আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সকল দেশে আজ একটি অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, আন্দোলন, ভাংচুর, হরতাল, জ্বালাও পোড়াও ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি হচ্ছে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। ক্ষমতাসীন একটা সরকারকে প্রবল আন্দোলন, জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানো হয়, আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তারা এসে আবার পূর্ববর্তী সরকারের মতই দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার ইত্যাদি করতে থাকে। সরকারের বিরুদ্ধবাদীর উপর চলে দমন পীড়ন আর পর্দার অন্তরালে চলে বৈদেশিক প্রভুদের মনোরঞ্জনের প্রতিযোগিতা। চলমান এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখে দেখে মানুষ বিরক্ত, হতাশ। কিন্তু তাদের কাছে কোন উত্তম বিকল্প নেই। তাই তারা একবার কড়াই থেকে চুলায় লাফিয়ে পড়ছে, আবার বাঁচার জন্য লাফিয়ে কড়াইতে উঠছে। এতে করে দিনে দিনে মানুষের যন্ত্রণা বাড়ছে এবং বাড়বে।
ঠিক অনুরূপ অবস্থা ছিল ইসলাম-পূর্ব আরবের। আরবের গোত্রগুলির মধ্যে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে রক্ত¶য়ী সংঘর্ষ বেঁধেই চলত, যা পুরুষানুক্রমে অব্যাহত থাকত। এই শত্রুভাবাপন্ন গোত্রগুলিই যখন আল্লাহর রসুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হলো, তখন তারা হয়ে গেল বিশ্বজয়ী একটি জাতি। প্রায় নিরক্ষর আরবদের থেকে এমন একটি জাতির উন্মেষ ঘটল যারা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে সকল জাতির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হলো। বাকি দুনিয়া সভয়-সম্ভ্রমে তাদের দিকে চেয়ে থাকত। রসুলাল্লাহর আনীত আল্লাহর দেওয়া সিস্টেম পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন মানুষগুলোকে ভাই বানিয়ে ফেলল। আধ্যাত্মিক উন্নতির ফলে প্রতিটি মানুষ একেক জন সোনার মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। চুরি, ডাকাতি প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। অভাব, অনটন, দারিদ্র্য দূর হয়ে সমাজে সমৃদ্ধি আসলো। আজ আমরা রসুলাল্লাহর যে সাহাবীদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে জানি, তাঁরা ইসলাম গ্রহণের আগেও কি এমনই ছিলেন? না। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঠিক তাঁরাই একেকজন মহামানবে পরিণত হন। আজও আমরা তাদের নামের পরে বলি ‘রাদি আল্লাহু আনহুম’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাঁর প্রতি খুশি।
বর্তমানের প্রেক্ষাপটেও আমাদেরকে সকল সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে আল্লাহর দেওয়া সেই অপরূপ, নিখুঁত সিস্টেমটি। তাই মানবজাতির প্রতি আমাদের আহ্বান- আসুন, আমরা বার বার ব্যক্তিকে পাল্টানোর চিন্তা না করে সিস্টেমটাই পাল্টাই। আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমই পারে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার ও পাপাচারের সব পথ বন্ধ করে দিতে। সেই সিস্টেম বাস্তবায়নের ফলে আজকের ঘুঁণে ধরা সমাজের অসৎ মানুষগুলিই একেকজন সোনার মানুষে পরিণত হবে ইনশা’আল্লাহ।
আমাদের সমাজে একটি কথা চালু আছে, “আগে নিজে ভালো হন, তারপর দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে”। এই কথাটি সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। কারণ একটি জীবনব্যবস্থায় মানুষের সামষ্টিক জীবনের গুরুত্ব সর্বাধিক। ব্যক্তি কখনও সামষ্টিক সিস্টেমের বিরদ্ধে পথ চলতে পারে না। জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনের চাপে ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে। বিশাল এক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যমুনা নদীর তুলনায় এক টুকরো শোলার মতো। সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়, সেটা দ্বারা ব্যক্তিও কমবেশি প্রভাবিত হতে বাধ্য। কাজেই জাতীয়ভাবে আজ আমাদের এমন একটি সিস্টেম দরকার যেখানে শত চেষ্টা করেও কেউ ঘুষ খেতে পারবে না, অন্যায় করতে পারবে না, ওয়াদা খেলাফ করতে পারবে না; কেউ বিপুল সম্পদের মালিক হবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় ঘুমাবে এমন অবিচার সৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনাও যেখানে থাকবে না। এজন্য আমাদের এই সিস্টেমকে পাল্টাতে হবে।
প্রশ্ন হলো, এমন সিস্টেম কোথায় পাওয়া যাবে? এর উত্তর হলো, স্রষ্টা আল্লাহর দেওয়া দীনুল হক, সত্য জীবনব্যবস্থাই হচ্ছে সেই সিস্টেম। মানুষ নামক এই প্রাণী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, কাজেই কোন রাস্তায় বা সিস্টেম-এ সে সুখে থাকবে সেটা ভালো জানেন মহান আল্লাহ। আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমই হচ্ছে সরল পথ, কাজেই এর নামই আল্লাহ রেখেছেন সেরাতুল মোস্তাকিম বা সহজ-সরল পথ।
আল্লাহর অসীম দয়ায় সেই প্রকৃত, অবিকৃত ইসলামের জ্ঞান, আকিদা (Comprehensive Concept) আবার হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমাম, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি প্রকৃত ইসলামের যে রূপরেখা অঙ্কন করে গেছেন, আমরা যদি সে মোতাবেক আমাদের জীবন পরিচালিত করি, আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমষ্টিগত জীবনে পরিপূর্ণ শান্তিতে, প্রগতিতে বাস করতে পারব। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে, বর্তমানে তওহীদ ও জেহাদ-বিহীন, শুধুই ব্যক্তিগত কিছু আমলসর্বস্ব বিকৃত বিপরীতমুখী যে ইসলামটা দুনিয়াতে চালু আছে আমরা সেই ইসলামের কথা বলছি না। আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত ইসলাম মহানবী যেভাবে পৃথিবীতে রেখে গিয়েছিলেন সেটি গত ১৩০০ বছরের কালপরিক্রমায় বিকৃত হতে হতে বর্তমানে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। তথাকথিত আলেম শ্রেণি এই বিকৃত ইসলামটিকে তাদের রুটি-রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। একদা লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ, অখণ্ড উম্মতে মোহাম্মদী আজ ফেরকা, মাজহাব, মাসলা মাসায়েল ইত্যাদির কূটতর্ক নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে; আরেকটি অংশ ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মানুষকে ইসলামের বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ ও উদাসীন করে তুলেছে। জাতির বৃহত্তম অংশটি শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঐ বিকৃত ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা করে যাচ্ছে। এর কোনটাই আল্লাহ, রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। কেননা ইসলাম শব্দের আ¶রিক অর্থই শান্তি। অর্থাৎ যারা ইসলামের অনুসারী হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা শান্তিÍÍতে থাকবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা ঠিক এর বিপরীত। আমরা হেযবুত তওহীদ আল্লাহর রহমে সেই প্রকৃত ইসলাম মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
মানুষের তৈরি করা বিভিন্ন রকম জীবনব্যবস্থা একটা একটা করে প্রয়োগ করে দেখা হয়েছে। রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে গেছে। দুনিয়াতে শান্তিÍÍ প্রতিষ্ঠায় এর প্রত্যেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। এখন অধিকাংশ রাষ্ট্রে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পরীক্ষা চলছে। এর ফলও আমরা দেখছি। পৃথিবী বর্তমানে গত এক বা দুই শতাব্দী আগের চেয়ে অনেক বেশি অন্যায় এবং অবিচারে পূর্ণ। গরীব ও ধনীর ব্যবধান অনেক বেশি প্রকট। মানুষে মানুষে সংঘর্ষ ও রক্তপাত বহুগুণে বেশি। গত এক শতাব্দীতেই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে কোটি কোটি লোক হতাহত হয়েছে। এই নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের একটি দিনও যায় নাই যেদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ, রক্তপাত চলে নাই। মানব জাতির এই সঙ্কটকালে আমরা হেযবুত তওহীদ এই ডাক দিচ্ছি যে, সবগুলি জীবনব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার পর স্রষ্টার দেওয়া জীবন বিধান মেনে নেওয়া ছাড়া শান্তি নিরাপত্তার আর কোন পথ নেই।