আমিনুল কবির:
প্রাক ইসলামিক আরবের যাবতীয় অন্যায়-অবিচার এবং সীমাহীন অশান্তির পেছনের অন্যতম কারণ ছিল আরবদের অনৈক্য। তদানীন্তন আরবরা গোত্র, বংশ, দল-উপদলে এমনভাবে বিভক্ত ছিল এবং এক গোত্র বা বংশ থেকে অপর গোত্রের প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা এমন চরম আকার ধারণ করেছিল যে নিষিদ্ধ চারটি মাস ব্যতীত এমন একটি দিনও বাদ যেতোনা যেদিন কোন যুদ্ধ-রক্তপাত বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা হত না। এই অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে – বাকি পৃথিবীর মানুষ আরবদেরকে দেখতো অসভ্য, বর্বর একটি জাতি হিসেবে। তারা ছিল বাকি পৃথিবীর ঘৃণার পাত্র।
এমনই অস্থিতিশীল পরিবেশে আরবদের মাঝে আবির্ভুত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, সমস্ত পৃথিবীর জন্য আল্লাহর প্রেরিত বিশেষ রহমত বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ তাঁর রসুলকে দায়িত্ব দিলেন সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠা করে মানবজাতির মধ্যকার যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, অশান্তি নির্মূল তথা শান্তি স্থাপন করার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- নবুয়ত পাবার মুহূর্ত থেকে ওফাত পর্যন্ত জীবনের প্রতিটিক্ষণ তিনি এই একটি কাজেই ব্যয় করেছেন। তাঁর নবী জীবনের দীর্ঘ ১৩ টি বছর কেটেছে জন্মভূমি মক্কার মানুষকে দাওয়াত দিয়ে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন মক্কার শতধা-বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলিকে ভ্রাতৃঘাতী লড়াই বন্ধ করে একসূত্রে গাঁথতে; চেষ্টা করেছিলেন যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, নিজেরা নিজেরা কৃত যুদ্ধ-রক্তপাত বন্ধ করে আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে। কিন্তু মক্কা তাঁর আহ্বান শুনল না। তারা রসুলাল্লাহর এই ঐক্যের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে আগের মতই ফেতনা-ফাসাদে নিমজ্জিত হয়ে থাকলো। তবে রসুলাল্লাহ তাঁর আহ্বান এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ রাখলেন না। যখন যেখানে সুযোগ পাওয়া যায় সেখানেই মানবজাতির ঐক্যের পথ, মুক্তির পথ পেশ করতে থাকলেন। শত নির্যাতন, আঘাত, বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও পিছু হঠলেন না।
আরবের ঐতিহ্যগত কারণে নিষিদ্ধ চারটি মাস তারা যাবতীয় যুদ্ধ-রক্তপাত বন্ধ রাখত। সেই সময় চিরশত্রুকেও হাতের কাছে পেলে তাকে কেউ আঘাত করত না। এই সময়টিতে তারা হজ্ব ও ওমরা পালন করত। দূর-দূরান্ত থেকে হজ্বের কাফেলা আসত মদীনায়। আল্লাহর রসুল প্রতিটি কাফেলায় গিয়ে তাদেরকে ঐক্যের মূলমন্ত্র তওহীদের দিকে আহ্বান করতেন। একদিন মদীনা থেকে আগত খাজরাজ গোত্রের একটি কাফেলার সাথে রসুলাল্লাহর সাক্ষাৎ হলো আকাবা নামক স্থানে, মক্কা থেকে আনুমানিক তিন মাইল দূরে। অন্যান্যর মত মদীনাও (তৎকালীন সময়ে ইয়াছরিব) ছিল গোত্র-বংশ, দল-উপদলে বিভক্ত এবং হানাহানি-যুদ্ধ, রক্তপাতে নিমজ্জিত। কিছুদিন আগেই মদীনায় দুইটি গোত্র আওস ও খাজরাজের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং সে যুদ্ধে খাজরাজ গোত্র জয়ী হয়। মদীনা থেকে আগত কাফেলাটি ছিল এই খাজরাজ গোত্রের। সেখানে উপস্থিত ছয়জন ব্যক্তি রসুলাল্লাহর আহ্বান গ্রহণ করে নিলেন। এই ছয়জন বিশুদ্ধচিত্ত মো’মেনের দ্বারা পরবর্তীতে মদীনার আওস ও খাজরাজ গোত্রে রসুলাল্লাহর নাম ছড়িয়ে পড়ল। সেখানে তওহীদের প্রচার শুরু হলো এবং ঐ ছয়জন ছাড়াও আরো কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করলেন। মদীনায় যখন এই অবস্থা- তখন মক্কায় যথারীতি মো’মেনদের উপর চলছে অবর্ণনীয় নির্যাতন। নবুয়তের দ্বাদশ বর্ষে হজ্ব মওসুমে আওস ও খাজরাজ গোত্রের বারো জন (আগের বারের ৬ জন সহ) পুনরায় মক্কার আকাবায় এলেন এবং রসুলাল্লাহর হাতে বায়াত নিলেন। এটাই ইতিহাসে প্রথম আকাবার বায়াত নামে পরিচিত। তারা যে বিষয়গুলোর উপর বায়াত করেছিলেন তা এই যে,
আমরা এক আল্লাহর দাসত্ব করব এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করব না।
চুরি ও ব্যভিচার থেকে বিরত থাকব।
নিজেদের সন্তানদের (কন্যা সন্তানদের) হত্যা করব না।
কারো বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করব না এবং কারো নিন্দাও করব না।
যাবতীয় ভালো কাজে রসুলাল্লাহর অনুগত থাকব।
বায়াত শেষে রসুলাল্লাহ তাদের সাথে একজনকে মদীনায় পাঠালেন তওহীদের দাওয়াত সকলের কাছে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সাদ বিন মু’আজ এবং উসায়দ বিন হুযায়রের (রা.) মত মদীনার গোত্রপতিরা তওহীদ গ্রহণ করলেন। গোত্রপতিদের সমর্থন পেয়ে দলে দলে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে লাগল। যাবতীয় বিভেদ-অনৈক্য ভুলে গিয়ে ইসলামের ‘এক জাতি-এক নেতা’ মূলমন্ত্রকে সাদরে গ্রহণ করে নিল। রসুলাল্লাহ মক্কা থেকে যাকে মদীনায় ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছিলেন অর্থাৎ মুস’আব (রা:) তাঁর প্রচারের কাজ অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে মক্কায় ফিরে গেলেন এবং রসুলাল্লাহকে সবকিছু অবহিত করলেন। পরের বছর মদীনা থেকে রসুলের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসা ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়াল তেহাত্তর জন। তারা রসুল (সা.) কে মদীনায় হেজরত করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। রসুলাল্লাহ তাদের অভিপ্রায় শুনলেন এবং তাদের কাছে দুইটি বিষয়ে বায়াত নিলেন-
আপনারা কি সত্য প্রতিষ্ঠায় আমাকে পুরোপুরি সাহায্য করবেন?
আপনারা কি আপনাদের শহরে আমার এবং আমার সঙ্গীদের ঠিক সেরূপ যতœ নেবেন, যেরূপ নেন আপনাদের নিজস্ব আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারবর্গের?
আগন্তুকরা হ্যাঁবোধক উত্তর দিলেন এবং আল্লাহর রসুলও চিরদিন তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করলেন। দীর্ঘ ১৩ বছর অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সাথে যাবতীয় জুলুম-নির্যাতন সহ্য করার পর এভাবেই মো’মেনদের জন্য একটি আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করে দিলেন। যেখানে মক্কা এবং তায়েফের অধিকাংশ নেতৃস্থানীয়রা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সেখানে আওস ও খাজরাজ গোত্র এটাকে পরম সোহাগভরে নিয়েছিল নিজেদের মাথায় তুলে। এই সাহায্য করার কারণেই তারা ‘আনসার’ উপাধিতে ভূষিত হলেন।
এরপরের ঘটনা সংক্ষেপে এই যে, সাহাবিরা রসুলাল্লাহর অনুমিতপ্রাপ্ত হয়ে মদীনায় হেজরত করা শুরু করলেন এবং একদিন রসুলাল্লাহও মদীনায় হেজরত করলেন। হেজরত করা সাহাবিদেরকে মদীনার আনসাররা বুকে টেনে নিল এবং তাদের নিরাপত্তা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তাদের নিজেদের কাঁধে তুলে নিল। আল্লাহ রসুল মদীনার সকল গোত্র-ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একটি কথার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করলেন যে, আমরা থাকব যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। দেখা গেল মক্কার মোহাজের আর মদীনার আনসারদের সমন্বয়ে মদীনাতে মো’মেনরা এমন অখ- শক্তিতে পরিণত হলো যারা স্থাপন করেছিলেন পারস্পরিক ¯েœহ-মায়া-ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃত্বের এক নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত। যে মদীনায় নিজ নিজ গোত্রের মধ্যেও হানাহানি-রক্তপাত ঘটতো, যারা সামান্য বিষয়ের জের ধরে বিভক্ত হয়ে পরস্পরঘাতী ষড়যন্ত্র-হত্যা-রক্তপাতের মত ঘটনা ঘটাতো তারাই ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যে হয়ে উঠল একদেহ-একপ্রাণ। শরীরের এক অংশে আঘাত করলে যেমন সম্পূর্ণ শরীরেই ব্যথা অনুভূত হয় তেমনি এই ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ মানুষগুলোর একজনের কষ্ট সবাইকে ব্যথিত করত, এক জনের সুখ সবাইকে আনন্দিত করত। এতদিন যে মানুষগুলোর মত-পথ, সিদ্ধান্ত ছিল আলাদা, যাদের নেতা ছিল ভিন্ন ভিন্ন, যাদের হাতে আপন সন্তানও নিরাপদ ছিল না তারাই হয়ে গেল একে অপরের জীবন-সম্পদের পাহারাদার। তাদের নেতা হলো একজন, দীন হলো একটি, উদ্দেশ্যও হয়ে গেল একটি। ঐক্য, শৃঙ্খলা এবং আনুগত্যের সংমিশ্রণে তারা এমন একটি বজ্রশক্তিতে পরিণত হলেন যাদের গড়া ভিত্তির উপর নির্মিত হলো অর্ধপৃথিবীর ইসলামী সভ্যতা।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, সেই ঐক্যের ধারাবাহিকতা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। গত ১৩০০ বছরের জাতির ইতিহাস শুধুই অনৈক্যের ইতিহাস, বিভেদের ইতিহাস। অর্ধ-পৃথিবীজুড়ে যে মুসলিম নামক জাতিটি মৃত লাশের মত পড়ে আছে তাদের অধঃপতনের অন্যতম কারণই হলো ‘ঐক্যহীনতা’। সেদিনের ঐ মক্কার আইয়্যামে জাহেলিয়াত আজ পৃথিবীব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। মুসলিম নামধারী জাতিগুলোও এই নব্য জাহেলিয়াতের বাইরে নেই বরং সত্য কথা বলতে গেলে এটাই বলতে হয় যে, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠিগুলোর তুলনায় আজ এই মুসলিম নামধারী জনসংখ্যাটিই বেশি অনৈক্য-হানাহানি, মারামারি, বোমাবাজি, যুদ্ধ-রক্তপাতে আপাদমস্তক নিমজ্জিত হয়ে আছে। রসুলাল্লাহ যে ঐক্যের বন্ধনে মদীনার মানুষকে বেঁধেছিলেন এবং যে ঐক্যের উপর ভিত্তি করে এই জাতিটি একসময় বিশ্বের পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল সেই ঐক্যের শিক্ষা থেকে আজকের মুসলিম নামধারীরা অনেক দূরে অবস্থান করছে।
অন্যদের কথা বাদ দেই, আমাদের এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশটি আমরা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছিলাম চার দশক হয়ে গেল। কিন্তু যে স্বপ্ন বুকে ধরে দেশকে স্বাধীন করা হয়েছিল তা আজও স্বপ্নই রয়ে গেছে এবং তার অন্যতম কারণ – অনৈক্য। যতই দিন যাচ্ছে ততই অনৈক্যের জন্ম হচ্ছে সেই সাথে বাড়ছে অস্থিতিশীলতা। দেশের ১৬ কোটি মানুষ আজ বিভিন্ন দল, মত, পথ, সিদ্ধান্তে বিভক্ত হয়ে ইসলামপূর্ব আরবদের মত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত-হত্যা, মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত রয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে এই অনৈক্যের প্রবণতা ততই বাড়ছে। পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্র্রীয় প্রতিটি অঙ্গনেই আমরা শত-সহস্র মত-পথ-শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে আছি। পশ্চিমা সভ্যতার তৈরি ভারসাম্যহীন সিস্টেমকে গ্রহণ করার দরুন রাজনৈতিকভাবে আজ আমরা কমপক্ষে ৫০টির মত রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টায় মেতে আছি। রাজনৈতিক অধিকারের নামে হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। বাকি পৃথিবী আমাদেরকে নিয়ে ঠাট্টার হাসি হাসছে। ১৪০০ বছর আগের আরবদের মত আমরাও বহির্বিশ্বে অসভ্য-বর্বর হিসেবে চিত্রায়িত হচ্ছি। অন্যদিকে ধর্মের নামে বিভিন্ন ফেরকা-মাজহাব, দল-উপদল, তরিকায় বিভক্ত হয়ে একে অপরকে কাফের, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে আছি। এই রাজনৈতিক হানাহানি ও ধর্মীয় বিভক্তি একটি দিনের জন্যও দেশকে শান্তিতে থাকতে দেয় নি। এখনও কি আমাদের ঐক্যের শপথ নেবার সময় আসে নি? আকাবার বায়াতের প্রেরণা নিয়ে আমরা কি পারি না একটি কথার ভিত্তিতে দল-মত-ফেরকা-মাজহাব নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হতে যে, আমরা যে বিশ্বাসের অনুসারী হই, যে ফেরকা-মাজহাবের অনুসারী হই, যে রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হই, আমরা থাকব যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ?