমি দিচ্ছি।
আকিল- দিন, আমার অত্যন্ত প্রয়োজন।
মোয়াবিয়া (রা:):- কিন্তু একথা মসজিদে ঘোষণা কোরতে হবে, বুঝলে তো? বোলতে হবে, তোমার ভাইটি কেমন, আর আমি কেমন।
আকিল- তা নিশ্চয়ই ঘোষণা কোরব।
মোয়াবিয়া (রা:):- খাজাঞ্চী, আকিলকে একলাখ দেরহাম দিয়ে দাও।
কথা মোতাবেক আকিল মসজিদে গেলেন এবং দাঁড়িয়ে সকল মানুষের উদ্দেশ্যে বোললেন, বন্ধুগণ, একটা সত্য কথা শুনুন। আমি আলীর কাছে একটি অন্যায় আব্দার কোরেছিলাম, তিনি আমার চেয়ে দীনকে উপরে স্থান দিলেন। তারপর আমি মোয়াবিয়ার কাছে সেইরূপ আব্দার কোরলাম, তিনি দীনের চেয়ে আমাকেই উপরে স্থান দিলেন। -সুয়ূতী
এ হোচ্ছে বিকৃতির প্রথম পর্যায়ের একটি ঘটনা। তখনও উম্মতে মোহাম্মদী আরবের বাইরে রোমার সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ কোরে যাচ্ছে, অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে আল্লাহর রসুল এ জাতিটিকে তৈরি কোরেছিলেন সেই কাজ তখনও অব্যাহত আছে, কেবল নেতৃত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে শুরু হোয়েছে উদ্দেশ্যচ্যুতি। কিন্তু এ বিকৃতি দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে লাগল যা একসময় এ জাতির উদ্দেশ্যই ভুলিয়ে দিলে। আল্লাহর রসুল এও বোলে গিয়েছিলেন যে, আমার উম্মাহর আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর (হাদিস- আবু হোরায়রা (রা:) থেকে তিরমিজি ইবনে, মাজাহ)। অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদী হোল সেই জাতি যে জাতি তার নবীর অর্থাৎ মোহাম্মদের (দ:) উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ কোরতে সংগ্রাম কোরে যায়। এখানে ঐ দায়িত্ব হোল সমস্ত পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠা করা। ঐ সংগ্রাম পরিত্যাগ কোরলেই সে জাতি আর উম্মতে মোহাম্মদী থাকে না। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য কোরুন, দেখবেন ঐ জাতি এক দেহ এক প্রাণ হোয়ে, লক্ষ্যে অবিচল থেকে মোটামুটি ৬০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গেছে। তারপর এই উম্মাহ তার উদ্দেশ্য ভুলে যায়। পরবর্তীতে উমাইয়া, আব্বাসীয় রাজতন্ত্রের সময়ে যুদ্ধ করা হয় ঠিকই তবে সেটার উদ্দেশ্য ইসলাম প্রতিষ্ঠার বদলে হোয়ে গেল রাজ্য বিস্তার, সম্পদ আহরণ।
যেহেতু উদ্দেশ্যের পরিবর্তন বা চ্যুতি হোল কাজেই ঐ জাতি আর উম্মতে মোহাম্মদী রোইল না এবং আজ পর্যন্তও উম্মতে মোহাম্মদী নয়। যতক্ষণ ঐ উদ্দেশ্য পুনস্থাপিত না হবে, ততোক্ষণ এ জাতি উম্মতে মোহাম্মদী হোতে পারবে না। ততোদিন যতোই নবীর নামে মিলাদ পড়া হোক, তার ব্যক্তিগত সুন্নাহ, দাড়ি, টুপি, পোশাক আশাক অনুকরণ করা হোক, তার জন্মদিন পালন করা হোক, ডান কাতে শোয়া হোক, মিষ্টি খাওয়া হোক কোন লাভ নেই।