হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

অধ্যক্ষের বক্তব্য: আলীয়া মাদ্রাসা ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের ফসল

রাকীব আল হাসান

আবদুস সাত্তার রচিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস’ নামক বিরল তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জনাব মোহাম্মদ ইয়াকুব শরীফ (তাং- শবে বরাত ১৪০০ হিজরী)। আমরা তার সেই মহামূল্যবান লেখা থেকে কিছু অংশ পাঠক-পাঠিকার জন্য তুলে ধরছি।
“এটি কোনো একটি প্রতিষ্ঠান বিশেষের ইতিহাস নয়, এটা মূলত তদানীন্তন সুবায়ে বাংলার আরবী শিক্ষা তথা গোটা মুসলমান জাতির শিক্ষা, মর্যাদা এবং আপন বৈশিষ্ট্য রক্ষার সংগ্রাম বিধৃত একটি করুণ আলেখ্য।
আজ এই লেখাটি লিখতে স্বভাবতই মন কতগুলো বিশেষ কারণে আবেগ-আপ্লুত হয়ে ওঠে। আর তা হলো অতীতে প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অনৈক্য। মুসলমানরা ছিল বীরের জাতি, ইংরেজ বেনিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা, ও মর্যাদা হরণ করার জন্য পদে পদে যেসব ষড়যন্ত্র আরোপ করেছিল, আলিয়া মাদ্রাসা তারই একটি ফসল। বাহ্যত এই প্রতিষ্ঠানের পত্তন করা হয়েছিল আলাদা জাতি হিসাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্ত, যাতে মুসলমানদের ধর্ম, কৃষ্টি ও আদর্শ রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়াই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।
ইংরেজরা যুদ্ধ করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় নি। হয়তো সে সময় তাদের পক্ষে তা করা সম্ভবও ছিল না। মুসলিমদের মধ্যে পরস্পরলোভী নেতৃত্বের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল। সুবায়ে বাংলার শাসনভার ইংরেজদের হাতে হস্তান্তরিত হওয়ার পর থেকে আরম্ভ হয় মুসলমানদের তাহজীব-তমদ্দুন ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর কূটনৈতিক আক্রমণ। এই শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন ব্যতীত এটা সম্ভব নয়, তাই ইংরেজরা সন্তর্পণে শিক্ষা পরিবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
দিওয়ানী বিভাগে স্বয়ং ইংরেজরা এবং তাদের পদলেহনকারী হিন্দুরা নিয়োজিত ছিল। এদিকে মুসলমানদের কীভাবে উৎখাত করা যায় প্রশাসন বিভাগে সেই ষড়যন্ত্র চলল। কারণ তখনও রাষ্ট্র ভাষা ফারসি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় নি। রাষ্ট্রভাষা ফারসিকে পরিবর্তন করে সে স্থলে ইংরেজি প্রতিষ্ঠা করাও সহজসাধ্য ছিল না। এবং সেকালে ফারসি জানা হিন্দু-মুসলমানদের সংখ্যাও কম ছিল না। ১৭৮০ সালে কলিকাতাতে আলিয়া মাদ্রাসার বুনিয়াদ রাখা হয়। নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে অবশেষে ওয়েলেসলী স্কোয়ারে মাদ্রাসার ইমারত প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এখানকার উলামারা ভারত বর্ষকে দারুল হরব বলে বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং ছাত্রগণও ঐভাবে শিক্ষিত হতে থাকে।
অতঃপর মুসলিম জাতির হাত থেকে প্রশাসন বিভাগ হস্তান্তরিত করবার পালা আসে। পূর্বে মাদ্রাসার শিক্ষিত ছাত্ররাই কাজী, এসেসর ও জজ ইত্যাদি পদে নিযুক্ত হতো। পরে তাও না হওয়ার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ধীরে ধীরে মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল করার ব্যাপারে সকল প্রচেষ্টা চালানো হয়। জীবিকার ক্ষেত্রে মাদ্রাসার ছাত্ররা যাতে একটা পথ খুঁজে পেতে পারে এজন্য আলিয়া মাদ্রাসাতে ইলমে ত্বিব (হেকিমি চিকিৎসাবিদ্যা) সিলেবাসভুক্ত করারও প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। শেষাবধি শুধু ধর্ম শিক্ষার জন্যই এই মাদ্রাসা কোনো রকমে টিকে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাই ছিল মুসলমানদের আসল শিক্ষার মাধ্যম। কিন্তু কালক্রমে ইংরেজরা এর পাশাপাশি একটি বিকল্প শিক্ষা হিসেবে ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ গড়ে তোলে।
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার এক শতাব্দী পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এবং সামগ্রিকভাবে ইংরেজি এই দেশের রাষ্ট্রভাতা রূপে গৃহীত হয়। এভাবে মুসলমানরা ধীরে ধীরে রাজ্যহারা, ধনহারা, মান-সম্মানহারা হয়ে এমন দরিদ্র জাতিতে পরিণত হয়, যা কোনোদিন তারা কল্পনা করতে পারে নি।
এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভাষা হিসাবে ফারসি, আরবি ইত্যাদি ছিল এবং ভালোভাবে এর শিক্ষাসূচিতে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। মূলত তা ছিল ধর্মভিত্তিক, এমনকি হিন্দুদের শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল ধর্মভিত্তিক। তাই বিদেশি ভাষার মাধ্যমে নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণে মুসলমান কিছুতেই রাজী হয় নি। কিন্তু তরপরও কিছু কিছু মুসলমান ইংরেজি পড়তে বাধ্য হয়েছে এবং ইংরেজি শিখে তাদের গোলাম হয়েছে। এ ব্যাপারে আকবর ইলাহাবাদী তাঁর ভাষায় বলেন-
আহবাব কেয়া নুমাযা কর গ্যায়ে
বি.এ. কিয়া, নওকর হুয়ে, পেনশন মিলি আরও মর গ্যায়ে।
অর্থাৎ, বন্ধুগণ কী কীর্তিই না করলেন। বি.এ. পাস করার পর ইংরেজের চাকর হলেন, চাকরির অবসানে পেনশন পেয়ে মৃত্যুবরণ করলেন।
মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন-বর্জিত এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিণতি এ ছাড়া আর কী হতে পারে? এই ধর্মহীন, নৈতিকতাহীন ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্রহীনতা ও ধ্বংস এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করল। এ সত্যের নতুন ব্যাখ্যার প্রয়োজন মোটেই নেই। যে জাতি ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়, তাকে কে রক্ষা করতে পারে? একটা জাতির মধ্যে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ বিদ্যমান এবং রাষ্ট্রও এগুলোকে নিয়ে গঠিত। একটি জাতির উত্থান প্রকৃতপক্ষে তার ত্যাগ ও কুরবানির ভিত্তিতে সম্ভব হয়। লোভ-লালসা, ইন্দ্রীয়পরায়ণতা, ঈর্ষা-হিংসার ফলে জাতি পরাধীন ও দাসত্বে পদানত হয়ে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পরও এই দেশে শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিকতাভিত্তিক সুগঠিত ও সুবিন্যস্ত হতে পারে নি। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে জাতির মাঝে নৈতিক দিক শূন্য থেকে শূন্যতর হয়ে আসছে। এই মানসিকতা জাতির সম্মান, স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের প্রতি দৈনন্দিন এক হুমকিসরূপ বিরাজ করছে।
আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস জাতির পতনের ইতিহাস। অনুভূতিহীন জাতির সম্মুখে এ আলোচনা কি ভালো বোধ হবে? তবে নিরাশ হওয়া চলবে না। মানুষ যেখানে পতিত হয় সেখান থেকে উত্থানের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। অনুভূতি জাগ্রত হলে উন্নতির পথ সুপ্রশস্ত হয়।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...