বর্তমানে আকিদা ও ঈমানকে একই জিনিস বলে মনে করা হয়। এই ধারণা ভুল। প্রথমত, ঈমান শব্দের অর্থ হলো বিশ্বাস আর আকিদা শব্দটি এসেছে আক্দ শব্দ থেকে যার মানে গ্রন্থি, গিঁঠ বা গেরো। আমরা এই শব্দটি বিয়েতে ব্যবহার করি। আক্দ করানো বলতে আমরা বোঝাই বিয়ে করানো, দু’টি মানুষকে গিঁঠ বা গেরো দিয়ে দেওয়া। ঐ আক্দ থেকে আকিদা। অর্থাৎ ঈমান ও আকিদা দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা শব্দ এবং সম্পূর্ণ আলাদা অর্থ। দ্বিতীয়তঃ আকিদা ভুল হোলে ঈমান অর্থহীন- এ কথাতেই তো পরিষ্কার হয় যে ঐ দু’টো এক জিনিস নয়। একটা ভুল হোলে অন্যটি অর্থহীন অর্থাৎ এক নম্বর ভুল হোলে দুই নম্বর অর্থহীন- কাজেই এ দু’টো বিষয় একই বিষয় হওয়া অসম্ভব। অথচ এই ভুল ধারণা আজ সর্বব্যাপী। এটা হয়েছে এই জন্য যে ইসলামের প্রকৃত আকিদা আজ অদৃশ্য হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে, তাই ওটাকে ঈমানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে- যদিও এ দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
এই দীনের সঠিক আকিদা এ রকম:
১. সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর এই বিরাট বিশাল মখলুক সৃষ্টি করলেন এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের ও পরিচালনার জন্য অসংখ্য মালায়েক বা ফেরেশতা সৃষ্টি করলেন। এই সৃষ্টির (মখলুকের) বা ঐ মালায়েকদের কোনো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ছিল না এবং নেই। যাকে যে কাজের জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করলেন বা যে কাজের দায়িত্ব দিলেন তারা নিখুঁতভাবে সেই কাজ করে চলল, যার সামান্যতম বিচ্যুতি নেই।
২. আল্লাহর ইচ্ছা হলো এমন এক সৃষ্টি করতে যে সৃষ্টির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকবে, যে ইচ্ছা করলে আল্লাহর দেয়া নিয়ম ও দায়িত্ব মোতাবেক চলবে, ইচ্ছা করলে তা অমান্য করতে পারবে।
৩. তাই আল্লাহ আদম অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টি করলেন। আদমের মধ্যে আল্লাহ তাঁর নিজের আত্মা (রূহ্) থেকে ফুঁকে দিলেন (সুরা হেজর ২৯) অর্থাৎ আদমের মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, যা আল্লাহ ছাড়া আর কারও নেই, তা এবং আল্লাহর অন্যান্য সকল সিফত্ বা গুণ প্রবেশ করিয়ে দিলেন। কাজেই এই নতুন অসাধারণ সৃষ্টির নাম দিলেন আল্লাহর খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি।
৪. একটা বিরুদ্ধশক্তি না থাকলে কোনো পরীক্ষা (Test) সম্ভব নয় তাই ইবলিস বা শয়তানকে এই খলিফার বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন এবং ঐ পরীক্ষার জন্য ইবলিসকে মানুষের দেহ মনের মধ্যে প্রবেশ ও তাকে প্রভাবিত করার অনুমতি ও শক্তি দিলেন (সুরা বাকারা ৩০)।
৫. ইবলিস আল্লাহকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহবান (Challenge) করলো এই বলে যে তোমার এই খলিফাকে আমি ফাসাদ অর্থাৎ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার এবং সাফাকুদ্দিমা অর্থাৎ যুদ্ধ-বিগ্রহ রক্তপাতের মধ্যে পতিত করব। আল্লাহ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে গ্রহণ করে বললেন- আমি আমার প্রেরিত নবী-রসুলদের এবং হাদীদের মাধ্যমে আমার খলিফা মানুষদের জন্য এমন জীবন-ব্যবস্থা, দীন পাঠাব যে জীবন ব্যবস্থা অনুযায়ী ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ সমষ্টিগত জীবন পরিচালিত করলে তারা ঐ ফাসাদ এবং সাফাকুদ্দিমায় পতিত হবে না, অর্থাৎ ন্যায় বিচার ও শান্তিতে (ইসলাম শব্দের আক্ষরিক অর্থই শান্তি) পৃথিবীতে বাস করতে পারবে। এখানে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, ইবলিস আল্লাহকে এ চ্যালেঞ্জ দিল না যে তোমার খলিফা, প্রতিনিধিকে আমি মসজিদে, গির্জায়, মন্দিরে, সিনাগগে, প্যাগোডায় যেতে বাধা দেব, তাদের হজ্ব করতে, রোযা রাখতে, যাকাত দিতে, দান-খয়রাত করতে বা অন্য যে কোনো পুণ্য কাজে, সওয়াবের কাজে বাধা দেব। সে এই চ্যালেঞ্জ দিল যে মানুষকে সে ফাসাদ এবং সাফাকুদ্দিমায় পতিত করবে। অন্যায়, অবিচার, অশান্তি এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ রক্তপাত, এ দু’টোই সমষ্টিগত ব্যাপার এবং ঠিক এ দু’টোই মানুষ সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত মানব জাতির সর্বপ্রধান সমস্যা হয়ে আছে যার সমাধান আজ পর্যন্ত করা যায় নি।
৬. মানুষ জাতিকে তাঁর দেয়া জীবন-বিধান পাঠিয়ে আল্লাহ মানুষকে বললেন- ইবলিস, শয়তান আমাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে সে তোমাদের দিয়ে আমাকে অস্বীকার করাবে, অর্থাৎ আমার পাঠানো জীবন-ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে তোমাদের নিজেদের দিয়ে জীবন-ব্যবস্থা তৈরি করিয়ে সেই মত তোমাদের সমষ্টিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত করাবে, যার ফলে তোমরা সেই ফাসাদ এবং সাফাকুদ্দিমায় পতিত হবে। তোমরা ইবলিসের প্ররোচনায় না পড়ে আমাকে একমাত্র জীবন-বিধাতা বলে গ্রহণ করো অর্থাৎ নবী-রসুলদের মাধ্যমে আমি যে জীবন-বিধান পাঠিয়েছি তা গ্রহণ ও সামগ্রিক জীবনে প্রয়োগ করো, তাহলে তোমাদের জীবন থেকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ইত্যাদি সমস্ত অন্যায়-অবিচার চলে যাবে এবং তোমাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত হবে না অর্থাৎ তোমরা পূর্ণ শান্তিতে (ইসলামে) বাস করতে পারবে। আমি সর্বশক্তিমান- আমি ইচ্ছা করলেই সমস্ত মানবজাতি ইবলিসকে অস্বীকার করে আমার পাঠানো দীনকে গ্রহণ করে শান্তিতে বাস করবে (কোর’আন- সুরা আনআম- ৩৫, সুরা ইউনুস- ১০০)। কিন্তু আমি তা করব না কারণ আমার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আমি তোমাদের দিয়েছি পরীক্ষা করার জন্য যে তোমরা কি করো (সুরা মোহাম্মদ- ৪)। তোমরা শয়তানের প্ররোচনায় পতিত না হয়ে আমাকে একমাত্র জীবন-বিধাতা বলে গ্রহণ করলে তার ফলস্বরূপ এ পৃথিবীতে যেমন শান্তিতে (ইসলামে) বাস করবে, তেমনি পরজীবনেও আমি তোমাদের জান্নাতে স্থান দেবো। তোমাদের ব্যক্তিগত সমস্ত গোনাহ আমি মাফ করে দেবো কারণ তাহলে ইবলিসের চ্যালেঞ্জে তোমরা আমাকে জয়ী করালে। আর যদি শয়তানের প্ররোচনায় আমার দেওয়া জীবন-বিধানকে অস্বীকার করে নিজেরা জীবন-ব্যবস্থা তৈরি করে নাও তবে তার ফলস্বরূপ তোমরা সর্বপ্রকার অন্যায় অবিচার আর রক্তপাতে ডুবে তো থাকবেই তার ওপর মৃত্যুর পর পরজীবনে আমি তোমাদের জাহান্নামের কঠিন শাস্তির মধ্যে পতিত করব। তোমাদের ব্যক্তিগত লক্ষ কোটি সওয়াব পুণ্যের দিকে আমি চেয়েও দেখব না। কারণ তাহলে ইবলিসের চ্যালেঞ্জে তোমরা আমাকে পরাজিত করে দিলে। এটা আমার প্রতিশ্রুতি।
৭. তাহলে দেখা যাচ্ছে মানব জাতির সম্মুখে মাত্র দু’টি পথ। একটি হচ্ছে নবী-রসুলদের মাধ্যমে পাঠানো জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ করা, অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ বলে স্বীকার করা, অন্যটি হচ্ছে ঐ জীবন-বিধান প্রত্যাখ্যান করে নিজেরা জীবন-ব্যবস্থা তৈরি করে তাই মেনে চলা। মানবজাতিকে এই দুই পথের একটাকে গ্রহণ করতে হবে, তৃতীয় কোনো পথ নেই। আল্লাহ বললেন, যে বা যারা প্রথমটি গ্রহণ করবে এবং তা থেকে বিচ্যুত হবে না তাদের কোনো ব্যক্তিগত গোনাহ, পাপ তিনি দেখবেন না, তাদের জান্নাতে স্থান দেবেন। আর যে বা যারা নবী-রসুলদের মাধ্যমে পাঠানো জীবন-বিধান অস্বীকার করে নিজেরা জীবন ব্যবস্থা তৈরি করে নেবে তাদের ব্যক্তিগত কোনো সওয়াব, পুণ্য তিনি গ্রহণ করবেন না, তাদের জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। এই যে সমষ্টিগতভাবে জীবন বিধানকে গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নে ব্যক্তিগত জীবনকে দাম না দেয়া, এর কারণ হচ্ছে, সমষ্টিগতভাবে আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান কার্যকর করলে সমাজ থেকে সবরকম অন্যায়-অবিচার, দুঃখ, যুদ্ধ ও রক্তপাত বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং ব্যক্তিগত অন্যায় প্রায় লোপ পাবে। আর মানুষের নিজের তৈরি জীবন-ব্যবস্থা চালু করলে, ব্যক্তিগতভাবে মানুষ যতো ভালো থাকার চেষ্টা করুক না কেন সমাজ সব রকম অন্যায়, অবিচার, অশান্তি ও রক্তপাতের মধ্যে পতিত হবে। উদাহরণ- বর্তমান সময়।
৮. আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ অর্থাৎ আদেশদাতা বলে গ্রহণ করা অর্থ জীবনের প্রতি বিভাগে, প্রতি স্তরে অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি প্রত্যেক অঙ্গনে গ্রহণ করা। এটাই হলো তওহীদ, সেরাতুল মুস্তাকীম, দীনুল কাইয়েমা। যে বা যারা এর উপর অনড় থাকবে, বিচ্যুত হবে না, তার এবং তাদের ব্যক্তিগত সমস্ত গোনাহ মাফ করে আল্লাহ তাঁর জন্য জান্নাত নিশ্চিত করে দিয়েছেন।
বিশ্বনবী এ কথাটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন এই বলে যে, আল্লাহর সাথে তাঁর বান্দার চুক্তি (Contract) এই যে, বান্দা তাঁর পক্ষ থেকে যদি এই শর্ত পালন করে যে, সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ অর্থাৎ বিধাতা বলে স্বীকার করবে না- তবে আল্লাহও তাঁর পক্ষ থেকে এই শর্ত পালন করবেন যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন [হাদীস- মুয়ায (রাঃ) থেকে বোখারী, মুসলিম মেশকাত]। এখানে অন্য কোনো কাজের শর্ত নেই। এই একটি শর্ত পালন করলে আর কোনো গোনাহই তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না; এমনকি মহানবীর উল্লেখিত ব্যভিচার ও চুরির মত কবীরা গোনাহও না। একদিকে যেমন আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট বান্দার সঙ্গে এই চুক্তি করছেন, তেমনি এ কথাও পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছেন যে, জীবনের যে কোনো অঙ্গনে, যে কোনো বিভাগে তাঁর আইন অস্বীকার করলে অর্থাৎ র্শেক করলে তিনি তা ক্ষমা করবেন না, লক্ষ লক্ষ সওয়াবের কাজ করলেও না, সারারাত্র তাহাজ্জুদ নামায পড়লেও না, সারা বছর রোযা করলেও না (সুরা নেসা ৪৮, ১১৬)।