আবু ফাহাদ
(পূর্ব প্রকাশের পর) বেশিদিন আগের কথা নয়, ছাত্ররা তাদের শিক্ষকদেরকে অপরিসীম শ্রদ্ধা করত, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করত। সেখানে আজকের অধিকাংশ ছাত্র শিক্ষকদেরকে ভক্তি করে না, স্বাভাবিক ভদ্রতাটুকুও প্রায় বিলুপ্তির পথে। শিক্ষা আজ বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে যা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের জন্য কিনে থাকেন। বাণিজ্যিক লেনদেনে ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কোনো স্থান থাকে না, আত্মা থাকে না। শিক্ষাক্ষেত্রেও তাই। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদেরকে রাস্তায় বসে অনশন করতে হয়, কাফনের কাপড় পরে মিছিল করতে হয় সবশেষে পুলিশের পিটুনি খেয়ে, টিয়ার গ্যাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চোখের পানি ফেলে বাড়ি ফিরতে হয়।
পক্ষান্তরে প্রকৃত ইসলাম যখন ছিল তখন শিক্ষক মানুষকে শিক্ষা দিতেন আল্লাহর ইবাদত মনে করে। তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞানকে অপরকে শিক্ষা দেওয়া মানবজাতির প্রতি নিজের কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা (Duty and Responsibility) বলে মনে করতেন। শিক্ষকের সম্মান কেমন ছিল তা জানা যায় মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের একটি ঘটনা থেকে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন কিন্তু প্রকৃত ইসলাম ছিল না, প্রকৃত ইসলাম হারিয়ে গেছে রসুলাল্লাহর ওফাতের ৬০/৭০ বছর পরেই। প্রকৃত ইসলাম না থাকলেও আল্লাহর আইন-কানুন মোটামুটি জাতীয়ভাবে মানা হতো। তখন ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তার একটি নমুনা উল্লেখ করছি। সম্রাট আওরঙ্গজেব একদিন তার পুত্রদের শিক্ষা-দীক্ষা কেমন হচ্ছে তা নিজ চোখে দেখতে যান। তিনি দূর থেকে দেখতে পেলেন তার পুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর শিক্ষক নিজ হাত দিয়ে নিজের পায়ের ধূলা-ময়লা পরিষ্কার করছেন। এ দৃশ্য দেখে পরদিন তিনি শিক্ষককে নিজের নিকট ডেকে পাঠান। তিনি শিক্ষকের কাছে আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন যে, তার পুত্র তো আদব কায়দা, গুরুজনদের সম্মান করা কিছুই শেখে নি। কারণ শাহজাদা যদি শিক্ষকের পদযুগল নিজের হাত বুলিয়ে পরিষ্কার করে দিত তাহলেই তার পুত্র সুশিক্ষাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে তৃপ্ত হতে পারতেন। শিক্ষাগুরুর এই সম্মান এক সময় আমাদের সমাজেও ছিল যা এখন কেবলই ইতিহাস। কারণ আল্লাহহীন শিক্ষাব্যবস্থা বা সিস্টেম সব মানুষকে এমন করে দিয়েছে।
অন্যদিকে প্রকৃত ইসলামে নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি সৃষ্টিশীল শিল্পকলার ব্যাপারেও আল্লাহর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই সকল প্রকার শিল্পে, সাহিত্যে, নতুন নতুন আবিষ্কারে মুসলিমরা সে সময় পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে উন্নীত হয়েছেন। অথচ এখন এসব কাজকে ধর্মজীবী আলেম মুফতি শ্রেণি মনগড়া ফতোয়া দিয়ে হারাম করে রেখেছেন। ইসলামের সরল নীতি হলো, বৈধ-অবৈধ নির্ধারণের বেলায় মানদ- হচ্ছে আল্লাহর আদেশ এবং নিষেধ অর্থাৎ আল-কোর’আন। রসুলাল্লাহ্ (সা.) জানতেন যে, তাঁর বাণীকে ভবিষ্যতে বিকৃত করা হবে, অনেক বৈধ বিষয়কে অবৈধ ঘোষণার জন্য সেটিকে তাঁর উক্তি বলে চালিয়ে দেওয়া হবে, তাই তিনি বলে গেছেন, আমি তোমাদের জন্য সেটাই হালাল করেছি যেটা আল্লাহ হালাল করেছেন, সেটাই হারাম করেছি যেটা আল্লাহ হারাম করেছেন। তিনি আরও বলেন, “আমার কোনো কথা কোর’আনের বিধানকে রদ করবে না, তবে কোর’আনের বিধান আমার কথাকে রদ করবে।” (হাদিস) সুতরাং যে কোনো জিনিস হারাম কিনা তা জানার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর কিতাব দেখতে হবে। কোর’আনে যা কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলো ছাড়া আর সবই বৈধ। এখন কোর’আনে দেখুন গান, বাদ্যযন্ত্র, কবিতা, চলচ্চিত্র, নাট্যকলা, অভিনয়, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ভাষ্কর্য্য নির্মাণ ইত্যাদি আল্লাহ হারাম করেছেন কিনা? যদি না করে থাকেন তাহলে এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আল্লাহ যেটিকে বৈধ করেছেন, সেটিকে কোনো আলেম, মুফতি, ফকীহ্, মুফাস্সির হারাম করার অধিকার রাখেন না। তবে এটা সত্য যে, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা মনুষ্যত্বের অধঃপতন ঘটায়, আর যা মানুষের ক্ষতির কারণ হয়, সেগুলিকে কোনো ধর্মই বৈধতা দিতে পারে না। সুতরাং কেবল শিল্পে, সাহিত্যে নয়, অশ্লীলতা সর্বক্ষেত্রেই পরিত্যাজ্য। তাই বলে কাব্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাষ্কর্য, নৃত্যকেই একচেটিয়াভাবে নাজায়েজ বলা নিরেট ধর্মান্ধতা ও কূপম-ুকতা। মাথায় ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান নয় বরং সঠিক চিকিৎসা করাই কাম্য হওয়া উচিত।
মানবজাতির প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। আমাদের সমাজে এই নারীরা সর্বক্ষেত্রে পশ্চাদপদ, এর অনেকগুলি কারণের মধ্যে প্রধান একটি কারণ ধর্মীয় কুসংস্কার ও প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু প্রকৃত ইসলামে নারীকে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে সেটা মানবসৃষ্ট কোনো ব্যবস্থাতেই দেওয়া হয় নি। কিন্তু ইসলামের অন্যান্য সকল দিক যেমন হারিয়ে গেছে তেমনি নারীর সম্পর্কে ইসলামের সঠিক আকিদাও হারিয়ে গেছে। আজকে ইসলামের প্রতিটা দিক বিপরীত। সত্য ইসলামের নারী কেমন ছিল সেটা আজকের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। পরহেজগার নারী বলতেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত একজন নারী, যার সাত চড়েও কোনো রা নেই। সে এতই অবলা, সরলা যে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড় কোরিয়ে দিলে বাড়ি ফিরে আসতে পারে না, ঐখানে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে, স্বামীর সহায়তা ছাড়া সে এক কদমও চলতে পারে না, বাস থেকে নামতে পারে না, নিজের পোশাকের সঙ্গে আটকে যখন তখন হোঁচট খায়। এই নারীমূর্তি দেখেই মানুষ ভাবছে ইসলাম নারীকে বুঝি এভাবেই অথর্ব, জড়বুদ্ধি, অচল, বিড়ম্বিত করেই রাখতে চায়। অথচ প্রকৃতপক্ষে ইসলামে মেয়েদেরকে আবদ্ধ করে রাখারই কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহর শেষ রসুলের (সা.) সময়ে নারীরা জাতির প্রয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন:
নারীরা মহানবীর সামনা সামনি বসে আলোচনা শুনতেন, শিক্ষা গ্রহণ করতেন, মহানবীকে প্রশ্ন করে জরুরি বিষয় জেনে নিতেন, অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শও দিতেন। এ সময় মহানবী ও মেয়েদের মাঝে কোনো কাপড় টাঙানো ছিল এই ব্যাপারে কেউ কোনো দলিল দেখাতে পারবে না।
নারীরা মহানবীর (সা.) সাথে থেকে যুদ্ধ করেছেন, শত্রুদের হামলা করেছেন, আহতদের চিকিৎসা দিয়েছেন, নিহতদের দাফনে সহায়তা করেছেন। ওহুদের যুদ্ধে রসুলাল্লাহ যখন সাংঘাতিক আহত হন, তখন কাফেরদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে রসুলুল্লাহকে প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য তলোয়ার হাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন উম্মে আম্মারা (রা.)। পরবর্তীতে রসুলাল্লাহ বলেছিলেন, উহুদের দিন যেদিকে তাকাই কেবল উম্মে আম্মারাকেই (রা.) দেখতে পেয়েছি।” যে যোদ্ধাদেরকে তারা চিকিৎসা ও সেবা দিয়েছেন তারা কিন্তু অধিকাংশই ছিলেন আলেমদের ভাষায় “বেগানা পুরুষ”। মসজিদে নববীর এক পাশে তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা। এই বিশেষ চিকিৎসা ইউনিটে অধ্যক্ষ ছিলেন একজন নারী, রুফায়দাহ (রা.)। পক্ষান্তরে, ব্রিটিশ, আজকে যাদের জীবনব্যবস্থা দিয়ে দুনিয়া চলে তারা নারীদেরকে ভোটের অধিকার দিয়েছে ১৯২৮ সনে, এখনও একশ’ বছরও হয় নি। তারা সেনাবাহিনীতে মেয়েদের অন্তর্ভুক্ত করেছে তারও একশ বছর হয় নি। যুদ্ধাহতদের সেবা দেওয়ার জন্য ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে নার্সিং জগতে প্রায় দেবীর আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়, তাকে আধুনিক নার্সিং-এর পুরোধা বলা হয়, কিন্তু ১৪০০ বছর আগের রুফায়দাহর (রা.) কথা এ জাতিকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক যে, ধর্মব্যবসায়ী কুপম-ুক মোল্লাদের অপপ্রচারে প্রভাবিত এই জাতির লোকেরা মনে করে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা এসে নারীজাতিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে ধর্মীয় অন্ধত্ব, পশ্চাৎপদতা ও অশিক্ষার কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছে। কি নিষ্ঠুর পরিহাস!
নারীরা মহানবীর (স.) সময় যুদ্ধ চলাকালীন সৈন্যদের খাবার, পানীয় ও অন্যান্য রসদ সরবরাহ করেছেন।
মেয়েরা মসজিদের পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে, জুমা’র সালাতে, দুই ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতো। প্রকৃত ইসলামের জুমা কিন্তু বর্তমানের মতো মৃত জুমা নয়, সেই জুমা ছিল রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ের অংশ।
তারা পুরুষের সঙ্গেই হজ্ব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত, যেটা এখনও চালু আছে; যেখানে অত্যন্ত ভিড় ও ধাক্কাধাক্কির মধ্যে তাদেরকে হজ্ব করতে হয়। মনে রাখতে হবে, সেই হজ্ব কিন্তু বর্তমানের বিকৃত আকিদার শুধু আধ্যাত্মিক সফর বা তীর্থযাত্রা ছিল না, সেটা ছিল উম্মাহর বাৎসরিক মহাসম্মেলন। সেখানে একত্র হয়ে জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি বিষয়ে সর্বরকম সমস্যা, নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত হতো। হজ্ব ছিল একটি মহাজাতিকে ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখার একটি সুন্দর প্রক্রিয়া।
তারা কৃষিকাজে, শিল্পকার্যে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেছে, রসুলুল্লাহ্র প্রথম স্ত্রী আম্মা খাদিজা (রা.) একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন।
মূল কথা হচ্ছে, যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো বিপদসঙ্কুল এবং সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পুরুষ সাহাবীদের পাশাপাশি নারী সাহাবীরা অংশ নিয়েছেন, সেখানে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং অন্যান্য কাজে যে নারীদের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা কখনই পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। আবার পরবর্তীতেও ইসলামের স্বর্ণযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার লাভে নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখতে পাই। সুতরাং আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হলে নারীরা পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে জাতীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে নিশ্চিন্তে, নির্বিঘেœ যে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে তা ইতিহাস থেকেই প্রমাণিত হয়। (চলবে…)