রিয়াদুল হাসান
চলমান সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের গতিপ্রকৃতি ঘোষণা করছে এমন এক করুণ বাস্তবতা, যা সমস্ত পৃথিবীর মুসলিম নামধারী জাতিটির ভবিষ্যৎকে ভয়াবহ অন্ধকারে নিপতিত করেছে। মহামারীর মতো একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদ, যার পেছনে পেছনে রক্তলোলুপ সাম্রাজ্যবাদ তার ডালপালা বিস্তৃত করে রেখেছে। এই অশুভ শক্তির আঘাতে আজ ক্ষত-বিক্ষত ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া ও তুরস্কের মতো মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলো। জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়ে এসব দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে আনন্দ আর যাবতীয় মানবাধিকার। সেখানে জীবন বাঁচানোই দুরূহ, চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় লাশের স্তুপ, আকাশ থেকে পড়ে বোমাবৃষ্টি, প্রতিটি মুহূর্ত সেখানে বেঁচে থাকাটাই এক একটি আতঙ্কের নাম। ইরাক-সিরিয়া আর মায়ানমারের মাটি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া লক্ষ লক্ষ মুসলমানের ঈদ কাটছে শরণার্থী শিবিরের নোংরা পরিবেশে, উত্তাল সমুদ্রের বুকে, অথবা খুব ভালো হলে ফুটপাত-রাস্তাঘাটে। মুসলিম দুনিয়ায় এতবড় মানবিক বিপর্যয় ইতিহাসে দেখা যায় নি।
কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, এটা প্রমাণিত সত্য যে, বর্তমান পৃথিবীতে এক নম্বর ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জঙ্গিবাদ। আর জঙ্গিবাদ শব্দটি শুনলেই প্রথম যে নামটি মনে পড়ে তা ইসলামিক স্টেট, সংক্ষেপে আইএস। বিবিসির সাংবাদিক এন্ড্রু হোসকেনের ‘এম্পায়ার অব ফেয়ার: ইনসাইড দ্য ইসলামিক স্টেট’ শীর্ষক একটি বইয়ে ‘আইএস’ এর একটি কল্পিত মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। মানচিত্রে দেখা গেছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ‘আইএস’ ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ এলাকা দখলে নেওয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপের বেশ কিছু স্থানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছে।” এই মুহূর্তে তারা সিরিয়াতে কোনঠাসা হলেও জঙ্গিবাদীদের চিন্তার জগৎ থেকে এই পরিকল্পনাগুলো হারিয়ে যায় নি।
‘আইএস’ এর মূল শক্তি ইসলামের জেহাদী চেতনা। এই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তারা এতদূর এসেছে। যেইমাত্র রাষ্ট্রগঠন করার মতো ভূখণ্ড তাদের হাতে এসেছে, তারা বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলেছে, এবং সেটাকে তারা শরিয়তসম্মত ব্যবস্থা বলেই দাবি করেছে। সমগ্র বিশ্বের জেহাদী চেতনাধারী মানুষের কাছে আইএস প্রকৃতপক্ষেই দারুল ইসলাম বা ইসলামের ভ‚মি হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে। আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা সব জায়গা থেকে জেহাদীরা ইরাক-সিরিয়ার পানে ছুটে গেছে।
মুসলিম দুনিয়ায় পবিত্র কোর’আনের পরেই যে গ্রন্থ অবশ্যই মান্য বলে বিবেচিত হয় তা হাদিস। সেই হাদিস দেখে দেখে, শেষ যামানা সম্পর্কে রসুলের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে ‘আইএস’ যোদ্ধারা নিজেদের কর্মকাণ্ডকে এমনভাবে মিলিয়ে মিলিয়ে পদক্ষেপ ফেলছে যাতে আকিদাহীন মুসলিমমাত্রই বিভ্রান্ত হবেন। তারা তাদের খলিফার নামটি পর্যন্ত দিয়েছে হাদিস মিলিয়ে। ফলে অনেকেই ইসলাম ও মুসলিমদের দুর্দিনে ‘আইএস’কে তাদের পরিত্রাতা বলে ভাবছে।
১৫ কোটি মুসলমানের মাতৃভূমি হিসেবে বাংলাদেশও সমান জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তারা আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও ইসলামকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। এ অঞ্চলের মানুষের ধর্মের প্রতি টান হাজার বছর পুরানো। একে জীবন থেকে কোনোভাবেই আলাদা করা সম্ভব নয়। এই ধর্মবিশ্বাসকে অপপ্রয়োগের যে ধারা আমাদের দেশে রয়েছে সেটাই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য। মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখলকারী আইএস যোদ্ধারা সারা বিশ্বের জঙ্গি ও জঙ্গিসমর্থকদের ‘হিরো’তে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ কথিত জেহাদের নেশায় ছুটে গেছে ইরাক-সিরিয়ায়। কথিত ‘জেহাদী তামান্না’ বাংলাদেশের অনেক মানুষের মধ্যেও আছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিবাদ আমাদের দেশেও প্রভাব ফেলে এবং স্বপ্রণোদিত হয়ে বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তারা অনেকেই যুক্ত হয়ে সন্ত্রাসী হামলা গুলো করে থাকে।
আমরা জানি গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিষ্পেষণ থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যখন সমাজতন্ত্রের আবিষ্কার হলো, তখন সমাজতন্ত্রের মধ্যে মুক্তি আছে মনে করে পঙ্গপালের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ সমাজতন্ত্রের শিখায় ঝাঁপ দিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই তাদের স্বপ্নভঙ্গ হলো, তারা বুঝতে পারল যে তারা কড়াই থেকে লাফিয়ে চুলায় পড়েছে। এখন বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক হানাহানির বীভৎসতা থেকে মানুষ মুক্তি চাচ্ছে। এটাও চাচ্ছে কয়েক যুগ থেকে। সম্প্রতি ‘আইএস’ মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণীকৃত হাদিস (যদিও অনেক হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়ে হাদিসবেত্তাদেরই প্রচুর মতভেদ রয়েছে) মিলিয়ে মিলিয়ে ইসলামী খেলাফতের নামে এমন একটি কৃত্রিম কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল যে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে একটি বড় অংশ মনে করছে ‘আইএস’ এর মাধ্যমেই বিশ্বে শান্তি আসবে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে এবং পাশ্চাত্যের দুঃশাসন থেকে মানুষ চূড়ান্তভাবে মুক্তিলাভ করবে। সুতরাং এর দ্বারা এতে তারা একদিকে যেমন শান্তি পাবে, অন্যদিকে তারা উম্মতে মোহাম্মদী হতে পারবে, অর্থাৎ এটি তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। কিন্তু সম্প্রতি যে জায়গাগুলো তাদের হস্তগত হয়েছিল তার অধিকাংশই আবার দখলমুক্ত হয়ে গেছে। তাই বলে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যায় নি।
এমনিতেই বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার ঘটনা এ দেশে অহরহ ঘটে। এছাড়াও রয়েছে মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত অর্থোপার্জনের দৃষ্টান্ত। এক কথায় আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে থাকে এক শ্রেণির স্বার্থবাদী। তার উপর এই জঙ্গিবাদের অশুভ ছায়া। সরকার শক্তি প্রয়োগ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। অতি শক্তি সম্পন্ন গ্যাস বোতলে ঢুকিয়ে দিয়ে যেমন ছিপি দিয়ে আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, ঠিক সেরকম করা হয়েছে। ফলে যতটুকু উপশম হওয়ার হয়েছে, কিন্তু নির্মূল হয়ে যায় নি। ঝুঁকি থেকেই গেছে। ধর্মের বিবিধ অপব্যবহারের এই সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কী তা নির্দিষ্ট করতে হলে কীভাবে সিরিয়া বা ইরাকের মতো সমৃদ্ধ দেশগুলো ধ্বংস হলো সেটা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। যেদিন প্রথম সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে, কেউ কি ভেবেছিল তার পরিণতি এতদূর গড়াতে পারে? সিরিয়ানরা কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিল অচীরেই তাদের জীবন-সম্পদ নিয়ে পরাশক্তিগুলো নোংরা খেলায় মেতে উঠবে? বস্তুত তারা ছিল নির্বিকার। সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথমে জাতির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হলো, এখানে ওখানে বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘর্ষ হলো, সরকার দমন-পীড়ন চালাতে থাকল, আন্দোলনকারীরা ক্রমেই সহিংসতার পথে ধাবিত হলো, আর দেশের প্রায় প্রধান যে জনসংখ্যাটি তারা এসব কিছুকে অবলীলায় এড়িয়ে যেতে থাকল। তারা খবর পড়েছে, প্রাত্যহিক আহত-নিহতের পরিসংখ্যান দেখেছে, কিন্তু দেশের অতবড় বিপর্যয়কর মুহূর্তে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয় নি, জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হতে দেখেও সে দেশের সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও আপামর জনগণ মুখ বুঁজে বসে ছিল। হয়ত ভেবেছিল, এতে তাদের দায় নেই, সরকার ও সরকারবিরোধীদের বিবাদ তারাই মীমাংসা করুক। কিন্তু, তাদের সেই নি¯পৃহতা ও নির্লিপ্ততার পরিণতি তারা শেষাবধি এড়াতে পারল না। আজ যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভ‚মি সিরিয়া ছেড়ে অচেনা-অজানা দেশগুলোতে আশ্রয়ের আশায় ছুটে চলছে তারা কারা? তারা কি কেবলই নিম্নবিত্ত শ্রেণি? না, শুধু নিম্নবিত্তরাই নয়, প্রাণ বাচাতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে এককালের বাঘা বাঘা শিল্পপতিরাও। রয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক সকলেই। আজ তারা এক কাতারে এসে দাড়িয়েছেন। তাদের এক নামে ডাকা হচ্ছে। এক বিশেষণে বিশেষায়িত করা হচ্ছে। অথচ এই মানুষগুলোই যদি কয়েক বছর পূর্বেই যাবতীয় অন্যায়, অপশাসন, জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়াতে পারত, আজকের সিরিয়াকে এমন দুর্ভাগ্য বরণ করতে হতো না।
বাংলাদেশকেও যদি আমরা তেমন পরিণতি ভোগ করা থেকে ফেরাতে চাই, একমাত্র উপায় ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে ১৬ কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আর তার জন্য যে ঐক্যসূত্র প্রয়োজন তা আছে হেযবুত তওহীদের কাছে। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের ধর্মবিশ্বাসই বর্ম হয়ে যাবতীয় অপশক্তির কবল থেকে জাতিকে রক্ষা করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক এই ক্রান্তিকালে সমস্ত মুসলিম দুনিয়া যখন আক্রান্ত হয়ে পড়েছে বা আক্রান্ত হবার পথে, চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে মাতৃভূমি বাংলাদেশ, তখন আমরা হেযবুত তওহীদ হাজির হয়েছি এ জাতির মুক্তির বার্তা নিয়ে। তবে জাতি ঝুঁকিমুক্ত হবে কেবল তখনই যখন প্রতিটি মানুষ আমাদের উত্থাপিত ঐক্যসূত্রকে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন এবং ১৬ কোটি মানুষ নিজেদেরকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবে।