বর্তমানে আমরা যে সময়টা অতিক্রম করছি এই সময়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যাসহ বিজ্ঞানের শাখাগুলোতে মানবজাতি এত উন্নতি-অগ্রগতি সাধন করেছে যে, বিজ্ঞানটাই মানুষের জীবনের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে লক্ষ লক্ষ বছরের মানবজাতির ইতিহাসে মানুষের জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব এত বেশি ছিল না। তখন মানুষের দীর্ঘ আয়ুষ্কাল, সামষ্টিক জীবনের ন্যায়-নীতিবোধ, ধ্যান-ধারণা, জীবনব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে ধর্ম দিয়ে। যখন ধীরে ধীরে মানুষ বিজ্ঞানের যুগে প্রবেশ করেছে, যান্ত্রিক প্রগতি ঘটিয়েছে তখন ধর্ম গৌণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত পাঁচশ বছর ধরে পাশ্চাত্যের হাত ধরে যে ধর্মহীন সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছে এই সভ্যতা সামরিক শক্তিবলে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। এই ধর্মহীন সভ্যতা মানবজাতিকে এমন একটি পর্যায়ে উপনীত করেছে যে, সেখানে বাস্তবজীবনে ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই। যারা পশ্চিমা সভ্যতার ধারক-বাহক তাদের মতে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে ধর্ম অচল। নৈতিকতার বিকল্প উৎস থাকতে পারে, তার জন্যও ধর্মের প্রয়োজন নেই। তারা ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। ধর্ম থাকবে নাকি বিজ্ঞান থাকবে এ নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন, বার্ট্রান্ড রাসেলসহ আরো বহু বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিকগণ। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তারা ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ম কখনোই গৌণ বিষয় ছিল না। ধর্মই ছিল জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, মুখ্য বিষয়। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মানুষ ধর্মভিত্তিক জীবন পরিচালনা করেছে। ধর্ম দিয়ে মানুষ শান্তি পেয়েছে, মানুষের ভিতরে মানবতাবোধ জাগ্রত হয়েছে। কিন্তু এই যুগে এসে মানুষের জীবন থেকে ধর্মের প্রভাব মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে, ‘অবৈজ্ঞানিক’ আখ্যা দিয়ে ধর্মকে নাকোচ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী। তাদের বিশ্বাস মুছে দিতে না পেরে শেষতক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এটাই হয়েছে যে, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে থাকুক। যে যার মতো ধর্ম পালন করবে, উপাসনা করবে, কেউ আল্লাহকে ডাকবে, কেউ ভগবানকে ডাকবে, কেউ মসজিদে যাবে, কেউ মন্দিরে যাবে কিন্তু তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা চলবে মানুষের তৈরি করা জীবনবিধান দিয়ে। না, যে কোনো মানুষের তৈরি করা হলে চলবে না, পাশ্চাত্য সভ্যতার তৈরি করা জীবনবিধান, আইন-কানুন হতে হবে সেটা। আজ তাই কিন্তু হচ্ছে, অর্থনীতি চলছে পুঁজিবাদ দিয়ে, দেশ চলছে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্রসহ মানুষের তৈরি তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ও সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের কোন প্রভাব থাকছে না।
আমাদের দেশেও এই চর্চাটাই হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মহীন এই সভ্যতা আমাদের কতটুকু ভালো রেখেছে? আমরা যদি আমাদের অতীতের দিকে তাকাই তাহলে এই হিসাবটা সহজেই বুঝতে পারবো। আজকে পাশ্চাত্য সভ্যতা যে পদ্ধতিটা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এ প্রক্রিয়ায় ধর্মকে কি আমারা ব্যক্তিগত জীবনে আটকে রাখতে পারছি? পারছি না। আমরা সেটা করার যতই চেষ্টা করি না কেন একটি শ্রেণি ধর্মকে অশান্তির বিরাট কারণে পরিণত করেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের দেশে রাজনীতি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে দেশে ২৪ হাজার হামলা হয়েছে শুধু মন্দিরে। হামলা চালিয়েছে কারা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত নয় বছরে এই সাম্প্রদায়িক হামলার সংখ্যা কিছুটা কমলেও সংখ্যাটা বেশ বড়ই, ৩৯৮৯টি। সংখ্যালঘুদের উপর এই হামলাগুলো যখন হয় তখন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তারা সংখ্যাগুরুদের বিপক্ষে যেয়ে কিছু বলতে পারেন না, কারণ ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে গেলে ভোট কমে যাবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেখুন, আমরা ধর্মের ভিত্তিতে বিশ্বে ১৮০ কোটি মুসলিম। এই মুসলিম জাতির উপরে অন্যান্য ধর্মভিত্তিক জাতিগুলো তারা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে একের পর এক দেশ ধ্বংস করছে। তাদের বিভিন্ন অভিসন্ধি থাকে কিন্তু গোড়ার কারণ ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা ইরাকে হামলা চালিয়ে দশ লক্ষ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করলো, সিরিয়াতে পাঁচ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলল, আফগানিস্তানকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হলো। বর্তমানে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর চলছে জাতিগত নির্মূল অভিযান। গাজার মুসলমানদের উপর চরম নৃশংসতা ও পৈশাচিকতায় মেতে উঠেছে ইসরাইলিরা। দুনিয়াজোড়া আজকে এগারো কোটি মানুষ উদ্বাস্তু, যার সিংহভাগ মুসলমান। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ তার পিছনে মূল বিষয়। অর্থাৎ মুখে ধর্মকে ব্যক্তিজীবনে নির্বাসন দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের জাতীয় জীবনে ধর্ম একটি বড় ইস্যু। তাই এ ইস্যু নিয়ে আমাদের সাধারণ জনগণকে ভাবতে হবে। কেননা যে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আমরাই আক্রান্ত হই। তাই আমাদের এখন চিন্তা করতে হবে যে আমরা কিভাবে জীবন পরিচালনা করব?
এজন্য প্রথমে আমাদের সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে আমাদের কোনো স্রষ্টা আছেন নাকি নেই? যদি স্রষ্টা থাকেন তাহলে আমাদের জীবনপদ্ধতি হবে একরকম, আর যদি না থাকেন তাহলে হবে আরেকরকম। যদি স্রষ্টা থেকে থাকেন তাহলে মানতেই হবে তিনি মহাজ্ঞানী। তাই আমাদের তাঁরই আনুগত্য করতে হবে, তাঁর দেখানো পথেই চলতে হবে। আর স্রষ্টা না থাকলে আমরা নিজেদের ইচ্ছামত চলতে পারি। কাজেই এ প্রশ্নের সমাধান করে সেই মোতাবেক আমাদের পথচলা নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের সামনে মাত্র দুইটি পথ। একটি ন্যায়ের পথ আরেকটা অন্যায়ের পথ, একটি পাপের পথ, আরেকটি পুণ্যের পথ, একটি ডান – আরেকটা বাম। এই যে সকল ক্ষেত্রে দুইটা পরিণতি, দুইরকম অবস্থা এ ব্যাপারে কোন ধর্মেই দ্বিমত নেই। তাই বিধানও কিন্তু দুইটি, একটা হচ্ছে স্রষ্টার দেওয়া বিধান আরেকটা ইবলিশের দেওয়া বিধান। ইবলিশকে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্নভাবে আখ্যায়িত করা হয়, আল্লাহকেও বিভিন্নধর্মে বিভিন্নভাবে আখ্যায়িত করা হয়।
কথা হচ্ছে, এই দুইয়ের মধ্যে আমরা এখন কোনটাকে মেনে নিব? কেবল ব্যক্তিগত জীবনে নয়, আমাদের রাষ্ট্রীয়, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, আইন, বিচার, দণ্ডবিধি ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা ন্যায়ের পথ অবলম্বন করবো নাকি দুর্নীতির পথ বেছে নিব? আমরা কি স্রষ্টার দেওয়া পথ মেনে নিব নাকি নিজেরা পথ রচনা করবো? এই সিদ্ধান্ত এখন আমাদেরকে নিতে হবে। আমরা হেযবুত তওহীদ মানুষকে আল্লাহ অর্থাৎ স্রষ্টার বিধান মেনে নিয়ে সামষ্টিক জীবন পরিচালনা আহ্বান করছি। আমরা বিশ্বাস করি, যদি মানুষ স্রষ্টার দেওয়া জীবনবিধান মেনে নেয় মানুষের জীবনে ভারসাম্য, নৈতিকতা, মানবতাবোধ, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়, সুবিচার অর্থাৎ শান্তি আসবে। যেহেতু আমরা হেযবুত তওহীদ, তওহীদের আন্দোলন তাই আমরা ইসলাম ধর্মের কথাই বলছি। এতে সনাতন ধর্মের ভাইয়েরা ভাবতে পারেন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে তারা তো সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন, তারা বঞ্চিত ও শোষিত হবেন। ঠিক একইভাবে ভারতের প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের মনেও একই প্রশ্নটা চলে আসবে। তাহলে এর সমাধান কোথায়? সবার অধিকার রক্ষা হবে কোন পথে?
আমরা হেযবুত তওহীদ বিশ্বাস করি, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশে আমরা মানবজাতি এক জাতি, এক পরিবার। আমাদের সবার গোড়া এক, আমরা সবাই এক পিতামাতা আদম-হাওয়ার সন্তান। আমরা সবাই ভাই-ভাই। আমাদের মধ্যে গায়ের রঙে, ভাষায় বা ধর্মে যে ভিন্নতা, সেগুলো এসেছে ভৌগোলিক কারণে। সতেরো কিলোমিটার পর পর মানুষের ভাষায় পরিবর্তন আসে। যত দূরে যাবে ভাষায় তত পরিবর্তন আসবে। একসময় অন্য আরেকটা ভাষাই চলে আসবে। সব জায়গায় সমভূমি থাকে না, কোথাও থাকে জলাভূমি, কোথাও থাকে পাহাড়ি ভূমি। ঠিক একইভাবে সব মানুষের ভাষাও এক হবে না, গায়ের রঙও এক হবে না। এটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিতে হবে, এ নিয়ে বর্ণবাদ বা ভিন্ন জাতিসত্তা নামে বিভক্তি সৃষ্টি করাকে ইসলাম স্বীকার করে না। হাতের প্রতিটি আঙুলের আকৃতি আলাদা, নাম আলাদা। কিন্তু কোনো কিছু ধরার সময় তারা একসঙ্গেই কাজ করে, তারা একই হাতের অংশ। তেমনি অঞ্চলভেদে মানুষের পরিচয় ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তারা সবাই একই পরিবারের সদস্য। এ বিষয়ে আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, “হে মানব! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক ন্যায়-অন্যায় বুঝে চলে (সুরা হুজরাত ১৩)। সকল ধর্মেই মানুষের মধ্যে কেবল দুটো ভাগ আছে- ভালো মানুষ ও খারাপ মানুষ। এ ছাড়া মানুষে মানুষে আর কোনো বিভক্তি নেই।
কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশে যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে তিক্ততা আনছে তা অতীতে আমাদের দেশে ছিল না। হিন্দু এবং মুসলিম ভাই ভাই হয়েই একসাথে বসবাস করত। যখন মুসলিমরা প্রায় সাত/আটশো বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছে তখন এখানে এধরণের কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় নি। ক্ষমতার লড়াই হয়েছে যেমনটা সবদেশেই হয়। কিন্তু ধর্মীয় দাঙ্গা ছিল না। ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করার যে মানসিকতা এটা শিক্ষা দিয়েছে ব্রিটিশরা। তারা পরিকল্পিতভাবে ধীরে ধীরে শিক্ষাব্যবস্থা, পত্র-পত্রিকা, রাজনীতি ও লেখক-সাহিত্যিকদের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিমদের ভিতরে পারস্পরিক বিদ্বেষভাব প্রবেশ করিয়েছে। একে ব্যবহার করে তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটিয়েছে। এই সবই তারা করেছে নিজেদের স্বার্থে। কারণ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ থাকলে তারা দুশ বছর শাসন করতে পারত না। তাদের এই নীতির নাম ডিভাইড এন্ড রুল। তারা চলে গেছে, কিন্তু আমরা এখনও বিভক্তই রয়ে গেছি। আমাদের দেশের মাঝে প্রাচীর, মনের মাঝেও প্রাচীর।
কাজেই এখন, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে সকল ধর্মের অনুসারীদের উচিত বৃহত্তর কল্যাণের চিন্তা থেকে এই প্রাচীর ভাঙা। আমাদের দোষত্রুটি নিয়ে চিন্তা না করে, বিদ্বেষ লালন না করে ঐক্যের চিন্তা করা, বিভেদ ভুলে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা গড়ে তোলা। যদি আমরা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি তবে এই দেশও একদিন ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিনের মতো মাটির সাথে মিশে যাবে। আমরা বিভক্ত থাকলে অন্যরা আমাদের উপর ছড়ি ঘোরাবে।
প্রাচীনকাল থেকে এ ভারতবর্ষ ছিল মানবসভ্যতার লীলাভূমি, এখানেই প্রথম মানববসতি গড়ে ওঠে। ধর্মীয় রেফারেন্স বলে আদিপিতা আদম (আ.) দ্বিতীয় আদম নূহ (আ.) ভারতবর্ষেই এসেছেন। এখানে এত মানুষ, লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাস, এই জনপদে কি আল্লাহ নবী পাঠান নাই? পাঠিয়েছেন। যেখানে মানুষ থাকবে সেখানেই তো নবী আসবে। এটাই আল্লাহ বলেছেন যে, আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে, প্রত্যেক জনপদে স্থানীয় ভাষায় নবী-রসুল পাঠিয়েছি (সুরা নাহল ৩৬, সুরা কাসাস ৫৯, সুরা রাদ ৭)। এমন কোনো জাতি নেই, যার মধ্যে সতর্ককারী আসেনি। (সুরা ফাতির, আয়াত : ২৪)। কাজেই অন্যান্য জনপদের মতো ভারতবর্ষেও বহু নবী এসেছেন হয়তো ভিন্ন নামে, ভিন্ন পরিচয়ে। হয়তো তাদের নাম কোর’আনে আসে নি। এজন্য আজকে মুসলিমরা তাদের চিনতে পারছে না। এ কথাও আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে নবী! আমি তোমার আগে অনেক রাসুল প্রেরণ করেছি, তাদের কারো কারো ঘটনা তোমার কাছে বিবৃত করেছি এবং কারো কারো ঘটনা তোমার কাছে বিবৃত করিনি।’ (সুরা মুমিন, আয়াত : ৭৮)।
আমাদের গবেষণামতে, পৃথিবীতে টিকে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদ, যেটা বৈদিক সংস্কৃতি ভাষায় এসেছে। এই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর শিক্ষা এখনও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। আমরা যখন প্রাচীন এই ধর্মগ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করি তাহলে দেখতে পাই কোর’আনে যা আছে বেদেও সেই শিক্ষাই আছে। সমস্ত ধর্মের যে শিক্ষার ভিতরে অদ্ভুত মিল যা থেকে বোঝা যায়, ধর্ম আসলে একটিই। কেবল ভিন্ন যুগে, ভিন্ন ব্যক্তির উপর, ভিন্ন স্থানে ও ভিন্ন ভাষায় সেগুলো নাজিল হলেও তাদের শিক্ষা অভিন্ন। কালের কষাঘাতে সেই শিক্ষাগুলো বিকৃত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের নাম ও রূপ ধারণ করেছে। সবাই যার যার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করছে। যে অমিলগুলো সামনে আনা হয়, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে সেগুলো সবই বিকৃতির ফসল ও মূল সত্যের বিপরীত।
ইসলামের এক নাম দীনুল কাইয়্যেমা। শব্দটি এসেছে ‘কায়েম’ থেকে যার অর্থ শাশ্বত, সুপ্রতিষ্ঠিত, চিরন্তন, সনাতন জীবনব্যবস্থা। যে নীতি বা ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে সেটাই হচ্ছে সনাতন বা কাইয়্যেমাহ। সনাতন, ইসলাম ও সেমেটিক প্রতিটি ধর্মই মনে করে ঈশ্বর বা পরমাত্মা এক ও অখণ্ড সত্তা। ইসলাম বলে- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। সনাতন ধর্ম বলে- একমেবাদ্বীতিয়ম, একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি। যার অর্থ হচ্ছে- ব্রহ্ম একজন। তাঁর কোনো দ্বিতীয় নাই।
আমরা বিশ্বাস করি তওরাত আল্লাহর কেতাব যা মুসা (আ.) এর উপর অবতীর্ণ হয়। ঈসা (আ.) আল্লাহর নবী ছিলেন যাকে খ্রিষ্টানরা যিশু বলেন। তাঁর সম্পর্কে পবিত্র কোর’আনে ৯৯ টি আয়াত আছে। তাঁকে বলা হয়েছে পবিত্র আত্মার অধিকারী। তিনি বলেছেন, ঞযবৎব রং ড়হষু ড়হব খধমিরাবৎ ধহফ ঔঁফমব. (ঘবি ঞবংঃধসবহঃ: ঔধসবং ৪:১২). একইভাবে বুদ্ধের জীবনী পাঠ করলে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, তিনিও নবী-রসুলগণের মতই একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন। আমরা সেই সকল মহান শিক্ষকদের শিক্ষাকে অনুসরণ করে একত্রে পথ চলতে চাই।
সকল নবীর উম্মত যে মূলত একই উম্মত সেটা আল্লাহই পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, হে রসুলগণ! আপনাদের এ উম্মত তো একই উম্মত এবং আমিই আপনাদের রব; অতএব আমারই তাকওয়া অবলম্বন করুন। তারপর লোকেরা তাদের মাঝে তাদের দীনকে বহুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে উৎফুল্ল। (সুরা মুমিনুন ৫২-৫৩, সুরা আম্বিয়া ৯২-৯৩)।
এখন বিভিন্ন ধর্মের যারা গুরুজন, তারা যদি ধর্মগুলোর মধ্যে নিহিত মিলগুলোকে প্রচার করে সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করেন তাহলে এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব। কারো প্রতি কোন ঘৃণা, বিদ্বেষ লালন করা কোন নবী-রসুলের (সা.) শিক্ষা নয়। সর্বধর্মীয় মৈত্রীবন্ধন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ শেষ নবীকে (সা.) নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘হে নবী, আপনি বলুন, ‘হে কেতাবের অনুসারীগণ! এমন এক কথার দিকে আসো, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই, তা এই যে, আমরা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো ‘ইবাদাত করব না এবং কোনো কিছুকে তাঁর শরীক করব না এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের মধ্যে কেউ কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করব না। (সুরা ইমরান ৬৪)।
কাজেই সকল ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ইসলামের আহ্বান হচ্ছে এটাই যে, যে বিষয়টি আমাদের মধ্যে সাধারণ সেটা হচ্ছে একজন স্রষ্টার আনুগত্য করা, তাঁর এবাদত করা। এই একটি বিষয়ের ভিত্তিতে আমরা যেন একজাতি হই, কারণ সবার স্রষ্টা এক ও অভিন্ন। হেযবুত তওহীদ সকল ধর্মের অনুসারীদের কাছে এ প্রস্তাবই রাখছে। সমাজে শান্তি, ন্যায়, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানকে রুখে দেওয়ার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা হেযবুত তওহীদ অসাম্প্রদায়িক এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলারই আহ্বান করছি।
[লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, তিতুমীর কলেজ
যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]