হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আর হাতে রণতুর্য

হাসান মাহমুদ

“শ্রীহট্টের পূর্বদেশ নাম গোয়ার
একখানি দেশ সেই বড়ই বিস্তার
একদিকে জৈন্তা, হেড়ম্ব একদিকে,
মধ্যদেশে মুকুন্দ আকাক্সক্ষা কৈলা তাকে।
সমুদ্র তনয় গৌড় গোবিন্দ নামেতে
শ্রীহট্ট দেশের রাজা ছিলেন পর্বতে।”- পাগল ঠাকুর
“পুনির বিল ছাড়িয়া রাজা ছিলটেতে গেল,
অট্টনাথের পূজা দিয়া ঠাকুরালি পাইল।”- হট্টনাথের পাঁচালী

দেবতা হট্টনাথের দেশ শ্রীহট্টের রাজা গৌড় গোবিন্দ। গোঁয়ার গোবিন্দও বটে। গোঁয়ার না হলে এতটুকু রাজা পুরো বাংলার নবাব ফিরোজ শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যায়? আসলে একের পর এক যুদ্ধে জিতে তার আস্পর্ধা বেড়ে গেছে।

“গড়–ল রাজার কথা শুন মন দিয়া
সিংহের লগে যুদ্ধ করে তলোয়ার লইয়া।
বিদেশিয়া রাজার যত লোক লস্কর ছিল,
পুনি বিলের মধ্যে গড়–ল সবই ডুবাইল।
যুদ্ধ করি খাই (খাসিয়া) রাজারে বান্ধিয়া আনিল
পণ দিয়া খাই রাজা ফিরিয়া দেশে গেল।
জৈন্তা আর লাউড় গেলা আগে আগে ভাগি,
শত্রু শূন্য হৈল দেশ ডরাইব কার লাগি।”-পাগল ঠাকুর

খাসিয়া রাজ, জৈন্তা রাজ, লাউড় রাজ, সবাই পরাজিত। হবে না-ই-বা কেন? রাজ্য জুড়ে বালক-বৃদ্ধ সবাই জানে গোবিন্দর পোষা আছে দুটো অদৃশ্য দৈত্য। যাদুটোনারও রাজা গৌড় গোবিন্দ। অলৌকিক মন্ত্রতন্ত্রের অমোঘ মারণাস্ত্রের অধিকারী। তাছাড়া, এমন সুদক্ষ তীরন্দাজ ত্রিভুবনে নেই। চোখ বন্ধ করে শুধু শব্দ শুনেই তীরের লক্ষ্যভেদ এক মহাভারতের অর্জুন ছাড়া আর কে করেছে? সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে সে গড়ে তুলেছে বাংলার ইতিহাসে প্রথম তীরন্দাজ বাহিনী। ক্ষিপ্র ও দুর্দান্ত। সবচেয়ে দুর্দান্ত রাজা নিজেই। শাসনে নির্মম। সুকঠিন হাতে রাজ্যময় জনমনে কঠিন একটা মানসিক ত্রাস প্রতিষ্ঠায় সফল। সফল ও নিঃশঙ্ক।
“বাঘে গরুয়ে এক ঘাটে পানি খাইছে ডরে।” … “দুই যুগ রাজত্ব কইরল মনের সুখেতে।”
তা করুক। তাতে বুরহান উদ্দিনের কি আসে যায়? বহু জায়গা ঘুরে এসে সিলেটে সুখের নীড় বেঁধেছেন। দুঃখ শুধু একটাই। সন্তান নেই কোনো। চোখের জলে, প্রার্থনায়, জায়নামাজে কাটে সারারাত। যদি করুণাময়ের করুণা হয়। একটি যদি সন্তান আল্লাহ্ দান করেন, একটা গরু কোরবানী দেবেন বুরহান। হোক না গোবিন্দর রাজ্যে গো-হত্যা নিষিদ্ধ।
কি আশ্চর্য! করুণাময়ের করুণা সত্যি সত্যিই পুত্র সন্তান হয়ে নেমে এল বুরহানের দুঃখের ঘরে। সুখে আনন্দে বুরহানের চোখের পানি আর থামতে চায় না। গোপনে দিলেন গরু কোরবানী। সাথে সাথে ইতিহাসের দিক নির্ধারিত হয়ে গেল। গোমাংসের খবর পৌঁছে গেল রাজদরবারে। হিংস্র পশুর মতো ছুটে এল সেপাইয়ের দল। টেনে হিঁচড়ে বুরহানকে নিয়ে এল ক্রুদ্ধ গোবিন্দর সামনে। নিয়ে এল দুধের বাচ্চাটাও। হাত-পা নেড়ে সে বাচ্চা তখন নিশ্চয় খেলা করছে। আহা! তারপর। সবার সামনে অসহায় পিতার সামনে একটা ছোট্ট শরীর থেকে একটা ছোট্ট মাথা দ্বিখ-িত হলো। বাচ্চাটা বোধহয় কার্যকারণ কিছু বুঝতেও পারল না। শোকে পাগল-প্রায় বুরহানের ডান হাত দ্বিখ-িত করা হলো শরীর থেকে। সুকঠিন এ নাটকের অন্য অঙ্ক তখন অভিনীত হচ্ছে পাশের তরফ রাজ্যে, মোটামুটি একই সময়ে। সম্ভ্রান্ত মুসলমান কাজী নুরুদ্দীন ছেলের বিয়েতে জবাই করলেন গরু। প্রাণী হত্যার ঘোর বিরোধী বৈষ্ণব তরফরাজ আচক নারায়ণ গৌড় গোবিন্দর সম্বন্ধি। প্রাণদ-ে দ-িত হলেন নুরুদ্দীন।
শোকার্ত দুটো মানুষ। বুরহান আর নিহত নুরুদ্দীনের ভাই হেলিমুদ্দিন। হাহাকারে তাঁরা ভেঙে পড়লেন বাংলার নবাব ফিরোজ শাহের দরবারে। নবাব বিচলিত হলেন। যে কেউই হবে। বঙ্গবাহিনী নিয়ে সেনাপতি সেকান্দার শাহ্ বীরদর্পে ময়মনসিংহের পথে সিলেটের পাহাড় জঙ্গলে পৌঁছালেন এবং গৌড় গোবিন্দর দক্ষ তীরন্দাজ বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে ফিরে এলেন। এ হেন আক্রমণের কথা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। ওদিকে বিজয়োল্লাসে নেচে বেড়াচ্ছে গৌড় গোবিন্দ। তীর জিনিসটাকে পশুশিকার থেকে উন্নীত ক’রে যুদ্ধে ব্যবহার করছে সে। মহাভারতের পরে ব্যাপারটা এই প্রথম। এরপর থেকেই তীরের ব্যবহার আমরা দেখি বাংলার বিভিন্ন যুদ্ধে। ক্রোধ চরমে উঠল বঙ্গ সুলতানের। কিছুতেই এটা মেনে নেয়া যায় না। অতএব আবার সাজ-সাজ রব। প্রচুর আয়োজন। বিপুল বাহিনী। আবার সেই ময়মনসিংহের চেনা পথ। কিন্তু সিলেটে পৌঁছাবার আগেই পুরো আকাশ তোলপাড় হয়ে ভেঙে পড়ল সেকান্দার বাহিনীর মাথায়। বৃষ্টি তো নয়, যেন নদ-নদী-সমুদ্রের যাবতীয় পানি হুড়মুড় করে নামছে বিরাম-বিহীন। হ্যাঁচ্চো শব্দে প্রকম্পিত ধরণী। সর্দি-জ্বর। এবং নিমোনিয়া। এবং ডায়রিয়া। প্রায় অর্ধেক সৈন্য মরেই গেল।
ততদিনে ছোট্ট খবরটা সাপের মতো কিলবিলিয়ে ঢুকে গেছে সৈন্যদের মাথার ভেতর। বর্ষা-জ্বর-মহামারি এসব আর কিছুই নয়, সবই ওই গৌড় গোবিন্দর মন্ত্রবাণ। তার অদৃশ্য দৈত্যের অদৃশ্য আক্রমণ। মধ্যযুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বঙ্গবাহিনী ভয়ে সিটিয়ে গেল। সেই শঙ্কিত তালপাতার সেপাইগুলো নিয়ে গৌড় গোবিন্দর মুখোমুখি হলেন সেকান্দার শাহ্। এবং আবার চিৎপটাং হলেন।
চোখে ঘুম নেই নতুন সেনাপতি নাসিরুদ্দীনের। আবার বঙ্গবাহিনী তৈরি হয়েছে কিন্তু গৌড় গোবিন্দের মন্ত্রের ভয়ে কুঁকড়ে আছে সৈন্যরা। এ-রকম আধমরা একটা বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে যাবার মানে হয় না। এই মানসিক যুদ্ধটাই জিততে হবে প্রথমে। মন্ত্র-ভীতিকে পরাস্ত করতে হবে। রাজা ফেরাউনের দরবারে রাজ্যের যাদুকরদের বাঘ ভাল্লুক যখন হযরত মুসা (আ.) খেয়ে ফেলতে উদ্যত, তখন তাঁর হাতের লাঠি বিরাট সাপ হয়ে যাদুর সব বাঘ ভাল্লুককে গিলে ফেলেছিল। সেরকম একটা লাঠি চাই। যাদুসংহার লাঠি।
পাওয়া গেল। নাসিরুদ্দীন সোজা চলে গেলেন সাতগাঁও-এর কাছে ত্রিবেণীতে। এসে দাঁড়ালেন ভারত বিখ্যাত দরবেশের সামনে। জন্মসূত্রে অমিতবিক্রম শারীরিক শক্তির অধিকারী, তার চেয়ে বেশি আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান। লোকের মুখে মুখে ফেরে তাঁর অসাধারণ মোজেজার কাহিনী। বিশাল, বিপুল, সুউচ্চ পুরুষ। হযরত শায়খ জালাল উদ্দীন কুনাইবি। আমাদের শ্রদ্ধা পুরুষ হযরত শাহ্জালাল (রাঃ)। যুদ্ধের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁর পায়ে সমর্পিত করলেন নাসিরুদ্দীন। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা দরবেশের প্রচুর। শিষ্যেরা সবই দুর্মুখ যোদ্ধা। তাদের এক হাতে তসবিহ্ অন্য হাতে তলওয়ার। মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন তীক্ষèধী দরবেশ। পরাজয়ের কারণ বুঝতে দেরি হলো না। নতুন গ’ড়ে ওঠা তীরন্দাজ বাহিনী সাথে নিয়ে তাঁর বঙ্গবাহিনী দক্ষিণের ঘুরপথে চলে এল কুমিল্লা। শাহ্জালালের মোকাম জায়গায় রাত কাটিয়ে হবিগঞ্জের দক্ষিণ থেকে উত্তরমূখী অভিযান চালালেন দরবেশ।
টনক নড়ল গৌড় গোবিন্দর। দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসছে দরবেশের বাহিনী। তীরন্দাজ বাহিনীর জন্য ওদিকে জঙ্গলের আড়াল বলতে কিছু নেই। মারাত্মক অসুবিধেটা বুঝতে দেরি হলো না বুদ্ধিমান রাজার। তড়িৎগতিতে সরিয়ে ফেলল তিনটে নদীর প্রত্যেকটি নৌকা। খবর এল, একের পর এক নদী ফকিরের বিরাট বাহিনী জায়নামাজে বসে পার হয়েছে। ততদিনে ফকিরের বিপুল আধ্যাত্মিক শক্তির সামনে রাজার যাদুটোনা লোকের মুখে মুখে তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বুলন্দ দরবেশের বলিষ্ঠ ‘আল্লাহু আকবর’ গিলে ফেলেছে যত মন্ত্রশক্তি আর অদৃশ্য দৈত্যের মায়াত্রাস। থরহরি কম্পিত গোবিন্দর তীরন্দাজ বাহিনী খোলা ময়দানে এসে প্রচ- ধরা খেল তলোয়ারের কাছে। নিয়তির ইঙ্গিত বুঝতে সময় লাগল না রাজার। খবর পাঠাল পারিবারিক বিশাল ধনুকটায় যদি কোনো বঙ্গসৈনিক তীর লাগিয়ে ছুড়তে পারে, তবে আর যুদ্ধ নয়, রক্তক্ষয় নয়। রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন তিনি। ফকির কি রাজী আছেন?
অবশ্যই রাজী আছেন দরবেশ। চিরশত্রুর দেশ মক্কা কিভাবে রক্তপাতহীন জয় করেছিলেন মহানবী (দঃ) তা জানা আছে তাঁর। হাতির পিঠে পৌঁছে গেল শতাব্দী-প্রাচীন বৃহৎ অস্ত্রটা। দরবেশের দোয়া নিয়ে সর্বশক্তিমানের নাম নিয়ে বিশাল ধনুকে বিরাট তীর জুড়ে ছুড়লেন নাসিরুদ্দীন। বিজয় সম্পূর্ণ হলো। গোবিন্দর সেনাপতি মনা রায় নিহত হলো। বিজয়ী দরবেশ প্রবেশ করলেন সিলেটে।

গাজী সাহেবের নাম শেখ সেকান্দার
১৪ বছর যুদ্ধ করিল কুড়–লির ভিতর
অগ্নিবাণ খাইয়া ব্যাটা শেখ সেকান্দার গেল পলাইয়া,
কুবাইস্তানে শাহ্জালালরে লইয়া আইল গিয়া।
এইবার হইল ল্যাটা গোড়ল রাজার,
ছড়াছড়ি পাড়াপাড়ি সুরমা গাঙের পাড়
অগ্নিবাণের ভটটানি দৈত্য জানা ভাগে,
কোমর বান্ধিয়া রাজা খাড়া হইল আগে।
আচম্বিতে শুনিল রাজা মনা রায় মৈল
আশা ছাড়িয়া তখন জঙ্গলেতে গেল।

১৩০৩ খ্রীষ্টাব্দের কথা সেটা। ব্যাপার-স্যাপার দেখে আচক নারায়ণ গাট্টি বোঁচকা বেঁধে তৈরি হলেন এবং বঙ্গবাহিনী তাঁর দিকে রওনা হতেই মথুরার দিকে ‘দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড়’।
আবদুল মান্নান তালিবের “বাংলাদেশে ইসলাম” ইত্যাদি গ্রন্থে যে তথ্য পাওয়া যায় সেখানে আমরা দেখতে পাই যে এই একই ঘটনা ঘটেছিল সেই সময় বাংলার প্রায় সব অঞ্চলেই।
যেমনঃ

  • হজরত শাহ জালাল (রা.)- পরাজিত করেন – গৌড় গোবিন্দকে – সিলেট।
  • হজরত শাহ মাহমুদ (রা.) – পরাজিত করেন – বিক্রমকেশরীকে
  • হজরত জাফর খাঁ গাজী (রা.) – পরাজিত করেন – মান-নৃপতিকে-দিনাজপুর।
  • হজরত পীর বদরুদ্দীন (রা.) – পরাজিত করেন – রাজা মহেশকে – দিনাজপুর।
  • হজরত শাহ বদরুদ্দীন (রা.) – পরাজিত করেন – মগ দস্যুদের – চট্রগ্রাম।
  • হজরত সুলতান বলখী (রা.) – পরাজিত করেন রাজা বরামকে – হরিরামপুর এবং রাজা পরশুরামকে – মহাস্থানগড়, বগুড়া।
  • হজরত কাত্তাল পীর (রা.) – পরাজিত করেন – মগ দস্যুদের – চট্টগ্রাম।
  • হজরত বড়খাঁ গাজী (রা.) – পরাজিত করেন – মুকুট রায়কে – যশোহর।
  • হজরত শাহ নেকমর্দান (রা.) – পরাজিত করেন – ভীমরাজকে – দিনাজপুর।
  • হজরত চিহিল গাজী (রা.) – পরাজিত করেন হিন্দু জমিদারদেরকে – দিনাজপুর।
  • হজরত গাজী বাহাদুর (রা.) – পরাজিত করেন হিন্দু জমিদারদেরকে – সিরাজগঞ্জ।
  • এবং হজরত শাহ মখদুম (রা.) জয় করেছিলেন রামপুর – বোয়ালিয়া (রাজশাহী)।

সূত্রঃ

  1. উমদাত আল্ সালিক – ইমাম শাফি
  2. দ্য ফোর ইমামস্ – মোঃ আবু যাহরা
  3. পলিটিক্যাল থ’ট অব্ ইবনে তাইমিয়া – প্রফেসর কামরুদ্দীন খান

সুফী দরবেশরা বাংলায় এলেন এবং শুধুমাত্র চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই বাংলায় মুসলিম মেজরিটী করে ফেললেন, কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। নজরুলের ভাষায় (তাঁদের অনেকেরই) “এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর অন্য হাতে রণতূর্য”। একই কাহিনী বগুড়ার বিখ্যাত সুফী মাস্তান শাহ্ (রা.) কিংবা রাজশাহীর শাহ্ মখদুম (রা.)-এরও।
ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের হাতেও কি অস্ত্র ওঠেনি একাত্তরে?

[হাসান মাহমুদ- ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, মুসলিমস রিফর্ম মুভমেন্ট ও আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...