হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা

মো. মোস্তাফিজুর রহামান শিহাব:
বর্তমান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা নিয়ে অনেক কথা বার্তা শুনি। মোহাম্মদ জাফর ইকবালও এ বিষয়ে অনেক লিখেছেন, প্রশ্ন ফাঁস ইত্যাদি রোধকল্পে জনসচেতনমূলক কাজ করেছেন। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, কেবল ত্রুটি সংস্কার করাই যথেষ্ট নয়, সময় এসেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ এ শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াতেই গলদ রয়েছে।
গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশদের পদানত ছিল। তাদের থেকে আমরা আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন হলেও তাদের দুইশত বছরের শিখিয়ে যাওয়া ব্যবস্থাগুলো আমরা পরিবর্তন না করে সেগুলোই বহাল রেখেছি। উপনিবেশ ও স্বাধীন দেশের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকে, তাই দাসত্বের ব্যবস্থাগুলো স্বাধীন জাতির জন্য মানানসই হয় না- এই সরল সত্যটি আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই আমাদের জীবনব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে এখনও ব্রিটিশদের তৈরি তন্ত্র-মন্ত্র বিদ্যমান। ব্রিটিশরা চেয়েছিল এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে যার মাধ্যমে আমরা আজীবন তাদের আনুগত্য তথা গোলামি করে যাব, আমাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে হীনম্মন্যতায় আপ্লুত একটি দাস জাতিতে পরিণত হবো। কখনই আর মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইব না। এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের ব্যাপারে ইংরেজরা তাদের দুষ্টবুদ্ধির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেছিল। তাদের এই ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্রিটিশ রাজনৈতিক লর্ড মেকলে ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে বক্তব্য দেন তার অংশবিশেষ তুলে ধরছি।
“আমি ভারতের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু একটি ভিক্ষুকও আমার চোখে পড়েনি, একটি চোরও আমি দেখতে পাইনি। এ দেশে সম্পদের এত প্রাচুর্য এবং এদেশের মানুষগুলো এতটাই যোগ্যতাসম্পন্ন ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী যে এদেশকে আমরা কখনই পদানত করতে পারবো না যদি না তাদের মেরুদণ্ডটি ভেঙ্গে ফেলতে পারি। এদেশের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই হচ্ছে সেই মেরুদণ্ড। এ কারণে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমরা এখানকার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতিকে এমন একটি শিক্ষা ও সংস্কৃতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাতে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিক ভাবতে শেখে যে, যা কিছু বিদেশী ও ইংরেজদের তৈরি তাই ভালো ও নিজেদের দেশের থেকে উৎকৃষ্টতর। এভাবে নিজেদের উপরে শ্রদ্ধা হারাবে, তাদের দেশজ সংস্কৃতি হারাবে এবং এমন একটি দাসজাতিতে পরিণত হবে ঠিক যেমনটি আমরা চাই।”
এ একটি মাত্র কথা থেকে ইংরেজদের পরিকল্পনা স্পষ্ট বোঝা যায়। ইংরেজরা চেয়েছিল আমাদের শুধু বাহ্যিক ভাবেই নয় মানসিক ভাবেও দাসে পরিণত করা ও তারা তা করতে সমর্থও হয়েছে। তারা তাদের পরিকল্পনা অনুসারে সর্বপ্রথম দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রণয়ন করে যার ফলে তারা জাতিকে ভাগ করো, শাসন করো (Divide and Rule) নীতি অনুসারে দুভাগে ভাগ করে দিতে পারে। তারা এরই ধারাবাহিকতায় মুসলমাদের জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন যার প্রথম ছাব্বিশজন প্রিন্সিপাল ছিল খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের জন্য সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। ইংরেজদের আগমনের অব্যবহিত পূর্বে ভারতবর্ষ মুসলমান মোঘলদের শাসনাধীন ছিল। তখন ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষভাবে ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়টি বিশদভাবে “সাম্প্রদায়িকতা কী ও কেন” শীর্ষক একটি নিবন্ধে তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বলেন, “ আমাদের দেশে তো বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে একত্রে বসবাস করে এসেছে। হিন্দু কৃষক ও মুসলমান কৃষকের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে নি। তারা একে অপরকে উৎখাত করতে চায় নি। নদীতে হিন্দু জেলে ও মুসলমান জেলে এক সঙ্গে মাছ ধরেছে। তাঁতিরা তাঁত বুনেছে। সাধারণ মানুষ একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মানুষ একই পথ ধরে হেঁটেছে, একই বাজার হাটে গিয়ে কেনাবেচা করেছে, থেকেছে একই আকাশের নিচে। কে হিন্দু কে মুসলমান তা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করেনি, নাক সিঁটকায়নি। তাহলে? সা¤প্রদায়িকতা তৈরি করল কারা? তৈরি হলো কী ভাবে? কেন?
শুধু করল দুই দিকের দুই মধ্যবিত্ত – হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং মুসলিম মধ্যবিত্ত। ব্রিটিশ যুগেই এই ঘটনার সূচনা। তার আগে স¤প্রদায় ছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু মধ্যবিত্ত শিক্ষায় ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠায় উঠতি মুসলিম মধ্যবিত্তের তুলনায় অন্তত পঞ্চাশ বছর এগিয়ে ছিল। মুসলিম মধ্যবিত্ত দেখল জায়গা তেমন খোলা নেই, অন্যরা দখল করে নিয়েছে। শুরু হলো দু’পক্ষের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বদ্বিতা। যারা দখল করে রেখেছে তারা হিন্দু স¤প্রদায়ের লোক। শাসক ব্রিটিশরা এ ব্যাপারে দু’পক্ষকেই উস্কানি দিল যাতে তাদের রেষারেষিটা আরো বাড়ে। বাড়লে ব্রিটিশের সুবিধা, কেন না ঝগড়াটা তখন শাসক-শাসিতের থাকবে না, হয়ে দাঁড়াবে হিন্দু-মুসলমানের।” [প্রতিদিনের সংবাদ ১৭ জুলাই ২০১৬]
উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি কোনো শিক্ষা রাখা হয় না। এর ফলে জাতির একটি বিরাট ভাগ বেকারত্ব সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষের একজন লোকের জন্য বেকারত্ব ছিল একটি অসম্ভব ব্যাপার। উইলিয়াম হান্টার তার দ্যা ইন্ডিয়ান মুসলমানস বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “একশ সত্তর বছর আগে সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন মুসলিমের পক্ষে দরিদ্র হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব; অথচ এখন তাদেরই কারও পক্ষে ধনী হওয়া তেমনটাই অসম্ভব।” অন্যদিকে হিন্দুদের মধ্যে প্রচণ্ড স্বার্থপরতা ঢুকিয়ে দেয়া হয়, মোঘল ও সুলতানী আমলের বাদশাহদের নিষ্ঠুর ও বর্বর বলে আখ্যা দিয়ে মুসলমানদের জন্য বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে পরবর্তীতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় সে সম্পর্কে আমরা সবাই অবহত রয়েছি।
তো ব্রিটিশদের এমন পরিকল্পনার ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ দাসত্ব ও গোলামী ঢুকে পড়ে ও এরই ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যামান। এখনকার মাদরাসা পড়ুয়া জনগোষ্ঠী কারিগরী শিক্ষার অভাবে ধর্মকে রুজি হিসেবে গ্রহণ করে ধর্মজীবিতের পরিণত হয়েছে ও অন্যদল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছে ও নিজেরাই নিজেদের দেশকে শোষণ করছে।
এখন আমাদের এ দ্বৈতনীতির শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন পরবর্তী প্রজন্ম ন্যায়, সাম্য ও ঐক্যের শিক্ষা পাবে, যেখানে কোন সাম্প্রদায়িকতা ও গোলামি মানসিকতার শিক্ষা দেওয়া হবে না। জাতির প্রতিটি নাগরিক এক লক্ষ্য, এক সত্য নিয়ে বের হবে। এটা করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে, সংস্কার করে লাভ হবে না।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...