হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ইসলামের দৃষ্টিতে চলচ্চিত্র শিল্প ও সংস্কৃতি

Untitled-14-300x196
 
রাকীব আল হাসান:
দেশ সমাজ ও জাতি গঠনে গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি জাতির প্রকৃত চরিত্র প্রতিফলিত হয়। সেই সাথে জাতির চরিত্রের উপরও চলচ্চিত্র বিশেষ প্রভাব ফেলে। কিন্তু বর্তমানে নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও সাহিত্যের মাধ্যমে অসত্য, অশ্লীল কিছু কার্যক্রম এই মাধ্যমটিকে সমাজ ও ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এ সব অশ্লীলতার কারণে ধর্মাশ্রয়ী একটি শ্রেণি সঙ্গীত, সুর নৃত্যকে নাজায়েজ জ্ঞান করছে।
ভাবতেও অবাক লাগে, প্রকৃত ইসলামের যুগে যে মুসলিমরা দুর্দান্ত গতিতে অর্ধ পৃথিবী জয় করে সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করল; ধনে, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, শিক্ষায়, সামরিক শক্তিতে সকল ক্ষেত্রে সবার ঊর্ধ্বে আরোহণ করল; সেই জাতি আজ সকল জাতির গোলামে পরিণত হয়ে অন্য জাতিগুলির দ্বারা অপমানিত, লাঞ্ছিত হচ্ছে। এই অপমান, লাঞ্ছনা থেকে পরিত্রাণের উপায় না খুঁজে তারা আজ অতি তুচ্ছ বিষয়গুলি নিয়ে জায়েজ, না’জায়েজের ফতোয়াবাজীতে ব্যস্ত; কূপমণ্ডূকতার গহ্বরে বসে প্রশ্ন করে, টিভি দেখা, ছবি তোলা, গান-বাজনা করা জায়েজ না না’জায়েজ। কী পরিহাস! প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কোনো সত্য ও সুন্দর, মানুষের সুকোমল বৃত্তি, প্রতিভা, সুর, সঙ্গীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদিকে অবৈধ বলে না। অবৈধ হচ্ছে অসত্য, অশ্লীলতা এবং স্রষ্টার অবাধ্যতা। কোনো ধর্মই এসবকে নাজায়েজ করতে পারে না। কেননা স্বয়ং স্রষ্টাই সুর ও নৃত্য সৃষ্টি করেছেন। শেষ প্রেরিত গ্রন্থ আল কোর’আনকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন ছন্দবদ্ধ করে। কেবল কোর’আন নয়, যবুর, গীতা, পুরান, ত্রিপিটক ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থও আল্লাহ পাঠিয়েছেন কাব্যময় করে। গীতা শব্দের অর্থই তো গান। নৃত্য হচ্ছে শৃঙ্খলার অনুপম নিদর্শন। পাখি আকাশে ওড়ে- তাদের মধ্যে বিরাজ করে শৃঙ্খলা। পাখির দল যে দিকে ওড়ে এক সাথেই ওড়ে, দলপতির অনুসরণ করে সামনে যায়, ডানে বায়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে, নিচে নামে- সব করে একতালে। পাখির কণ্ঠে তিনিই সুর ও সঙ্গীত দান করেছেন। সাগরের ঢেউয়েও আছে অপরূপ নৃত্য। সবুজ মাঠে ধানের শীষ যখন আন্দোলিত হয়- তাতেও দেখা যায় এক অপরূপ নৃত্যের নিদর্শন। আযান ইসলামের এক অনন্য সঙ্গীত। সুতরাং যিনি সুরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি সেই সুরকে নাজায়েজ করতে পারেন না। কিন্তু আজ পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের অনুসারী আত্মাহীন, নৈতিকতাহীন একদল মানুষ সুর, সঙ্গীত ও নৃত্যকলাকে কলুষিত করছে। নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড ও শিল্পকলা আল্লাহ কোথাও নিষেধ করেন নি। সুতরাং মানুষ যত খুশি গান গাইতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, ভাস্কর্য নির্মাণ করতে পারে, কেউ বিকৃত ফতোয়ার চোখ রাঙানিতে তার সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ করতে পারে না। প্রকৃত ইসলামের সময় এই সমস্ত ফতোয়াবাজি ছিল না। একটি সরল সত্য হলো, ইসলামের বৈধ-অবৈধ নির্ধারণের বেলায় মানদণ্ড হচ্ছে আল্লাহর আদেশ এবং নিষেধ অর্থাৎ আল-কোর’আন। রসুলাল্লাহ জানতেন যে, তাঁর বাণীকে ভবিষ্যতে বিকৃত করা হবে, অনেক বৈধ বিষয়কে অবৈধ ঘোষণার জন্য সেটিকে তাঁর উক্তি বলে চালিয়ে দেওয়া হবে, তাই তিনি বলে গেছেন, আমি তোমাদের জন্য সেটাই হালাল করেছি যেটা আল্লাহ হালাল করেছেন, সেটাই হারাম করেছি যেটা আল্লাহ হারাম করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমার কোনো কথা কোর’আনের বিধানকে রদ করবে না, তবে কোর’আনের বিধান আমার কথাকে রদ করবে (হাদীস)। সুতরাং যে কোনো জিনিস হারাম কিনা তা জানার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর কেতাব দেখতে হবে। কোর’আনে যা কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলি ছাড়া আর সবই বৈধ। এখন কোর’আন খুলে দেখুন গান, বাদ্যযন্ত্র, কবিতা, চলচ্চিত্র, নাট্যকলা, অভিনয়, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ভাষ্কর্য্য নির্মাণ ইত্যাদি আল্লাহ হারাম করেছেন কিনা? যদি না করে থাকেন তাহলে এগুলি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আল্লাহ যেটিকে বৈধ করেছেন, সেটিকে কোনো আলেম, মুফতি, ফকীহ, মোফাসসের হারাম করার অধিকার রাখেন না।
আমরা অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই রসুলের আনীত ইসলাম অর্ধদুনিয়ায় কায়েমের ফলে পরবর্তী মুসলিম জাতিটি সর্বদিক দিয়ে পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে আসীন হন। কি সঙ্গীত, কি কাব্য, কি নতুন নতুন সুর রচনায়- কোথায় নেই তারা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সুন্দর সুন্দর কবিতা, গান লিখে গেছেন। সেসব আজও সমাদৃত। যারা সঙ্গীতকে নাজায়েজ মনে করেন তারাও ওয়াজের মধ্যে কবি সাহিত্যিকদের সুর ছন্দ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজকে সঙ্গীত বৈধ কি অবৈধ, নৃত্য বৈধ কি অবৈধ তার প্রশ্ন উঠছে। এর কারণ হচ্ছে জাতি গঠনে এগুলো আজ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৈতিক পদস্খলনের হাতিয়ারে এসব পরিণত হচ্ছে। কাব্যের নামে, নৃত্যের নামে আজ অশ্লীলতা, বেহায়াপনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে- যে কোনো কিছুর সাথেই হোক অশ্লীলতা, বেহায়াপনা- যা মানুষের ক্ষতি করে তাকে কোনো ধর্মই বৈধতা দিতে পারে না। অশ্লীলতার প্রসারে সমাজে কিভাবে অপরাধ বৃদ্ধি পায় তা প্রত্যক্ষ করে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশেও অশ্লীলতা-বিরোধী উদ্যোগ নিচ্ছে, আইন-পাশ করছে। আশা করি কোনো সুস্থ মানুষই গণমাধ্যম তথা চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্যের এই নেতিবাচক দিকটিকে অস্বীকার করতে পারবেন না। তাই বলে কাব্যকে, সঙ্গীতকে, নৃত্যকে, সাহিত্যকেই একচেটিয়াভাবে নিষিদ্ধ করে রাখা ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতার সামিল। মাথায় ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান নয়, বরং সঠিক চিকিৎসা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যারা এই সব নাজায়েজ বলে ফতোয়া দিয়ে জাতির সকল চিন্তাশক্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে চায় তারা কিন্তু সবচাইতে নাজায়েজ অর্থাৎ অবৈধ কাজটিই করছে, আর তা হলো ধর্মকে নিয়ে ব্যাবসা, যা আল্লাহ সরাসরি আগুন খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন (সুরা বাকারা- ১৭৪)। নামাজ পড়িয়ে, তারাবীহ পড়িয়ে, মুর্দা দাফন করে, ওয়াজ করে, মিলাদ পড়িয়ে ধর্মের নামে আরও বিভিন্ন কায়দায় ব্যাবসা করছে, এটা কিন্তু সবচাইতে বড় অবৈধ কাজ।
আমাদের মনে রাখতে হবে একই সুরে, একই কবিতায় আমরা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মহিমা প্রচার করতে পারি, সমাজে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে পারি- আবার সেই সুর দিয়ে, সেই কথা দিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যও করতে পারি। ভাল কি মন্দ তা নির্ভর করে এর ফল ব্যবহার এবং ফল কী দাঁড়াচ্ছে এর উপর। একটি বন্দুক দিয়ে আপনি ডাকাতকে প্রতিরোধ করতে পারেন আবার সেই বন্দুক দিয়ে নিরীহ মানুষকে খুনও করতে পারেন। বন্দুক এখানে শুধু একটা মাধ্যম। এটি দিয়ে কি করা হচ্ছে- ভালো করা হচ্ছে না কি মন্দ করা হচ্ছে তা-ই বিবেচ্য বিষয়। তেমনি সঙ্গীতে আপনি সুন্দর সমাজ গঠনের কথা বলবেন, ভালো কাজকে উৎসাহ দিবেন- নাকি বেহায়াপনা করবেন, না কি অশ্লীলতার বিস্তার ঘটাবেন সেটাই বিচার্য। সাহিত্যে আপনি সমাজ সংস্কার করবেন নাকি, মানুষকে অরাজকতা করতে উষ্কে দিবেন, মানুষকে স্রষ্টামুখী করবেন, নাকি মানুষকে স্রষ্টাবিমুখ করবেন- এটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মানুষ হিসেবে সকলের উচিত চলচ্চিত্র, নাটক, গান, সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য ও সুন্দরকে তুলে ধরা।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...