হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সওম (রোজা) কী, কার জন্য?

মোহাম্মদ আসাদ আলী
এ উপমহাদেশে সওম বা সিয়ামের বদলে রোজা শব্দটা ব্যবহারে আমরা এতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, সওম বললে অনেকে বুঝিই না সওম কী। কোর’আনে কোথাও রোজা শব্দটা নেই কারণ কোর’আন আরবি ভাষায় আর রোজা পার্শি অর্থাৎ ইরানি ভাষা। কেবল নামাজ রোজাই নয়, আরও অনেক শব্দ আমরা ব্যবহার করি যা কোর’আনে নেই। যেমন খোদা, বেহেশত, দোজখ, ফেরেশতা, জায়নামাজ, মুসলমান, পয়গম্বর, সিপারা ইত্যাদি। এই ব্যবহার মুসলিম দুনিয়ায় শুধু ইরানে এবং আমাদের এই উপমহাদেশে ছাড়া আর কোথাও নেই। এর কারণ আছে। কারণটা হলো – ইরান দেশটি সমস্তটাই অগ্নি-উপাসক ছিল। প্রচণ্ড শক্তিশালী, অন্যতম বিশ্বশক্তি ইরান ছোট্ট উম্মতে মোহাম্মদীর কাছে সামরিক সংঘর্ষে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে গিয়েছিল। পরাজিত হবার পর প্রায় সমস্ত ইরানি জাতিটি অল্প সময়ের মধ্যে পাইকারিভাবে দীন ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে গিয়েছিল। এই ঢালাওভাবে মুসলিম হয়ে যাবার ফলে তারা ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী তা পূর্ণভাবে বুঝতে সমর্থ হলো না অর্থাৎ তাদের আকিদা সঠিক হলো না। তারা ইসলামে প্রবেশ করলো কিন্তু তাদের অগ্নি-উপাসনার অর্থাৎ আগুন পূজার সময়ের বেশ কিছু বিষয় সঙ্গে নিয়ে ইসলামে প্রবেশ করল। ইরানীরা আগুন উপাসনাকে নামাজ পড়া বলত, সালাহ্-কে তারা নামাজ বলতে শুরু করল, তাদের অগ্নি-উপাসনার ধর্মে উপবাস ছিল, তারা সওমকে রোজা অর্থাৎ উপবাস বলতে লাগল, মুসলিমকে তারা পার্শি ভাষায় মুসলমান, নবী-রসুলদের পয়গম্বর, জান্নাতকে বেহেশত, জাহান্নামকে দোজখ, মালায়েকদের ফেরেশতা, আল্লাহকে খোদা ইত্যাদিতে ভাষান্তর করে ফেলল। শুধু যে সব ব্যাপার আগুন পূজার ধর্মে ছিল না, সেগুলো স্বভাবতই আরবি শব্দেই রয়ে গেল; যেমন যাকাত, হজ্ব ইত্যাদি। তারপর মুসলিম জাতি যখন ভারতে প্রবেশ করে এখানে রাজত্ব করতে শুরু করল তখন যেহেতু তাদের ভাষা পার্শি ছিল সেহেতু এই উপমহাদেশে ঐ পার্শি শব্দগুলোর প্রচলন হয়ে গেল। এক কথায় বলা যায় যে, আরবের ইসলাম পারস্য দেশের ভেতর দিয়ে ভারতে, এই উপমহাদেশে আসার পথে পার্শি ধর্ম, কৃষ্টি ও ভাষার রং-এ রঙিন হয়ে এল।
সওমের আকিদা
ইসলামের যেমন একটা উদ্দেশ্য আছে, তেমনি ইসলামের সকল হুকুম আহকামেরও প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য আছে। সত্যদীন, দীনুল হক অর্থাৎ ইসলাম আল্লাহ কেন দিলেন, কেতাব কেন নাযিল করলেন, নবী-রসুলদেরকে কেন পাঠালেন ইত্যাদি সমস্ত কিছুরই উদ্দেশ্য আছে। আসমান-জমিন, গ্রহ-নক্ষত্র কোনো কিছুই যেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেননি তেমনি মানুষকেও একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন। যে কোনো বিষয়ের উদ্দেশ্য জানাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো আমল করার আগে কাজটি কেন করব এই উদ্দেশ্য জানা প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক। সঠিকভাবে উদ্দেশ্যটা জেনে নেওয়াই হলো আকিদা সঠিক হওয়া। সমস্ত আলেমরা একমত যে আকিদা সহীহ না হলে ঈমানের কোন মূল্য নেই। এই আকিদা হলো কোনো একটা বিষয় সম্বন্ধে সঠিক ও সম্যক ধারণা (Comprehensive Concept, Correct Idea)। ইসলামের একটা বুনিয়াদী বা ফরজ বিষয় হলো সওম বা রোজা। পূর্বের অন্যান্য ধর্মগুলোর মধ্যেও উপবাস ব্রত (Fasting) পালনের বিধান ছিল যা বর্তমানে সঠিকরূপে নেই। ইসলামের বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। কাজেই মো’মেনদেরকে অবশ্যই সওমের সঠিক আকিদা জানতে হবে। প্রথমত জানতে হবে সওম বা রোজা কার জন্য।
সওম কার জন্য?
সওমের নির্দেশ এসেছে একটি মাত্র আয়াতে, সেটা হলো- “হে মো’মেনগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের মতো তোমাদের উপরও সওম ফরদ করা হয়েছে, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পার (সুরা বাকারা-১৮৩)।” পাঠকগণ খেয়াল করুন, সওমের নির্দেশনাটা কিন্তু মো’মেনদের জন্য, আয়াতটি শুরু হয়েছে ‘হে মো’মেনগণ’ সম্বোধন দিয়ে। আল্লাহ কিন্তু বলেননি যে হে মানবজাতি, হে বুদ্ধিমানগণ, হে মুসুল্লিগণ ইত্যাদি। তার মানে মো’মেনরা সওম পালন করবে। তাহলে মো’মেন কারা? আল্লাহ সুরা হুজরাতের ১৫তম আয়াতে বলেছেন, তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও রাসুলের উপর ঈমান আনে, কোনো সন্দেহ পোষণ করে না এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ মো’মেন। এই সংজ্ঞা যে পূর্ণ করবে সে মো’মেন। আমরা সংজ্ঞায় ২টি বিষয় পেলাম। এক, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। যে বিষয়ে আল্লাহ ও রসুলের কোনো হুকুম আছে সেখানে আর কারো হুকুম মানা যাবে না। এই কথার উপর সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত ও দণ্ডায়মান। তারপর আল্লাহর এই হুকুমকে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাবেন। তিনি হবেন মো’মেন। তার জীবন সম্পদ মানবতার কল্যাণে তিনি উৎসর্গ করবেন। এই মো’মেনের জন্যই হলো সওম, সালাহ, হজ্ব সবকিছু।
ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটি যার প্রথমেই হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ কলেমা। তারপরে সালাহ, যাকাত, হজ্ব ও সর্বশেষ হচ্ছে সওম (আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বোখারী)। এখানে প্রথমটি হচ্ছে ঈমান আর বাকি সব আমল। যে ঈমান আনবে তার জন্য আমল। মানুষ জান্নাতে যাবে ঈমান দিয়ে, আমল দিয়ে তার জান্নাতের স্তর নির্ধারিত হবে অর্থাৎ কে কোন স্তরে থাকবে সেটা নির্ভর করবে তার আমলের উপর। এই জন্যই রসুল (সা.) বলেছেন, “যে বললো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সেই জান্নাত যাবে (আবু যর গিফারি রা. থেকে বোখারী মুসলিম)। তাহলে এখানে পরিষ্কার দুইটা বিষয় – ঈমান ও আমল। সওম হলো আমল। আর মো’মেনের জন্য এই আমল দরকার। তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার যে মো’মেন সওম রাখবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সওম রাখতে হবে, সওমের উদ্দেশ্য কী? এ নিয়ে আমরা পরবর্তী লেখায় আলোচনা করব ইনশা’আল্লাহ।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...