রুফায়দাহ পন্নী:
সম্প্রতি ইরানে নৈতিক পুলিশের অত্যাচারে মাহসা আমিনি নামে একজন তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরান জুড়ে যে বিক্ষোভ চলছে, সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মোতাবেক তাতে নারী শিশুসহ ১৫৪ জন মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। এই নিয়ে ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর থেকে বিগত ৪২ বছরে মেয়েরা তাদের উপরে ধর্মের নামে যে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে এর প্রতিবাদে বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সে বিক্ষোভগুলো কঠোরভাবে দমন করেছে ইরান সরকার। বিক্ষোভ আর বিক্ষোভ দমন সেখানে নতুন কিছু নয়। কেন এই ক্ষোভের জন্ম আর কীভাবে এর প্রশমন সম্ভব- তা বোঝার জন্য বিষয়টির একটু গভীরে যাই।
আমাদের মুসলমানদের মধ্যে ইরানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শিয়া মতাবলম্বী মুসলিম। সেখানে আইএস, আল কায়েদা বা আইসিস ধরনের কট্টরপন্থী সুন্নি মতাদর্শীদের লোকও রয়েছে। তাদের আওতাধীন এলাকাতেও কিন্তু মেয়েদের উপরে নানাপ্রকার অবরোধ, চলাফেরায় বিধিনিষেধ এবং তাদের জীবন যাত্রার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার একটা প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এইসব বিষয় নিয়ে পাশ্চাত্য মিডিয়া, বিশেষ করে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা এগুলোকে বার বার সামনে এনে ইসলামকে একটা আধুনিকতাবিরোধী, পশ্চাৎমুখী, নারীবিদ্বেষী, মানবধিকার অস্বীকারকারী একটি বর্বর জীবনব্যবস্থা হিসাবে প্রমাণ করতে অপপ্রয়াস চালায়।
এখন আমরা যারা সাধারণ মুসলমান আমরা এইসব পরিপ্রেক্ষিতে একটা দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে আমরা অবস্থান করছি। আমি মনে করি জাতি এমনিতেই দুঃখজনকভাবে বহু ভাগে বিভক্ত। জাতির এখন ঐক্য দরকার। এখন এই অবস্থায় আমাদের যারা চিন্তাশীল আছেন গবেষক আছেন যারা পণ্ডিত আছেন তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে এই বিষয়গুলিকে সমাধান করার জন্য। এইসব পোশাক আশাক, চুল ঢাকা না ঢাকার মত সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক এই আধুনিক গতিশীল যুগে আর রাখা যায় না। মেয়েদের পোশাক, চলাফেরা, বাইরে বের হওয়া ইত্যাদি নিয়ে আরবের দেশগুলোতে বহু আলোচনা সমালোচনার পর কিছুদিন আগে সেখানে মেয়েরা গাড়ি চালানোর অধিকার দাবি করেছে। হলে বসে সিনেমা দেখার অধিকার তারা দাবি করছে। একেক জায়গায় মেয়েদের বিষয়ে একেকরকম দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাচ্ছি। তবে সর্বত্র একটা প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হল মেয়েদেরকে দমন করে রাখার প্রবণতা। এতে এটাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, নারীদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাই যেন ইসলামের মূল বার্তা। মনে হচ্ছে নারীদেরকে দমন ও তাদের স্বাধীনতা হরণ করার উদ্দেশ্যেই নবীর আগমন। নারীরাই হল সমস্ত অগ্রগতির সামনে মূল সঙ্কট। এই জিনিসটা তারা বার বার প্রতীয়মাণ করছে। আমরা মনে করি এর একটা সমাধান হওয়া দরকার।
বাংলাদেশের একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদ। এ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী তিনি ইসলামের প্রকৃত রূপ তুলে ধরার জন্য বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। বইগুলোতে একটি কথা তিনি বারবার বলেছেন যে, ইসলাম হচ্ছে দীনুল ফিতরাহ, অর্থাৎ প্রাকৃতিক দীন। অপ্রাকৃতিক কোনো কিছুই ইসলামে আল্লাহ রাখেন নি। আবার তিনি বলেছেন ইসলাম হচ্ছে দীনুল কাইয়্যেমা বা শাশ্বত চিরন্তন সনাতন দীন। আল্লাহ আবার বলেছেন, ইসলাম হচ্ছে সেরাতাল মুস্তাকীম, সহজ সরল পথ। ইসলামকে তিনি বলেছেন দীনুল ওয়াসাতাহ (সুরা বাকারা ১৪৩)। তাহলে একসাথে শব্দগুলোকে দাঁড় করালে এই হয় ইসলাম হল সহজ সরল ভারসাম্যযুক্ত এবং প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে বাড়াবাড়ির বা বক্রতার কোনো সুযোগ নাই। এখানে নারী বা পুরুষের মধ্যে কাউকে দমন করে রাখার বা তাকে প্রাকৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার বিধান ইসলামে থাকতে পারে না। কারণ ইসলাম একটা ঐশ্বরিক বিধান, আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আসা। আল্লাহ হচ্ছেন এমন একটা সত্তা যিনি ন্যায়ের ধারক, যিনি সর্বন্যায়ের উৎস; যিনি সমস্ত মানবজাতিকে খাটো লম্বা মাঝারি, নারী-পুরুষ, পাহাড়ী সমতল ভূমির সকল মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন; সকলের স্রষ্টা তিনি। তিনি সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসেন। তিনি আদম সন্তানকে তিনি নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। আলো বাতাস, পানি মাটি, ফল ফলাদি, পাখির কলতান, মৎস্যকুল, প্রাণী জগৎ সবকিছুর উপরে সব মানুষের হক রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যখন বৃষ্টি বর্ষণ করেন তখন তিনি আস্তিক, নাস্তিক, হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ করেন না। তিনি যখন ফল ও ফসল ফলান তখন তা বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবাই তা ভোগ করে।
পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, নদী-নালা সবই স্রষ্টার সৃষ্টি। প্রকৃতির অতুল ভাণ্ডার কখনও দানে বৈষম্য করে না। আস্তিক-নাস্তিক, ধার্মিক, অধার্মিক সকলেই সেটা গ্রহণ করতে পারে। তেমনি আল্লাহর রসুলের (সা.) মাধ্যমে যে জীবনবিধান পাঠিয়েছেন, তাতেও কোন বৈষম্য নেই। সব ধর্ম, বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী এটা গ্রহণ করতে পারবে। এসব বৈষম্য পরে সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবার পর শরীয়তের নামে এসব বাড়াবাড়ি, ফেরকা, মাজহাব ও বিভক্তির দেওয়াল তৈরি হয়েছে। শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার নামে নিজেরা নতুন করে বিধান তৈরি করেছে এবং সেগুলো মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোকে এভাবেই বিকৃত করা হয়েছে। যেমন ইহুদিরা তাদের ধর্মগ্রন্থের উপর কলম ঘুরিয়েছে, সনাতন ধর্মগ্রন্থে আরও বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। ফলে সেগুলো অতিরিক্ত বিকৃত হয়ে গিয়েছে।
আমরা সঙ্গত কারণেই বলতে চাই, ইসলামে নারীদের অধিকার নিয়ে আল্লাহর রসুল (সা.) আজকের মত শিয়া-সুন্নী দলাদলি করেননি, নারীদের যে বিষয়গুলি নিয়ে কট্টর পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে সেসব বিষয় কট্টর হতে স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা পাই, নবী করিম (স.) নারীদের ব্যাপারে যথেষ্ট সহনশীল ও উদার ছিলেন। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও সবসময় শ্রদ্ধা, সম্মান দেখিয়েছেন। এটা সমস্ত আলেম, মুহাদ্দিসরা একমত। এমনকি যারা নবীর (সা.) জীবনী লিখেছেন যেমন ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, পি. কে হিট্টি, উইলিয়াম মুর, ইমাম বোখারী, মুসলিম প্রমুখ হাদিসবেত্তাগণ তারাও এ ইতিহাস উল্লেখ করেছেন যে, রসুল (স.) যখন বক্তব্য দিতে বসতেন তখন তাঁর সামনে মেয়েরাও ছেলেদের পাশাপাশি অবস্থান করতেন। তাদের উভয়ের মাঝে কোন দেওয়াল বা পর্দা টানানো ছিল না। যেখানে রসুলুল্লাহর (সা.) জীবনাচরণ বা সুন্নাহ হল ইসলামের আইনের উৎস, যাঁর ওপর পবিত্র কোর’আন নাযেল হয়েছে, তিনি প্রকৃত ইসলামের ব্যবহারিক জীবনপদ্ধতি দেখিয়ে দিলেন সেখানে আমাদের ফকীহরা কিভাবে ফতোয়া দিতে পারেন যে, নারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া যাবে না, তাদের চেহারা দেখা যাবে না, তাদের সমাবেশে আসা নিষেধ, আসলেও তাদের অবস্থানের জন্য পৃথক কক্ষ প্রস্তুত করতে হবে?
রসুলের (সা.) সময় মেয়েদের মসজিদে যাওয়ার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। এমনকি রাতের বেলায়, ভোরের বেলায়, এমন কি গভীর রাতে তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম করতেও নারীদের মসজিদে যাওয়ার অনুমতি ছিল। অথচ পরবর্তীতে দীন বিকৃত হয়ে যাওয়ার দরুণ, কিছু কিছু মুসলিম রাষ্ট্রগুলো বাদে প্রায় সব দেশেই মসজিদে মেয়েদেরকে প্রবেশ একদম নিষেধ করা হয়। আমাদের বাংলাদেশে তো প্রশ্নই আসে না। আমরা মুখে বলি আল্লাহর ঘর মসজিদ, কিন্তু আল্লাহ কি কেবল পুরুষের স্রষ্টা? আমাদের দেশের বহু মসদিজ আর ঈদগাহের বাইরে সাইনবোর্ড টানিয়ে নারীদের মসজিদে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক কথা।
আল্লাহর রসুল (সা.) যেখানে মেয়েদের মসজিদে প্রবেশের অবাধ স্বাধীনতা দিলেন সেখানে আমাদের আলেমরা মেয়েদেরকে মসজিদে ঢুকতেই নিষিদ্ধ করে দিলেন। আরও ফতোয়া তৈরি করা হল, মেয়েরা মসজিদে প্রবেশ করলে মসজিদ নাপাক হয়ে যাবে, ফেতনার সৃষ্টি হবে ইত্যাদি। ইতিহাসে আমরা আরও পাই মদিনার মসজিদে নববী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব পালন করতেন নারী সাহাবীরা। এমনকি কোনো কোনো নারী মসজিদে অবস্থানও করেছেন। এমনও ঘটনা পাওয়া যায় কাফেরদের অত্যাচারে থাকতে না পেরে রসুল (সা.) নারীদের মসজিদে থাকতে দিয়েছেন। যুদ্ধাহত সৈন্যদের সেবার জন্য হাসপাতাল ছিল মসজিদ নববীর অভ্যন্তরে এবং সেটার পরিচালনা করতেন কয়েকজন নারী সাহাবী। এমন জীবন্ত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও কি করে মেয়েদেরকে মসজিদে প্রবেশ থেকে বিরত রাখা যায়?
এখন বর্তমান মুসলিম নারীরা যদি মসজিদ ঢোকার জন্য আন্দোলন করে, নিশ্চয়ই আমাদের এই আলেমরা বলবেন, এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে! আসলে এটা বাড়াবাড়ি নয়, এটা ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদের মানবাধিকার। যে অধিকার আল্লাহর রসুল (সা.) তেরশো বছর পূর্বে নারীদের দিয়ে গেছেন।
এখনও হজ্বের ময়দানে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ হজ্ব পালন করতে যান। সেখানে শুধু স্বামী বা ভাই নয় অপরিচিত হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে হজ্ব পালন করতে হয়। সেখানে কোন সমস্যা হয় না। ঠিক সালাহর মত পুরুষের কাতারের পর নারীর কাতার এভাবে তওয়াফ করা হচ্ছে। আল্লাহর ঘর কা’বা তাওয়াফ করতে কোন বিধিনিষেধ নাই। অথচ বলা হয় মসজিদও আল্লাহর ঘর। তাহলে যেতে মসজিদে কেন এত বাধা?
শরীয়তের নিয়ম হল যাদের সঙ্গে বিয়ে বৈধ তারা একান্তে নিরিবিলি গোপনে একত্রে অবস্থান করতে পারবে না। কারণ, এর ফলে সীমালঙ্ঘন হতে পারে। এটা একটি যুক্তি। কিন্তু সম্মেলন, সমাবেশ, জামায়াতে সালাহ আদায় এসব স্থান কখনো একাকী নিরিবিলি থাকে না, সেখানে অবশ্যই লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। তাহলে সেখানে যেতে বাধা দেওয়া হয় কোন যুক্তিতে ?
রসুল (স.) মেয়েদেরকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেলেন। অনেকে এর বিপক্ষে খোড়া যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন, তারা যখন যুদ্ধে গিয়েছে তখনও পর্দার আয়াত নাযিল হয় নি। অথচ প্রকৃত বাস্তবতা হল, রসুল (সা.) এন্তেকাল করার পর পরই আয়াত নাযেল শেষ হয়ে গেল, দীন পূর্ণ হল; কিন্তু আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.) খলিফা থাকাকালীন রোমান, পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নারীরা বীরাঙ্গণার ভূমিকা পালন করেছেন। কোনো কোনো যুদ্ধের মূহূর্তে মেয়েরা সেনাপতির ভূমিকাও পালন করেছেন। এমনও হয়েছে যুদ্ধ স্থিতিশীল অবস্থায় থাকাকালীন মেয়েরা যুদ্ধের গতি প্রকৃতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে পুরুষ যোদ্ধারা যখন ভয়ে পালিয়ে তাঁবুতে ফিরছিল তখন মেয়েরা হাতে লাঠি ও পাথর নিয়ে তাদেরকে রণাঙ্গনে ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত ও উদ্দীপ্ত করেছেন। সেদিন যদি মুসলিম নারীরা ইয়ারমুকের যুদ্ধে না যেতেন তাহলে ইসলামের ইতিহাস কী হত তা একবার ভেবে দেখুন।
এরকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে যেখানে নারী সাহাবীরা ইসলামের অসামান্য অবদান রেখেছেন। ওহুদ যুদ্ধে রসুল (সা.) বিপদসংকুল মুহূর্তে উম্মে আম্মারা (রা.) তলোয়ার হাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে ভীষণ লড়াই করেছেন। পরে রসুলাল্লাহ বলেছেন, ওহুদের যুদ্ধের দিন আমি যে দিকে তাকিয়েছি কেবল উম্মে আম্মারাকেই লড়াই করতে দেখেছি। আমি ডানে তাকিয়েছি দেখেছি উম্মে আম্মারা, বামে তাকিয়েছি দেখেছি উম্মে আম্মারা। নারী আসহাবরা শত্রুর হাত থেকে রসুলকে (সা.) রক্ষা করেছেন, এই ইতিহাস আমাদের আলেমদের জানার কথা। নারীদের এত স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস, এত গৌরবময় ইতিহাস, নারীদের অবাধে ইসলামিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কীভাবে নারীদের ঘরমুখী করা হল?
মদিনার বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে নারীরা তলোয়ার হাতে নিয়ে ঘুরতেন। কেউ মাপে কম দেয়ে কি না, খাদ্যে ভেজাল মেশায় কি না, সিন্ডিকেট করে কি না ইত্যাদি। এগুলো ইতিহাস। আর এখন “বাজার ব্যবস্থা পরিচালনা করবে নারীরা” একথা ভাবতেও অবাক লাগে। নারীরা যুদ্ধের মত জায়াগায় গিয়েছেন অথচ কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় নি, তাহলে মসজিদে কেন হবে?
যুদ্ধে যেতে নারীদের পর্দা নিয়ে বাঁধা দেওয়া হয় না, কার চুল দেখা যায়, কতটুকু দেখা যায় সেগুলো মুখ্য বিষয় নয়। কোন নারী তলোয়ার চালাতে জানে, ঘোড়া চালাতে জানে, শত্রুদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারবে, এটাই মুখ্য ছিল। রসুল (সা.) নারীদের যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেছেন। এটাই রসুলাল্লাহর (সা.) সুন্নাহ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা সেই সুন্নাহ থেকে বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি। এটাই আমাদের জাতি ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
আজকে ইরানের মত জায়গায় মেয়েরা হিজাব নিয়ে আন্দোলন করছে, আমাদের দেশের মেয়েরাও জাতীয় কোনো কাজে অংশগ্রহন করতে গেলে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। অথচ রসুলের (সা.) সময় নারীদের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না। এমনকি প্রশ্নগুলো পরবর্তী সময়ের খলিফাদেরও করা হয় নি। এতবড় তুর্কি সালতানাত চলেছে সেখানেও এসব প্রশ্নের জন্ম হয় নি। আজ বর্তমান পৃথিবীর উন্নতি-প্রগতির এই যুগে নারীরা যখন চাঁদের দেশে যাচ্ছে, মিডিয়া কন্ট্রোল করছে, সামরিক বাহিনীতে কাজ করছে, প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন সেখানে ধর্মীয় আলেমদের ফতোয়ার জ্বালে মুসলমান নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না, মসজিদে যেতে পারছে না, সামাজিক কোন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে না ফলে প্রগতিশীল নারীরা অবাধ স্বাধীণতার জন্য বাধ্য হয়ে পশ্চিমাদের প্রতি পদে পদে অনুসরণের চেষ্টা করছে। এসবের একমাত্র কারণ ইসলামী শরিয়াহ নিয়ে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি এবং নারীদের প্রতি বিদ্বেষ আচরণের চর্চা।
এই বাড়াবাড়ি বন্ধের জন্যই আমরা হেযবুত তওহীদ আন্দোলন বিগত ২৭ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা নারীদের প্রকৃত অধিকার ফিরিয়ে দিতে দেশজুড়ে লক্ষাধিক সভা-সেমিনার, জনসভা, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছি। আমাদের এই মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে ধর্মব্যবসায়ী আলেমদের ফতোয়ার সংঘাত লেগে গেছে। তাই তারা আমাদের নারীদের নানাভাবে হেনস্তা ও হয়রানির শিকার করছে। আমাদের নারীরা পত্রিকা বিক্রির মাধ্যমে মেয়েদের অচলায়তন ভেঙ্গে দিতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এক শ্রেণির অপপ্রচারকারী প্রকাশ্যে ও ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে হেযবুত তওহীদের নারীদের বিরুদ্ধে অপমানসূচক কথা বলে, নানারকম অপবাদ আরোপ করে। এ ধরনের বিকৃত মানসিকতার লোকগুলো যদি এভাবে সামনে অগ্রসর হতে থাকে তাহলে আমাদের নারীরা অবশ্যই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে, মানবধিকার লঙ্ঘিত হবে। ইসলাম সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা, ভুল আদর্শ মানুষের মধ্যে সারাজীবন রয়ে যাবে। একজন প্রকৃত মো’মেন কখনোই এটা মেনে নিতে পারে না।
কাজেই আমরা হেযবুত তওহীদ মনে করি, আমাদেরকে দুনিয়ার মুসলিম নারীদের প্রকৃত মানবাধিকার, অবাধ স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যেটা ইতিমধ্যে ইরানের জনগণ উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। কলকাতায় এনআরসির বিরুদ্ধে যখন বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর পিছনে হাজার হাজার আলেম-ওলামা, লক্ষ লক্ষ নারী মিছিল করলেন। কেউ মমতা ব্যানার্জীর হিজাব ঠিক নাই, মাথার চুল দেখা যাচ্ছে কেন ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন না। সেখানে যদি কোন মুসলমান নারী সম্মুখে থাকত এতক্ষণে আলেমরা ধর্ম গেল, ধর্ম গেল নিয়ে তোলপাড় করে ফেলত।
কাজেই বৃহত্তর পরিসরে ইসলামের শরিয়াহ প্রতিষ্ঠায় নারীদের পিছিয়ে রেখে কখনোই সফল হওয়া সম্ভব নয়। নারীদের সামাজিক কাজে বাধা ইসলামের অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সমতুল্য। বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মানুষ অনেক দূর পর্যন্ত চিন্তা-ভাবনা করার সক্ষমতা রাখে। আমাদের পেছনে তাকালে চলবে না। সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। তবে সব কাজের মূলনীতি ঠিক থাকবে- সেটা হল আল্লাহর বিধান। আল্লাহর বিধান মানতে হলে আগে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, আল্লাহর হুকুম, আইন-কানুন জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেটা আমরা কোর’আন থেকে পাই। আর আছে রসুলের (সা.) জীবনাচরণ বা সুন্নাহ। এর বাইরে আর কিছুই দরকার নেই। কোর’আনে ও রসুলাল্লাহর জীবনাচরণে কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি নেই, অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা নেই, সীমালঙ্ঘন তো প্রশ্নই আসে না।
লেখক: হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় নারী বিভাগের সম্পাদক।