হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ইতিহাসের উপেক্ষিত অধ্যায়; মহানবীর সহিষ্ণুতা ও আমাদের শিক্ষা

মোহাম্মদ আসাদ আলী

৬২৮ খ্রিস্টাব্দের জিলকদ মাস। আরবে তখন মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ব্যাপক হুলুস্থুল চলছে। ইতোমধ্যেই বদর, ওহুদ, খন্দক ইত্যাদি বড় বড় যুদ্ধ হয়ে গেছে। যুদ্ধে রসুলাল্লাহর পক্ষের বহু সাহাবি যেমন প্রাণ দিয়েছেন তওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য, তেমনি রসুলাল্লাহর শত্রুপক্ষের মোশরেকরাও প্রাণ দিয়েছে তওহীদের প্রদ্বীপকে নিভিয়ে ফেলার জন্য। দু’টো শিবিরেই তখন জ্বলছে যুদ্ধের আগুন। স্বজন হারানোর আর্তনাদ তখন মক্কার শহুরে অলি-গলিতে যেমন শোনা যায়, তেমন শোনা যায় মদীনার গ্রামীণ পথে- প্রান্তরেও। দু’পক্ষেই দানা বাঁধে আগ্রাসী ক্ষোভ, জিদ। এমনই এক পরিবেশে যুদ্ধের তীক্ত প্রেক্ষাপটে মদীনার মো’মেনদের সঙ্গে মক্কার মোশরেকদের সমঝোতায় পৌঁছনোর একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা উদয় হলো। উভয়পক্ষের মধ্যে আন্তরিক আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো। মক্কার পক্ষ থেকে এই সমঝোতা-সংলাপে নেতৃত্ব দিলেন সোহাইল ইবনে আমর এবং মদীনার পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং রসুলাল্লাহ (সা.)। আলোচনা শেষে যখন সন্ধিপত্র লেখা শুরু হলো- সেই লেখার দায়িত্ব পড়ল আলী (রা.) এর কাঁধে।

আলী (রা.) আল্লাহর নামে সন্ধিপত্র লেখা শুরু করলেন। আল্লাহর নামে কোনো কিছু শুরু করাতে আরবের মোশরেকদের আপত্তি ছিল না, কারণ তারা নিজেরাও কোনো কাজ শুরুর আগে আল্লাহর নাম নিত। কিন্তু আলী (রা.) যখন সন্ধিপত্রে মুসলিমপক্ষের নেতা হিসেবে মোহাম্মদ (সা.) এর নাম লিখলেন এবং সেই নামের আগে “রসুলাল্লাহ” শব্দটি যোগ করলেন, মোশরেকরা তখন আপত্তি করে বসল। তারা বলল, আমরা যদি মোহাম্মদ (সা.) কে “রসুলাল্লাহ” বলে বিশ্বাসই করতাম তাহলে তো আর এতকিছুর দরকার পড়ত না।

রসুলাল্লাহর সামনেই সবকিছু ঘটছিল। তিনি কিন্তু পারতেন নিজ দাবির পক্ষে অটল থাকতে। বলতে পারতেন- “হে মক্কার মোশরেকরা! তোমরা কী বিশ্বাস করো বা না করো তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। আমি রসুলাল্লাহ- এটাই সত্য। আমার নামের সঙ্গে রসুলাল্লাহ শব্দ ছিল, আছে, থাকবে।” সত্যি বলতে এটাই ছিল সকল সাহাবির প্রাণের কথা। তাদের নেতার নাম লেখা হবে, অথচ সেখানে রসুলাল্লাহ শব্দটি থাকবে না তা তাদের চিন্তার অতীত। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আল্লাহর রসুল মোশরেকদের দাবিই মেনে নিলেন। আলী (রা.) কে নির্দেশ দিলেন সন্ধিপত্র থেকে “রসুলাল্লাহ” শব্দটা বাদ দিতে।

আলী (রা.) এমনিতেই মক্কার সঙ্গে সন্ধিতে রাজি ছিলেন না। মক্কার মোশরেকরা এ পর্যন্ত যা যা করেছে তার কিছুই তিনি ভুলতে পারেননি। তাদের জবাব তিনি দিতে চেয়েছিলেন রণাঙ্গনে। উপরন্তু যখন তাকে বলা হলো মক্কার মোশরেকদের দাবি মেনে নিয়ে “রসুলাল্লাহ” শব্দটা বাদ দিতে, তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। বললেন- “এ কাজ আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়, আপনি অন্য কাউকে বলুন হে রসুলাল্লাহ। আমি নিজ হাতে কখনই আপনার নাম থেকে রসুলাল্লাহ শব্দ কাটতে পারব না।” রসুলাল্লাহ (সা.) আলীর (রা.) সেন্টিমেন্ট বুঝলেন। আবার বাস্তবতাও বুঝলেন। তারপর বললেন- ঠিক আছে, তোমাকে কাটতে হবে না, আমাকে দেখিয়ে দাও কোথায় রসুলাল্লাহ শব্দটা লেখা আছে, আমি নিজেই কেটে দিচ্ছি। এই বলে আল্লাহর রসুল নিজেই চুক্তিপত্র থেকে শব্দটি কেটে ফেললেন।

পাঠক, যে শব্দটিকে প্রতিষ্ঠার জন্য এত সংগ্রাম, এত চেষ্টা চলছে, সেই সত্য কথাটাও আল্লাহর রসুল নিজের হাতে কেটে দিলেন কেন? অন্য কোনো কারণ নেই, এই ছাড়টা আল্লাহর রসুল দিলেন যুদ্ধকে এড়ানোর জন্য, রক্তপাতকে এড়ানোর জন্য। বিরোধী মতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য, শত্রুতা এড়ানোর জন্য আল্লাহর রসুল কতটা আন্তরিক ছিলেন তার ঐতিহাসিক সাক্ষী হয়ে আছে হুদাইবিয়ার এই সন্ধি। বলা বাহুল্য, রসুলাল্লাহর জীবনের এই একটি সিদ্ধান্তই আমরা ইতিহাসে পাই, যার সঙ্গে সাহাবিরা সর্বসম্মতভাবে একমত হতে পারেননি। এমনকি উমর (রা.) এর মতো সাহাবি, যিনি ছিলেন রসুলাল্লাহর ঘণিষ্ঠ সহচর, সার্বক্ষণিক সঙ্গী, তিনি সরাসরি নিজের অমতের কথা রসুলকে জানিয়েছিলেন। সবাই এই সন্ধিকে মো’মেনদের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেছিলেন। কারণ সন্ধির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রসুলাল্লাহ এত বেশি ছাড় দিয়েছিলেন যেন মনে হচ্ছিল যে কোনো মূল্যে তিনি চাচ্ছেন মক্কার মোশরেকদের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে এবং আরবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে। এসময় আল্লাহ পবিত্র কোর’আনের আয়াত নাজেল করে ঘোষণা করেছিলেন- এই সন্ধি মো’মেনদের জন্য অবমাননাকর তো নয়-ই, বরং স্পষ্ট বিজয়। সেটা কীভাবে তা পরবর্তী ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। সে আলোচনায় আজকে যাচ্ছি না।

ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার সন্ধি বিরাট এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হয়ে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। এই তাৎপর্য শুধু ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের আরবের জন্যই নয়, বর্তমান সময়েও সমানভাবে অনুভূত হয়। আজকের যুগে বরং আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এই ঘটনার শিক্ষা আমাদের সবাইকেই ধারণ করা উচিত। বিশেষত দু’টো শ্রেণির জন্য এই শিক্ষা বেশি জরুরি।

১. ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী- যারা ইসলামকে ভিন্নমতের প্রতি ও ভিন্নবিশ্বাসের প্রতি আগ্রাসী চরিত্রের আদর্শ বলে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে থাকে।

২. ধর্মান্ধ গোষ্ঠী- যারা ভিন্নমত ও ভিন্নবিশ্বাসের প্রতি সামান্য ছাড় দিতেও নারাজ। যারা মনে করে পৃথিবীতে শুধু তাদের মতো করে যারা চিন্তা করে ও বিশ্বাস করে তাদেরই বসবাসের অধিকার আছে, অন্য কারো অধিকার নেই। অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করেই তারা ক্ষান্ত নয়, নিজ ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও বিশ্বাসের একটু হেরফের হলেই তারা চরম অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেয় এবং হামলা চালিয়ে নির্দোষ মানুষদের হত্যা করতে কার্পণ্য করে না।

এই দুই গোষ্ঠীর জন্য ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ফুটে আছে হুদাইবিয়ার সন্ধির শিক্ষা। আল্লাহ এমনি এমনি বিশ্বনবীকে মানবজাতির উত্তম আদর্শ বলেননি। তিনি ছিলেন এমন একজন মহামানব, যার জীবনের প্রতিটি ধাপেই রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম শিক্ষা। তিনি সারা জীবন আদর্শের প্রশ্নে আপস না করে সংগ্রাম করে গেছেন এবং মানুষকে শিখিয়েছেন কীভাবে সত্যকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালাতে হয়। আবার তিনি ভিন্নমত ও ভিন্নবিশ্বাসের সঙ্গে অহেতুক শত্রুতা না করে তাদেরকেও কীভাবে কাছে টানা যায়, কীভাবে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করা যায় সেই রাস্তাও দেখিয়ে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের অন্ধ চোখ নবী-জীবনীর পুরোটা দেখতে পায় না। আমাদের দৃষ্টিতে তার আকাশের মত বিশাল জীবনের একটি দুইটি খণ্ডচিত্র মাত্র ধরা পড়ে এবং সেটুকু দিয়েই আমরা বিশ্বনবীকে পরিমাপ করার চেষ্টা করি। একশ গ্রাম বাটকারা দিয়ে এভারেস্ট পর্বতের ওজন পরিমাপের সে কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আমাদের!

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...