বর্তমানে মো’মেন, মুসলিম এবং উম্মতে মোহাম্মদীর দাবিদার এই জাতির আসল অবস্থান কোথায় তা নির্ধারণ করা অতি প্রয়োজন। এই অবস্থান নির্ধারণ করতে হলে সর্বাগ্রে আমাদের জানতে হবে মো’মেন, মুসলিম এবং উম্মতে মোহাম্মদী বলতে আসলে কী বোঝায়। আল কোর’আনে পাই- “মো’মেন হল তারাই যারা আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনার পর আর কোনো সন্দেহ পোষণ করে না এবং নিজেদের জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় (দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম) সংগ্রাম করে ( সুরা হুজরাত ১৫)।” আর মুসলিম হলো তারা যারা তাদের জাতীয় জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখে এবং সেই বিধান অনুযায়ী তাদের জাতীয় জীবন পরিচালনা করে। তবে উম্মতে মোহাম্মদী সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। যারা আল্লাহর রসুলের আনীত জীবনব্যবস্থাকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার পাহাড়সম দায়িত্বকে কাঁধে তুলে নিয়ে আমৃত্যু সংগ্রাম করে যাবে তারাই হলো উম্মতে মোহাম্মদী। এই দায়িত্বই হলো রসুলাল্লাহর সুন্নাহ যা ত্যাগ করলে কোনো জাতি আর রসুলের উম্মাহ থাকে না, রসুলও তাদের নেতা থাকেন না।
এই মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিচার করলে বর্তমানের এই মুসলিম নামধারী জাতির অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়? রসুলাল্লাহর উপর অর্পিত দায়িত্বকে যখন এই জাতি তাঁর ওফাতের ৬০/৭০ বছর পর জাতিগতভাবে ছেড়ে দিল তখন থেকেই আল্লাহর দৃষ্টিতে এদের মো’মেন এবং উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে কোনো পরিচয় রইল না। তারপর জাতীয় জীবন থেকে যখন আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বিদায় করে সেখানে রাজা বাদশাহদের সার্বভৌমত্বকে স্থান করে দেয়া হলো তখন থেকেই মূলত এই জাতি আর আল্লাহর চোখে মুসলিমই রইল না। তবে এই জাতির মুসলিম হিসেবে সর্বশেষ দাবিটুকুও মিথ্যা প্রমাণিত হলো তখন যখন তারা তাদের জাতীয় জীবনে আল্লাহর দেওয়া হুকুম-বিধানকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে সেখানে মানবরচিত বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্রকে স্থান করে দিল। ফলে আল্লাহর চোখে বর্তমানের এই জাতি না মো’মেন, না মুসলিম না উম্মতে মোহাম্মদী।
এতো গেল সংজ্ঞার উপর ভিত্তি করে এই জাতির মো’মেন, মুসলিম এবং উম্মতে মোহাম্মদী থেকে বহিষ্কৃত হবার কথা। আমার এই কথার সাথে অনেকে একমত হতে চাইবেন না তা আমি জানি। তারা অনেক রকম পাল্টা যুক্তি-তথ্য, ঘটনা তুলে ধরতে চাইবেন। তাদের কাছে আমি সবিনয়ে কয়েকটি কথা নিবেদন করতে চাই। এগুলো আমার কোনো সাজানো কথা নয়, এগুলো হলো আল্লাহর কথা। সেগুলো হলো-
(ক) মো’মেন জাতির কাছে আল্লাহ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাদের সর্ববস্থায় সাহায্য করার জন্য (সুরা রুম ৪৭)। শুধু সাহায্য করার নয় তাদের হাতে পৃথিবীর কর্তৃত্ব উঠিয়ে দেবার (সুরা নুর ৫৫)। যদি দেখা যায় যে মো’মেন হবার দাবিদার জাতিটির হাতে পৃথিবীর কর্তৃত্ব তো নেইই বরং সে জাতি অন্যান্য জাতির দাসত্ব করেছে এবং করছে, অন্যান্য জাতিগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এই জাতির মানুষগুলোকে অপমান করছে, লাঞ্ছিত করছে, তাদের গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে, বেয়োনেট দিয়ে, ট্যাংকের তলায় পিষে হত্যা করছে, তাদের মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে, তাদের ধর্ষণ করে হাজারে হাজারে গর্ভবতী করছে, তবে দু’টি সিদ্ধান্তের একটি সিদ্ধান্ত অবশ্যই নিতে হবে। হয় আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করছেন না বা করতে অক্ষম, আর না হয় মো’মেন হবার দাবিদার এই জনসংখ্যা মো’মেন নয়। যেহেতু আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, এটা অসম্ভব- কাজেই মো’মেন দাবিদার এই জনসংখ্যা মো’মেন নয় এবং মো’মেন নয় মানে অবশ্যই কার্যত মোশরেক ও কাফের। অন্য সিদ্ধান্ত অসম্ভব।
(খ) মহানবী (স.) কোর’আনের আয়াতগুলির কোনটার অর্থ, ব্যাখ্যা, মতভেদ, তর্কাতর্কিকে কুফর বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর জীবিতকালে তাঁর সাহাবাদের মধ্যে কোর’আনের আয়াতের অর্থ নিয়ে কোনো মতভেদ, তর্ক হয় নি, ফেকাহ নিয়ে আলাদা আলাদা দল (মাযহাব) গঠন তো চিন্তার বাইরে। কোনো সন্দেহ নেই যে কেউ ও রকম কোনো চেষ্টা করলে তিনি তাকে হত্যা করার হুকুম দিতেন। তাঁর ওফাতের বহু পরে যখন ঠিক ঐ কাজটাই করা শুরু হলো, তখন ওটা শুধু যে কুফর হলো তাই নয়, ওটা বেদা’ত অর্থাৎ শেরকও হলো, কারণ মহানবীর (স.) সময় ওটা ছিল না। সেই তখন থেকে ঐ কুফর, বেদা’ত ও শেরক আজ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। শুধু চলে আসছে না বিকৃত ও বিপরীত আকীদার ফলে ঐ শেরক ও কুফর মহা সওয়াবের, পূন্যের কাজ মনে করে করা হচ্ছে। যে জাতি বা জনসংখ্যা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে শেরক ও কুফর করে আসছে সেটাকে কার্যত কাফের ও মোশরেক বলায় ভুল কোথায়?
(গ) পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সময় হলে বিশ্বনবী (স.) বিদায় হজে তাঁর উম্মাহকে সেই সব ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে সব ব্যাপারে তাঁর অবর্তমানে উম্মাহর ভুল করার সম্ভাবনা ছিল। সেই সব ব্যাপারগুলির মধ্যে একটি ছিল নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত অর্থাৎ অনৈক্য। রসুল বলেছিলেন- এই দিন (হজের দিন), এই মাস (জিলহজ) ও এই স্থানের (মক্কা ও আরাফাতের ময়দান) পবিত্রতা একত্র করলে যতখানি পবিত্রতা জমা হয়, তোমাদের একের জন্য অন্যের জীবন, সম্পদ ও সম্মান ততখানি পবিত্র (হারাম)। সাবধান! সাবধান! আমার (ওফাতের) পর তোমরা একে অন্যকে হত্যা করে কুফরী করো না। আল্লাহর রসুল (স.) তাঁর জাতির উদ্দেশ্যে এই সাবধান বাণী একবার নয়, বারবার উচ্চারণ করেছিলেন। লক্ষ্য করুন, অনৈক্য, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষকে মহানবী (স.) কী বলেছেন! একে তিনি বলছেন কুফর। এ ইতিহাস কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে যে বিশ্বনবীর (স.) ওফাতের কিছু পর থেকেই এ জাতি নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল এবং পরবর্তীতে বহু মাযহাবে ও ফেরকায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছে এবং তারপর ঐ মহাপাপের শাস্তি হিসাবে আল্লাহ যখন এ জাতিকে ইউরোপের খ্রিষ্টান শক্তিগুলির গোলাম, দাস বানিয়ে দিলেন তখন এ জনসংখ্যা তাদের প্রভুদের রাষ্ট্রনীতি নকল করে চল্লিশটিরও বেশি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে কুফরীর যা কিছু বাকি ছিল সেটুকুও পূরণ করলো। কাজেই মুসলিম বলে পরিচিত এবং অজ্ঞানতার (জাহেলিয়াতের) অন্ধকারে বসে প্রচুর ইবাদতকারী এই জনসংখ্যাকে কার্যত কাফের আমি বলছি না, আল্লাহর রসুলই (স.) বলে গেছেন, আমি শুধু উল্লেখ করছি মাত্র।
(ঘ) এতো গেলো যুক্তির কথা। এবার প্রমাণ। আল্লাহ তাঁর কোর’আনে বলছেন- কাফেরদের দোয়া নিষ্ফল, ব্যর্থ (সুরা রা’দ ১৪, সুরা মো’মেন ৫০)। অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন কাফেররা যা দোয়া করে, যা চায় আল্লাহ তা মঞ্জুর করেন না। গত শত শত বছর ধরে এই জাতি কী কী দোয়া করে আসছে? একটা হলো- “হে আমাদের রব! আমাদের এই দুনিয়াকে সুন্দর কোরে দাও এবং আমাদের পরজীবনকে সুন্দর করে দাও (সুরা বাকারা ২০১)।” এই দোয়ার ফল কি বলে দিতে হবে? কয়েক শতাব্দীভর খ্রিষ্টানদের দাসত্ব এবং তারপর এখন আরও ঘৃণ্য অবস্থা। পৃথিবীর সর্বত্র পরাজয়, অপমান, নিগ্রহ তো আছেই তার উপর অন্যান্য প্রতিটি জাতি এই জাতি বা জনসংখ্যার মানুষদের হত্যা করছে, তাদের বাসস্থান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সেখান থেকে বের করে দিচ্ছে, তাদের মেয়েদের ধরে ধরে ধর্ষণ করে হাজারে হাজারে গর্ভবতী করছে, ট্যাংকের তলায় পিষে মারছে। একশ’ ষাট কোটি সংখ্যার জাতিটিকে পৃথিবীর অন্য কোন জাতিই এতটুকুও পরওয়া করছে না, অবজ্ঞা, বিদ্রƒপ করছে। এই দুনিয়াকে সুন্দর করার দোয়ার ঠিক বিপরীত ফল। আর যাদের এই দুনিয়া এই রকম তাদের ঐ দুনিয়া অর্থাৎ আখেরাতেও তাই, কঠিন আযাব। এই জাতির ঐক্যের জন্য দোয়া করা হচ্ছে এবং যতই করা হচ্ছে ঐক্য ততই ভাঙছে। এই জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য, শত্রুর বিরুদ্ধে জয়ের জন্য (“আলা কওমেল কাফেরিন”- সুরা বাকারা ২৮৬), এক কথায় এই জাতি আল্লাহর কাছে যা কিছুর জন্য দোয়া করে যাচ্ছে, হিসাব করে দেখুন তার প্রত্যেকটার উল্টো ফল হচ্ছে। ইরাক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সময় খ্রিষ্টান পাশ্চাত্যের তাবেদার পশ্চিম এশিয়ার আরব রাজতন্ত্র ও আমীরতন্ত্রের রাষ্ট্রগুলি ছাড়া বাকি মুসলিম দুনিয়া ইরাকের জয়ের জন্য আল্লাহর কাছে প্রাণপণে দোয়া করেছে, লক্ষ লক্ষ লোক নামাজ, রোজা মানত করেছে। ফল কী হয়েছে? সেই বিপরীত ফল হয়েছে, আল্লাহ ইরাককে লজ্জাকর পরাজয় দিয়েছেন। পরে ২০০৩ সালে আবার যখন যুক্তরাষ্ট্র তার দলবল নিয়ে ইরাক আক্রমণ করে তখনও আবার সারা পৃৃথিবীর মুসলিমরা মহাসমারোহে দোয়া করে। কিন্তু এবার পরিণতি হয় আরও নির্মম। পুরো দেশটাই এবার যুক্তরাষ্ট্রের পদানত হয়ে যায়, সাদ্দাম হোসেনকে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে হত্যা করে তারা নিজেদের আজ্ঞাবহ একটি সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠা করে। অর্থাৎ যে দোয়া করা হলো ঠিক তার উল্টো ফল পাওয়া গেল। কারণ যারা দোয়া করছিল এবং যাদের জন্য দোয়া করা হচ্ছিল দু’টোর কোনটাই মো’মেন নয়, এবং মো’মেন নয় অর্থই মোশরেক এবং কাফের। জাতি মো’মেন হলে, কার্যত মোশরেক ও কাফের না হলে উপসাগরীয় যুদ্ধ বা তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অবস্থাই সৃষ্টি হতো না।
আল্লাহ কোর’আনে বলছেন- “কাফেরদের দোয়া নিষ্ফল ও ব্যর্থ।” অর্থাৎ তাদের দোয়া আল্লাহ শুনবেন না, কোনো ফল হবে না। তা হলে যে জাতি বা জনসংখ্যার দোয়া, মানত তিনি যে শুধু শুনছেন না তাই না, যা যা দোয়া করা হচ্ছে সেগুলোর ঠিক বিপরীত ফল দিচ্ছেন সে জাতি বা জনসংখ্যা কি? কাজেই যু্িক্তজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মাত্রই অস্বীকার করতে পারবেন না যে এই জাতি এখন আর মো’মেন-মোসলেম বা উম্মতে মোহাম্মদী হবার দাবি রাখতে পারে না।
(সম্পাদনায়: মুস্তাফিজ শিহাব, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি)