আদিবা ইসলাম
মক্কায় থাকাকালীন আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাবরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কেবল মানুষকে তওহীদের দিকে আহ্বান করে গেছেন। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ঈদ, জুমা ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক আমলগুলো তখনও নাজেলই হয় নি। যখন আল্লাহর রসুল মদীনায় গেলেন, তওহীদের ভিত্তিতে একটি জাতি তৈরি হলো, তারপর একে একে এসব বিধি-বিধানের হুকুম নাজেল হলো। এবং আল্লাহর রসুল মদীনায় গঠিত জাতিটির মধ্যে সেগুলোর প্রয়োগ ঘটাতে লাগলেন।
ইসলামের সমস্ত জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হচ্ছে ইবাদতের স্থানগুলি অর্থাৎ মসজিদ। কারণ মুসলিমের জীবনের, জাতীয় ও ব্যক্তিগত উভয় জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য পৃথিবীতে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। সুতরাং মুসলিমের জীবনে ইহজীবন ও পরজীবনের, দেহের ও আত্মার কোন বিভক্তি থাকতে পারে না কারণ দেহ থেকে আত্মার পৃথকীকরণ বা আত্মা থেকে দেহ পৃথকীকরণের একটাই মাত্র পরিণতি-মৃত্যু। তাই এই জাতির সমস্ত কর্মকাণ্ড এক অবিচ্ছিন্ন ইবাদত। জামাতে নামাজের উদ্দেশ্য হলো মুসলিম পাঁচবার তাদের স্থানীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদে একত্র হবে, তাদের স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে, তারপর স্থানীয় ইমামের নেতৃত্বে তার সমাধান করবে। তারপর সপ্তাহে একদিন বৃহত্তর এলাকায় জামে মসজিদে জুমা’র নামাজে একত্র হয়ে ঐ একই কাজ করবে। তারপর বছরে একবার আরাফাতের মাঠে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমদের নেতৃস্থানীয়রা একত্র হয়ে জাতির সর্বরকম সমস্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি সর্বরকম সমস্যা, বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে, পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায় থেকে ক্রমশঃ বৃহত্তর পর্যায়ে বিকাশ করতে করতে জাতি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু মক্কায় একত্রিত হবে। একটি মহাজাতিকে ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখার কী সুন্দর প্রক্রিয়া!
কাজেই যেহেতু জুমা’র নামাজ একটি জাতিগত বিষয়, তাই মদীনায় জাতি গঠিত হবার আগ পর্যন্ত আমরা রসুলাল্লাহ ও তাঁর অনুসারীদেরকে জুমার সালাহ কায়েম করতে দেখি না। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুমা হয় মদীনায়। রসুলাল্লাহ মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে হেজরত করলে পথিমধ্যে (মদীনার উপকণ্ঠে) জুমা’র নামাজের সময় হলো। তখন তিনি বনু সালিম ইবনে আওফের পল্লীতে রানুনা প্রান্তরে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম জুম’আর সালাহ কায়েম করলেন। এই জুমার নামাজে আল্লাহর রসুল যে ঐতিহাসিক খুতবা প্রদান করেন সেটা নিচে তুলে ধরা হলো-
‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমি তাঁর প্রশংসা করি। তাঁরই কাছে সাহায্য, হেদায়াত ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, আমি তাঁর অবাধ্যতা করি না। যারা অবাধ্যতা করে, তাদের সাথে আমি শত্রæতা পোষণ করি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং মোহাম্মদ (দ:) আল্লাহর বান্দা ও রসুল। তিনি মোহাম্মদকে (দ:) আলো, হেদায়াত ও নসিহত সহকারে এমন এক যুগে পাঠিয়েছেন, যখন অনেক কাল থেকে দুনিয়াতে কোন নবি আসেন নি। যখন জ্ঞান হ্রাস পেয়েছে ও অজ্ঞানতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাকে আখেরী যামানায় পাঠানো হয়েছে, যখন কেয়ামত নিকটবর্তী এবং দুনিয়ার মৃত্যু আসন্ন। যে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করে সে-ই সঠিক পথে; যে তাঁর হুকুম মানে নি সে পথভ্রষ্ট, সে মর্যাদা থেকে বিচ্যুত এবং কঠিন গোমরাহির মধ্যে লিপ্ত।
হে মো’মেনগণ! আমি তোমাদেরকে তাকওয়া অবলম্বনের উপদেশ দিচ্ছি। এক মো’মেনের প্রতি অপর মো’মেনের উত্তম উপদেশ হল তাকে আখেরাতের জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং আল্লাহকে ভয় করার কথা বলা। হে মানুষ! আল্লাহ যে সব বিষয় নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর। এর চেয়ে বড় কোন নসিহত নেই এবং কোন যিকিরও নেই। সুতরাং আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করছেন, তোমরা সেই ব্যাপারে সতর্ক হও। এর চেয়ে উত্তম কোন নসীহত নেই, নেই এর চেয়ে উত্তম কোন উপদেশ। স্মরণ রেখো, আল্লাহকে ভয় করে যে কাজ করে, আখেরাতে তাকওয়া তার জন্য উৎকৃষ্ট সাহায্যকারী। যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক প্রকাশ্যে ও গোপনে সঠিক করবে এবং এ ব্যাপারে তার নিয়ত পবিত্র থাকবে তখন তার এ কাজ দুনিয়াতে প্রশংসিত হবে এবং মৃত্যুর পর (যখন মানুষের আমলের গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনুভূত হবে) এক ভাণ্ডারে পরিণত হবে। যদি কেউ এরূপ না করে তাহলে তার যে পরিণতি হবে তার উল্লেখ রয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতের মধ্যে: মানুষ চাইবে তার আমল যেন তার থেকে দূরে রাখা হয়।
হে মো’মেনগণ! তোমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রকাশ্য ও গোপন কাজে আল্লাহর ভয়কে সামনে রেখো। কেননা, আল্লাহকে ভয়কারীদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাদের প্রতিদান বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাকওয়ার অধিকারীরা বিরাট সাফল্য লাভ করবে।
আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করে, তাহারা অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে (সুরা আহযাব: ৭১)।’ কারণ একমাত্র তাকওয়া আল্লাহর ক্রোধ হতে রক্ষা করে, তাঁর শান্তি হতে রক্ষা করে, রক্ষা করে আল্লাহর বিরাগভাজন হতে। একমাত্র তাকওয়া চেহারাকে উজ্জ্বল করে, পালনকর্তার সন্তুষ্টি আকর্ষণ করে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে। হে মো’মেনগণ! উপভোগ কর কিন্তু হক আদায়ের ব্যাপারে গাফেল হয়ো না। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর কিতাব দিয়েছেন এবং রাস্তা প্রদর্শন করেছেন যাতে মিথ্যাপন্থী ও সত্যপন্থীদের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। হে মানুষ! অন্যদের প্রতি তোমরা অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহর দুশমনকে তোমরা দুশমন মনে কর এবং আল্লাহর রাস্তায় পূর্ণ সাহস ও একাগ্রতার সাথে জেহাদ কর, যেমন জেহাদ করা উচিৎ। তিনিই তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন এবং তোমাদেরকে মুসলিমনামকরণ করেছেন এজন্য যে, যারা ধ্বংস হবার তারা যেন সত্য স্পষ্ট হবার পর ধ্বংস হয়, আর যারা বেঁচে থাকবার তারা যেন সত্য স্পষ্ট হবার পর বেঁচে থাকে। সকল পূণ্য কাজ আল্লাহর সাহায্যে সংঘটিত হয়।
হে মানুষ! আল্লাহর যিকির কর এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ কর। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে নিজের সম্পর্ক সংশোধন করে, আল্লাহ মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক সঠিক করে দেন। অবশ্যই আল্লাহ বান্দাদের উপর কর্তৃত্বের অধিকারী। কিন্তু তাঁর উপর কারো কর্তৃত্ব চলে না। আল্লাহ বান্দাদের মালিক এবং তাঁর উপর বান্দাদের কোন এখতিয়ার নেই। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমরা এ মহান সত্ত¡ার নিকট থেকেই নেকীর শক্তি লাভ করি।’