হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সামাজিক অপরাধ, রাজনৈতিক সংঘাত এবং আগ্রাসন সমাধান কোন পথে?

রিয়াদুল হাসান:
বর্তমানে আমরা সমগ্র মানবজাতি এবং আমাদের এই বাংলাদেশের অধিবাসী ষোল কোটি মানুষ রাজনৈতিক সংঘাত, সামাজিক অপরাধ ও জঙ্গিবাদের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি। অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও বিশ্বায়নের এই যুগে পশ্চিমা ভোগবাদী, বস্তুবাদী অপসংস্কৃতির প্রভাবে আমরাও দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের সমাজে এই ভয়াবহ সমস্যাগুলো ডেকে এনেছি। তাদের আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্রের জালে পতঙ্গের মতো আটকে গেছি। কিন্তু তথাপি তাদের চোখ ধাঁধানো জীবনযাপন একদিকে আমাদেরকে আকৃষ্ট করছে, অপর দিকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হিসাবে আমাদের মানবজীবনকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে, আমাদেরকে সীমাহীন অন্যায়, অশান্তি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা আর হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করে ফেলছে। এ থেকে মুক্তির পথ পাচ্ছে না কেউ। কিন্তু আমরা হেযবুত তওহীদ, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর অনুসারীরা বলছি যে, আল্লাহ পথ দিয়েছেন এবং সেই পথটি আমরা আপনাদের সামনে বিবেচনার জন্য তুলে ধরতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এই যে সমস্যাগুলোর কথা আমরা বলছি, এর সমাধান করার জন্য সমস্যার উদ্ভব কোত্থেকে হলো তা আমাদের সঠিকভাবে জানা বাঞ্ছনীয়। যে কোনো সমস্যার গোড়ায় না যেতে পারলে তার সমাধান করা যায় না।
সামাজিক অপরাধ: একটা বস্তুবাদী, স্বার্থকেন্দ্রিক, ভোগবাদী, আত্মাহীন, নৈতিকতার শিক্ষাহীন ভুল জীবন-ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে আমাদের সমাজের মানুষগুলো ধীরে ধীরে স্বার্থপর হয়ে গেছে। তার সমস্ত চিন্তা চেতনাই নিজের সুখ, সুবিধা, সন্তান, ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে। ফলে স্বার্থোদ্ধারের যে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে,   যে করেই হোক আমার অর্থ চাই, যশ-খ্যাতি চাই, এমন ক্ষুধা সৃষ্টি হয়েছে যে ন্যায়-নীতি, বৈধ-অবৈধ এর কোন কিছুর কেউ ধার ধারছে না। যে কোনো উপায়েই আমার ইন্দ্রিয়সেবা করতে হবে, ফলে আজকে অশ্লীলতা এমন সর্বগ্রাসী আকার ধারণ করেছে তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। কেবল টাঙ্গাইলের একটি ঘটনাই যথেষ্ট যেখানে ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ এক রাজনৈতিক নেতা একজন সন্তানকে তার জননীর সঙ্গে অশ্লীল ও অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে জোর করেছে। যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আবার চারজন মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। আইন-প্রশাসন কোনো কিছু দিয়েই এখন আর সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই বছরের শিশু কন্যাকেও অহরহ ধর্ষণ করা হচ্ছে, শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে, না দিলে টুকরো টুকরো করে ফেলা হচ্ছে, ডোবা-নালায় শিশুদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। বাবা-মা সন্তানকে হত্যা করছে, সন্তান বাবা-মাকে হত্যা করছে। প্রকাশ্যে হত্যা করার দৃশ্য ভিডিও করে সেই পৈশাচিকতার দৃশ্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষের চোখ তুলে নেওয়া হচ্ছে, পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, হাত পা কেটে নেওয়া হচ্ছে,  আর অন্যরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে, ছবি তুলছে। এই ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে পূর্বে কল্পনাও করা যেত না। বর্বরতার সকল নজির ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন নৃশংসতার পদ্ধতি আগের নৃশংসতাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। মানুষের এ অবনতিতে শয়তানও মুখ লুকাবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা হলো মানুষের নীতি-নৈতিকতা যা ছিল ধর্মের শিক্ষা থেকে, সেই ধর্ম পর্যন্ত কলুষিত হয়ে গেছে। যারা ধর্মের ধারক বাহক তাদের কাছেও কেউ নিরাপদ নয়। বহু মসজিদের ইমাম তাদের কন্যাসম ছাত্রীদেরকে যৌন নির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে, এমনকি হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলছে।
মানুষ এখন আতঙ্কিত, রাস্তায় চলা ফেরা করলে কোনো লোককে বিশ্বাস করতে পারছে না, দোকান থেকে কোনো জিনিসপত্র কিনলে নিশ্চিত হতে পারছে না এটি ভেজালমুক্ত কিনা, কোন ফল কিনে নিশ্চিত হতে পারছে না এটি বিষমুক্ত কিনা। ঘরে কোন একটা মুহূর্ত যদি তালা খোলা থাকে, ভাবে এই বুঝি আমার সব লুট হয়ে গেল। মসজিদ-মন্দির পর্যন্ত নিরাপদ না, সেখান থেকে জুতা থেকে টাকা-পয়সা সবই চুরি হয়। বাসে ট্রেনে চলতে পকেট থেকে টাকা গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এ এক ভয়াবহ সামাজিক পরিবেশ। এমন একটি পরিস্থিতিতে এই সমাজকে আর পশুর সমাজও কি বলা যায়? এ থেকে কোন প্রক্রিয়ায় আমরা মুক্তি পেতে পারি?
রাজনৈতিক সংঘাত: আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংঘাত মাঝে মধ্যে এমন বিকট আকার ধারণ করে যে দেশের ষোল কোটি মানুষই তার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যায়। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভয়াবহ অনৈক্য বিরাজ করছে, যা যেকোনো সুযোগে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এই অনৈক্যের বীজ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ে রোপিত হয়েছে। তারা এ উপমহাদেশের মানুষকে শাসন করার সুবিধার্থে বহুবিধ উপায়ে আগে ঐক্যহীন করে ফেলেছিল। একে তারা নাম দিয়েছিল ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি, অর্থাৎ ঐক্যহীন করে শাসন করো। আজকে আমরা গণতন্ত্রের নামে যে জীবনব্যবস্থা ধারণ করে আছি সেটা সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতিকেই বাস্তবায়ন করে। সরকারি-বিরোধী, জোট-মহাজোট ইত্যাদি হাজারো বিভক্তি এখানে অনিবার্য পরিণতি। সুতরাং এই সিস্টেমটি ধরে রেখে আমরা কখনোই জাতিকে কোনো ইস্যুতে এক করতে পারব না, কারণ এখানে গণতন্ত্রের নামে যার যা খুশি করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়, যার যা খুশি করতে চায়।
স্বাধীনতার পূর্বে এই সংঘাত রাজনীতির মতোই কেবল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সীমিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সংঘাত আর রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকে নি। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নোংরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলগুলো বিরোধী দলগুলোকে নির্মূল করার জন্য এবং বিরোধীদলগুলো ক্ষমতাসীনদের নাস্তানাবুদ করার জন্য কোন ষড়যন্ত্র করতে বাদ রাখে নি। দেশ ও মানুষ তাদের কাছে মুখরোচক বুলি মাত্র, মূলত ক্ষমতা দখলই তাদের রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য। তাদের কাছে রাজনীতি একটি লাভজনক ব্যবসা যা দিয়ে অর্থ ও ক্ষমতা উভয়ই লাভ করা যায়। গর্ভের সন্তানের গায়েও গুলিবিদ্ধ করে এই ভয়াবহ রাজনীতি সংঘাত-সংঘর্ষ, রক্তপাত-হানাহানি ইত্যাদির রূপ নিয়ে সমগ্র জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চালিত হয়েছে। আর সেটা এখন একটা গ্রামের একটা ক্লাব ঘর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক কারণে ছোটভাই-বড়ভাই, পিতা পুত্রের মধ্যে মারামারি হচ্ছে, হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। গ্রাম বাংলার মানুষ আবহমান কাল থেকে যে সম্প্রীতি ধারণ করে এসেছে, সেই গ্রামের মানুষ স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক অনৈক্যের পরিণামে বিভিন্ন পার্টির বাধাধরা শ্লোগান উচ্চারণ করে একে অপরের উপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়েছে যে, একটা স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিও রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে ভোটের জন্য মারামারি করে। ছাত্র, সাংবাদিক, ডাক্তার, শ্রমিক, উকিলসহ সব শ্রেণির মানুষ এখন এই রাজনৈতিক বিভাজনে এমনভাবে বিভক্ত ও সংঘাতে লিপ্ত যে, এই রাজনৈতিক বিভাজনকে না মিটিয়ে কোনভাবে এই জাতির শান্তি আশা করা যায় না। এই বিভক্তি আমাদেরকে শান্তি দেবে না।
জঙ্গিবাদ: পাশ্চাত্য পরাশক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বের উপর, এ অঞ্চলের সম্পদের উপর তাদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য জঙ্গিবাদকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। জঙ্গিবাদ ধর্মের অপব্যাখ্যার ফসল, কিন্তু এ জাতির একটি বড় অংশ সেই অপব্যাখ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জান্নাতের আশায় জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বিশ্বে যখন একের পর এক দেশ জঙ্গি সংকটের কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এই ১৫ কোটি মুসলমানের দেশেও তাদের সমর্থকেরা সুযোগ সন্ধান করবে একটি সংকট সৃষ্টি করার। সেক্ষেত্রে আমরা এদেশের মানুষকেও সিরিয়ার ভাগ্যকে বরণ করে নিতে হবে। আমাদের এখানেও রাজনৈতিকভাবে ইসলামের উত্থানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার দরুণ জঙ্গিবাদীদের উত্থানের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে গেছে। এ জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের সরকারসহ পৃথিবীর প্রতিটি জঙ্গি আক্রান্ত দেশ কেবল শক্তি প্রয়োগের দ্বারাই চেষ্টা করে। এ থেকে মুক্তির জন্য নতুন নতুন আইন করা হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্য ও শক্তি বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে। নতুন নতুন অস্ত্র আমদানি করা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা বাজেট করা হচ্ছে। এক কথায় শক্তি প্রয়োগের জন্য যা যা করা দরকার, তা করা হচ্ছে। আসলে এ থেকে পশ্চিমাবিশ্বই আমাদের গরীব দেশের অর্থ নিজেদের পকেটে পুরছে, কিন্তু জঙ্গিবাদ শুধু শক্তি প্রয়োগে কখনোই নির্মূল হবে না, বেশিদিন নিয়ন্ত্রণেও থাকবে না। কারণ এটি আদর্শিক সন্ত্রাস। যার সহিংসতার পেছনে ধর্মের প্রেরণা থাকে তাকে কোনো শক্তিই রুখতে পারে না। পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেও পারে নি, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের তো পারার প্রশ্নই আসে না। তাই জঙ্গিবাদকে রুখতে হলে একে আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। এটি যে ধর্মের পথ নয় ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রমাণ করে দেখাতে হবে। তাহলে যারা জঙ্গিবাদের পথে পা বাড়িয়েছে তারা সে পথ থেকে ফিরে আসতে পারে। পাশাপাশি জনগণকেও বোঝাতে হবে এবং গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। গণপ্রতিরোধের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কোনো প্রতিরোধ হয় না। গণপ্রতিরোধ না সৃষ্টি হলে যে সরকারই আসুক জঙ্গিবাদ এখন আন্তর্জাতিক সমস্যা, তা আমাদের দেশেও আঘাত হানবে চূড়ান্তভাবে।
এ থেকে বাঁচার জন্য সব দেশ মরিয়া, এমন কি ইউরোপ আমেরিকাও মরিয়া। কিন্তু তাদের কাছে বাঁচার পথ খোলা নেই। জঙ্গিগোষ্ঠী যদি কোনোভাবে এক দলে পরিণত হতে পারে, তারা অপ্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াবে। তথাপিও আমাদের সামনে বাঁচার পথ আছে। সে পথ আল্লাহ দান করেছেন। সেটা হলো ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার দ্বারা যদি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যায় তবে আমরা রাজনৈতিক সংঘাত, সামাজিক অপরাধ এবং জঙ্গিবাদ সবগুলো সংকট থেকেই রক্ষা পেতে পারি।
দেশ যখন আক্রান্ত হয় তখন যুদ্ধ করা দেশপ্রেম নয়। কেননা সেই যুদ্ধে নিজের প্রাণ-সম্পদ ও পরিজনকে রক্ষার তাগিদটাই তীব্র হয়ে ওঠে। বরং আক্রান্ত হওয়ার আগেই দেশকে রক্ষা করার জন্য মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেক বেশি কার্যকর দেশপ্রেম। দেশ একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে ধ্বংসযজ্ঞ যা হওয়ার হয়ে যাবে, প্রাণ ও স¤পদ যা যাওয়ার চলে যাবে। তাই আসুন, এখনো সময় আছে। সত্যিকারের দেশপ্রেমের পরিচয় দেই। এই দেশপ্রেমই ঈমানের অঙ্গ।
দৃষ্টিহীন, শ্রবণশক্তিহীন, হৃদয়হীন কেউ কেউ বলতে পারেন, এত আশঙ্কা কেন করছেন? তাদের বলব, দয়া করে বিশ্ব, সমাজ, রাষ্ট্রের ভেতর বাহিরের পরিস্থিতি ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, কান দিয়ে শুনুন এবং হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করুন। তখন দেখবেন শুধু আশঙ্কিত নয়, রীতিমত আতঙ্কিত হবেন।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...