হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

১৪ শত বছরের ব্যবধান

মোহাম্মদ হারেসুর রহমান

মোসলেম নামধারী কিছু অজ্ঞ লোকের হঠকারী কাজের ফলে ইসলামের শত্রুরা আজ পবিত্র জেহাদকে সন্ত্রাসী কর্ম বলে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছে। জেহাদের কথায় মানুষ আজ ভয়ে আৎকে উঠে, জেহাদ মানে সন্ত্রাস মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জেহাদ ও সন্ত্রাস এক জিনিস নয়, বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীতমুখী বিষয়। সন্ত্রাসের শাস্তি ইসলামে অত্যন্ত কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক। উল্টোদিক থেকে বলা যায়, সন্ত্রাস বন্ধ করাই জেহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। আসলে জেহাদ ছাড়া ঈমান নেই। ঈমান ছাড়া ঈমানের পরীক্ষাও নেই। পরীক্ষা ছাড়া ফল নেই। ঈমান এনেছি এ কথা বললেই আল্লাহ তায়ালা ছেড়ে দেন না। তিনি দেখতে চান ঈমানের দাবী পূরণ করতে চেষ্টা-জেহাদ করা হয়েছে (২৯ঃ২, ৪৭ঃ৩১)। ঈমান প্রসঙ্গে পবিত্র কোর’আনে যত আয়াত এসেছে তার পরের স্থানই দখল করে আছে জেহাদ, সালাত (নামাজ), সওম (রোজা) ইত্যাদি নয়। জেহাদ কোনক্রমেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়। সত্যদীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্ব রকম চেষ্টা-প্রচেষ্টার সম্মিলিত রূপই হলো জেহাদ। মুখের সামান্য কথা থেকে শুরু করে যুদ্ধের ময়দান পর্যন্ত জেহাদের পরিধি বিস্তৃত । আর সত্যদীন অর্থাৎ সত্য জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে সমগ্র মানবজাতিরই কল্যাণ হবে। মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন থেকে অন্যায়, অবিচার নির্মূল হয়ে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। তাই এই জেহাদ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানবের কল্যাণের জন্যই। এ জেহাদের গুরুত্বকে প্রাথমিক যুগের মো’মেন এবং মোসলেমগণ কতটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং সে সাথে তারা মানুষ হিসেবে কতটা পরিশীলিত হয়েছিলেন তার একটা নমুনা ইতিহাস থেকে পেশ করছি:
ওমর (রা:) এর খেলাফতকালে সাফ্ফী নামের এক যোদ্ধার কোন একটি অপরাধের শাস্তি হিসাবে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। সে সময় উম্মতে মোহাম্মদীর সেনারা পারস্য অভিযানে বের হচ্ছেন। চারিদিকে সাজ সাজ রব। সবাই যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাফ্ফী কারাকক্ষে বসে সবকিছু শুনছেন। যুদ্ধে যাবার জন্য তারও মন উতলা হয়ে উঠেছে। কিন্তু যাবেন কিভাবে,তিনি তো অপরাধী হিসেবে কারাগারে বন্দী। যতই দিন যাচ্ছে ততই তার মন ছটফট করছে। তিনি একসময় কারাগার থেকে পালালেন এবং পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধের মাঠে উপস্থিত হলেন। মোসলেম বাহিনীর সাথে একত্র হয়ে বীরদর্পে যুদ্ধ করতে থাকলেন। স্বভাবতই খলিফা জানতে পারলেন যে সাফ্ফী পালিয়েছেন। তিনি যুদ্ধের সেনাপতি সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসকে (রা:) আদেশ দিলেন যে, “তাকে বন্দী করে রাখা হোক।” তিনি একদিকে কারাগার থেকে পালিয়ে এক অপরাধ করেছেন, অপর দিকে বিনা অনুমতিতে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে আরো এক অপরাধ করেছেন। অবাধ্য, বিশৃঙ্খল মোজাহেদকে উম্মতে মোহাম্মদীর বাহিনীতে যুদ্ধ করতে দেয়া যায় না। সেনাপতি সাফ্ফীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বন্দী করে রাখলেন। বন্দীর দেখাশোনার দায়িত্ব পড়লো সেনাপতির স্ত্রী সালমার (রা:) উপরে।
যুদ্ধের গতি বাড়তে থাকে, পরিস্থিতি ভয়াবহ জটিল আকার ধারন করে। বন্দী অবস্থায় যুদ্ধের সংবাদ নেন তিনি। মোজাহেদের রক্ত টগবগ করতে থাকে, চিত্ত আরো চঞ্চল হয়ে উঠে, কিভাবে বন্দী দশা থেকে মুক্ত হয়ে যুদ্ধে যাওয়া যায়। কোন ফন্দিই কাজে আসছে না। উপায় না দেখে একদিন তিনি সেনাপতির স্ত্রী সালমা (রা:)-কে অনুরোধ করলেন- ‘আমাকে কিছু সময়ের জন্য মুক্ত করে দিন, আমি যুদ্ধে যাব। যদি বেঁচে থাকি তবে আবার এসে সেচ্ছায় বন্দীত্বের শিকল পরে নেব।’ কিন্তু সালমা (রা:) কিছুতেই রাজী হলেন না। তাই বলে সাফ্ফীও হাল ছাড়ার পাত্র নন। তিনি বার বার বিভিন্নভাবে অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। অবশেষে একদিন সাফ্ফী সুর করে তার জেহাদে যেতে না পারার কষ্ট বর্ণনা করে আবৃত্তি করতে লাগলেন। কবিতার মর্মস্পর্শী ভাষা ও সুরে এবার সালমা (রা:) একদম অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি চিন্তা করলেন, এই জেহাদ-অন্তঃপ্রাণ মানুষটিকে জেহাদের এই তুমুলক্ষণে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিৎ। হয়তো বা সে মো’মেনদের পক্ষে যুদ্ধে বড় কোন অবদান রাখতে পারবে। আর যদি সে জীবিত থাকে, তবে তো ফিরেই আসবে, আর আল্লাহ তাকে শহীদ করলে সে মুক্তি পেয়ে যাবে। এসব ভেবে তিনি সাফ্ফীর শিকল খুলে দিলেন। মুক্তি পাবার সঙ্গে সঙ্গে সাফ্ফী যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে হাজির। আবার মরণপণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। যে মোসলেম সেনারা তাকে চিনতেন তারা অবাক হয়ে গেলেন, আরে এতো সাফ্ফী। তাকে তো বন্দী করে রাখা হয়েছিল। মুহুর্তে খবর চলে গেল সেনাপতির কানে। তিনি এসে দেখলেন সাফ্ফী পদাতিকবাহিনীর সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।
সূর্য অস্ত যাওয়া অবধি যুদ্ধ চলল। যুদ্ধ শেষ হতেই সাফ্ফী ফিরে এসে সালমাকে (রা:) বললেন, “আমি হাজির। আমাকে শিকল পরিয়ে দিন।” সালমা শিকল পরিয়ে দিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সেনাপতি ফিরে এসে সাফ্ফীর খোঁজ খবর নেন। তিনি অবাক হলেন, এই তো সাফ্ফী শিকল পড়ে বসে আছে। সাফ্ফীর কাণ্ড দেখে সা’দ (রা:) নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিনি নিজ হাতে তার শেকল খুলে দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার জন্য যার হৃদয় এমন পাগলপারা, সেই মোজাহেদকে আমি বন্দী করে রাখতে পারি না।’
পাঠক! মাত্র ১৪ শত বছরের ব্যবধান। পৃথিবীর আয়ুষ্কালের নিরিখে সময়টুকু একটি পলক মাত্র। এতটুকু সময়ের ব্যবধানে অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, আজ মোসলেম দাবিদারদের অন্তকরণ কেঁপে উঠে জেহাদের নাম শুনলে, জেহাদের ভয়ে। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, একজন উম্মতে মোহাম্মদী হয়তো ষড়রিপুর তাড়নায় কোন অপরাধ করে ফেলতে পারে কিন্তু ওয়াদা, প্রতিশ্র“তি রক্ষায় তারা কেমন দৃঢ় ছিলেন! সাফফী’র এই ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় যে, উম্মতে মোহাম্মদীর প্রত্যেকের চরিত্র এমন ছিল যে, পাহাড় নড়তে পারে কিন্তু ওয়াদা নড়বে না। আজকে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অতি ধার্মিকদের মধ্যেই এই চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন কি তথাকথিত মোসলেম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও এখন কথায় কথায় ওয়াদা বরখেলাফ করেন। কী আমূল পরিবর্তন! হ্যাঁ। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও চরিত্রের এই আমূল পরিবর্তনের কারণে অবস্থারও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে সেই ১৪০০ বছর আগের উম্মতে মোহাম্মদীর সঙ্গে আজকের নামসর্বস্ব মোসলেম জনগোষ্ঠীর; তারা ছিলেন অর্ধ পৃথিবীর শাসক আর আমরা সমগ্র পৃথিবীর গোলাম, তারা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, আমরা সর্বনিকৃষ্ট, জঘন্য, সবার ঘৃণার পাত্র।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...