হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

লক্ষ্যের ঐক্যই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে

রিয়াদুল হাসান: একটি গাড়ি বানানো হয় মালামাল পরিবহনের জন্য, মানুষের যাতায়াতের জন্য। যে এই উদ্দেশ্যটি জানে না তাকে যদি পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়িও দেওয়া হয় সেটা দিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। পরিবহন বা যাতায়াতের জন্য তাকে অন্য বন্দোবস্ত করতে হবে। কোনো বস্তুর আকার, আকৃতি, উদ্দেশ্য, ব্যবহার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা নিতে সেটা চোখ দিয়ে দেখতে হয়। আর যদি সেটা কোনো বিষয় হয় তখন সেটা হৃদয় দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে বুঝতে হয়। যেমন ইসলাম একটি বিষয়। ইসলাম কী, এর উদ্দেশ্য কী- এই বিষয়টি আজকের ১৬০ কোটি মুসলিম দাবিদার জনগোষ্ঠীর জানা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, এটি তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই প্রয়োজন। এবং তাদের আজকের যে দুর্দশা তার পেছনেও আছে ঐ লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে জাতির বিভ্রান্তি।
রসুল পাক (দ.) যখন এ দীন প্রতিষ্ঠা করলেন তখন যদি সেই উম্মতে মোহাম্মদীর প্রত্যেক সদস্যকে এই প্রশ্ন করা হতো তারা সবাই এক রকমের উত্তর দিত। যে কোনো জিনিস বা মতাদর্শ বিকৃত হলে তা হাজার হাজার রূপ পরিগ্রহ করে। তেমনি ১৩০০ বছরের কালপরিক্রমায় ইসলামের প্রকৃতরূপ হারিয়ে গিয়ে সেটা হাজার হাজার রূপ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। এক ইসলামের লক্ষরকম আকিদা দাঁড়িয়ে গেছে। একেকজনের কাছে একই প্রশ্নের একেকরকম উত্তর পাওয়া যায়। এভাবে ১৬০ কোটি মানুষকে প্রশ্ন করলে কয়েক কোটি রকমের উত্তর পাওয়া যাবে। কোনো কিছুতেই তারা এক নয়।
মুসলমানরা আজকে জঙ্গিবাদ ইস্যুকে ঘিরে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে, একটি একটি করে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদী চরমপন্থীরা যে আকিদা (দর্শন) পোষণ করেন, মুসলমানদের কেউ কেউ সেটাকে সঠিক বলেই মনে করেন। যারা অপরাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে জাতি বিধ্বংসী কাজ করেছেন তারাও সেই ইসলামের রেফারেন্স তুলে ধরেন। ফলে ধর্মবিশ্বাসী জনগণ বিশ্বাস করেন এইগুলোও ইসলামের কাজ। তেমনি পীর ফকির, মাজারপূজারীরাও তাদের পক্ষে বহু দলিল দস্তাবেজ উল্লেখ করে থাকেন, ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের ঐ পথগুলোকেও ইসলামেরই পথ বলে সে পথে জীবন-সম্পদ ব্যয় করে যাচ্ছে। এভাবে প্রত্যেকটি দলের মধ্যে হাজার রকমের আমল চালু হয়ে গেছে। এমন এমন আমলও আবিষ্কার করা হয়েছে যার কোনো দলিল প্রমাণ কোর’আন-হাদিসের কোথাও নেই, রসুলাল্লাহ (সা.) বা তাঁর সাহাবিরা তাঁদের জীবদ্দশায় করেছেন এমন নজিরও নেই। অথচ লক্ষ কোটি মুসলমান ঐসব কাজ করে যাচ্ছেন সওয়াব হওয়ার আশায়। কারণ তারা ঐ পথগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।
এখন সামগ্রিকভাবে জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জাতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যটা সঠিক জায়গায় নিয়ে আসার সময় এসেছে। সহজ দুটো প্রশ্নের উত্তর সবাইকে একই রকমভাবে জানতে হবে – ইসলামটা কী এবং ইসলামের উদ্দেশ্য আসলে কী? এটা জানার নামই হল আকিদা। এই আকিদায় যদি আমরা সঠিক হতে পারি, তাহলে আমাদের ঈমানকে আর কেউ ভুল পথে প্রবাহিত করতে পারবে না। আকিদা ঠিক থাকলে ঈমান ঠিক হবে আর ঈমান ভিত্তিক আমলগুলোও ঠিক হয়ে যাবে। আজ আমাদের আকিদা ভুল হওয়ার কারণে আমাদের ঈমানকে একেক দল বা গোষ্ঠী একেকটি ভুল দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিক্ষিপ্ত ধারণা নয়,
সুস্পষ্ট ও সঠিক ধারণার প্রসার অনিবার্য।

ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করছে, কেউ জঙ্গিবাদী, সন্ত্রাসবাদী কাজে কোর’আনকে ব্যবহার করছে, কেউ রাজনীতিতে (ধর্মভিত্তিক ও সেক্যুলার উভয়ই) ধর্মকে ব্যবহার করে ভোটব্যাংক তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু এসবের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ যারা মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, পরকালে জান্নাতে যেতে চায় তারা না পাচ্ছে আল্লাহকে, না পাচ্ছে পারলৌকিক মুক্তি। কারণ ভুল পথে সারাজীবন চলেও গন্তব্যে পৌঁছা যায় না। তাদের এই ধর্মপালনের দ্বারা ধর্মও উপকৃত হচ্ছে না, মানবজাতিও উপকৃত হচ্ছে না। ধর্ম নিয়ে এই সব টানাহ্যাঁচড়া আর অন্ধত্বের চর্চা দেখে, ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থহাসিল দেখে চিন্তাশীল যুক্তিবাদী মানসিকতাসম্পন্ন একদল মানুষ ধর্মের উপর থেকেই আস্থা হারাচ্ছে। তারা ধর্মবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছে, নাস্তিকতার দিকে পা বাড়াচ্ছে। তারা একবাক্যে বলে দিচ্ছে যে ধর্মগ্রন্থগুলো মানবরচিত, অতীতের অজ্ঞমূর্খ মানুষদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সমসাময়িক, চতুর, জ্ঞানী ও শাসকেরা এসব নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছে, যেভাবে শিশুদেরকে ভুতের ভয় দেখিয়ে শান্ত রাখা হয়। এই ধর্মবিদ্বেষীদের গালাগালিতে ক্ষিপ্ত হয়ে মুসলমানদের থেকেই আরেকটি দল চাপাতি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। এভাবেই ধর্মকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে যুদ্ধ মহাযুদ্ধের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবার আগে উদ্দেশ্যের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আগে সিদ্ধান্ত করতে হবে কোনটা ইসলাম আর কোনটা ইসলাম না।
আদম সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তাঁর সব মালায়েকদের ডেকে তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন যে, তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করতে চান যার ভিতরে আল্লাহর সব গুণ থাকবে, সে হবে আল্লাহর প্রতিনিধি। এ কথা শুনে মালায়েকরা এর পরিণাম কী হতে পারে সে বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করলেন। তারা বললেন, আপনার এই সৃষ্টি তো পৃথিবীতে গিয়ে ফাসাদ (অন্যায়, অবিচার) ও সাফাকুদ্দিমা (রক্তপাত, যুদ্ধ) করবে। আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। এদের কেন বানাচ্ছি সে রহস্য আমার কাছে আছে। সেই রহস্য তিনি নবী-রসুলদের দ্বারা উন্মোচিত করেছেন পরবর্তীতে।
তিনি নিজ হাত দিয়ে আদমকে বানালেন এবং তাঁর ভিতরে নিজের রূহ প্রবেশ করিয়ে দিলেন। মানুষ আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হলো। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করার বিবেক নামক আদালত তার মধ্যে স্থাপিত হলো। এটা আর কারো মধ্যে নেই। আল্লাহ সমস্ত মালায়েককে আদেশ করলেন, তোমরা এর প্রয়োজন পুরনে নিয়োজিত হও। তারা সেজদা করে আদমের সেবায় আত্মনিয়োগ করল। এ কারণেই শক্তিশালী জীবজন্তু থেকে মহাশক্তিশালী বিদ্যুৎকে পর্যন্ত আমরা রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে চাকরের মত ব্যবহার করি, আগুনের মত দৈত্যকে ছোট দেশলাইয়ের বাক্সে পুরে রাখি। সূর্য আজও আমাদের সামনে সেজদায় পড়ে আছে, নিরন্তর তাপ আর আলো দিয়ে যাচ্ছে এবং পৃথিবীকে বন্দী করে রেখেছে নিজ আকর্ষণ বলয়ে।
কিন্তু ইবলিস সেজদা করল না। সে বেরিয়ে গেল একটা চ্যালেঞ্জ দিয়ে যে মানুষ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে না। সে আল্লাহর আনুগত্য করবে না, নিজের চিন্তার আনুগত্য করবে। পরিণামে মানুষ সেই পূর্বানুমানকৃত অশান্তিতে পতিত হবে। মানুষ অশান্তিতে পতিত হলেই ইবলিসের জয় এবং আল্লাহর পরাজয়। আল্লাহ মানুষের বিবেকের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ইবলিসকে দাঁড় করালেন তার প্রতিপক্ষরূপে। মানুষের দায়িত্ব (এবাদত) হলো পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এটা করার পক্ষে বাধা দেবে ইবলিস, সে তা-ই করবে যার পরিণামে মানবসমাজে বিশৃঙ্খলা হয়। মানুষ যদি শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে তাহলে সে পরকালে আবার জান্নাতে ফিরে যাবে। আর যদি না পারে তাহলে ইবলিসের সঙ্গে জাহান্নামে দগ্ধ হবে।
আল্লাহ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার উপায় বাতলে দিলেন। আরবিতে একে বলা হয় হেদায়াহ, বাংলায় দিকনির্দেশনা, ইংরেজিতে Guidance, Right Direction. এই পথের গন্তব্যটা হচ্ছে জান্নাত। পথে ইবলিস বসে থাকবে, সে চেষ্টা করবে পথভ্রষ্ট করতে। মানুষ সিরাতুল মুস্তাকীমে, সহজ সরল পথকে আঁকড়ে ধরে থাকবে। এটাই হচ্ছে পরীক্ষা। কথা হচ্ছে, এই সঠিক পথের বাস্তব রূপটি কী? সেটা হচ্ছে তওহীদ, কলেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আমার এই জীবনে আর কারো হুকুম মানবো না। মানুষ এখন মুখে মুখে এ কলেমা পাঠ করে কিন্তু আল্লাহর হুকুম না মেনে জাতীয় রাষ্ট্রীয় জীবনে মানছে ব্রিটিশদের হুকুম আর ব্যক্তিগত ধর্মীয় জীবনে মোল্লা পুরোহিতদের মনগড়া শরিয়ত। সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির হুকুম এক কথায় ইবলিসের দ্বারা সে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। তবু মুখে মুখে কলেমা পাঠ করে আত্মপ্রতারণা করে চলেছে। কলেমা আউড়ানোর দরুন, নামাজ রোজার দরুন সে এটা ধরতে পারছে না যে আসল পথ ছেড়ে সে ভুল পথ ধরে চলছে।
আল্লাহর উপর দোষ চাপানোর কোনো সুযোগ আল্লাহ রাখেন নি কারণ আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও বিবেচনাবোধ দুটোই দিয়েছেন। সে আল্লাহর দেওয়া পথনির্দেশ মান্য করবে নাকি অন্য পথ নিবে সেটা তার ইচ্ছাধীন। তার সামনে দুটো বিধানদাতা, দুটো হুকুম, দুটো এলাহ। আল্লাহ ও গায়রুল্লাহ। গায়রুল্লাহ মানেই ইবলিস। ইবলিসের হুকুম মানার পরিণাম হচ্ছে অন্যায়, অশান্তি, যুদ্ধ, রক্তপাত, অবিচার, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ক্রন্দন, হতাশা। আল্লাহর কাছ থেকে এগুলো আসা সম্ভব না কারণ ওসব ক্লেদাক্ত বিষয় আল্লাহর মধ্যে নেই। আল্লাহর হুকুম মানার ফল হচ্ছে ন্যায়, শান্তি, মৈত্রী, সুবিচার, নিরাপত্তা, আনন্দ, সুখ, সমৃদ্ধি।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানবজীবনের দুটি পক্ষ- ডান আর বাম। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারাম। হুকুম দুইটা আল্লাহর হুকুম আর মানুষের হুকুম। পক্ষ দুইটা- সরলপথ (সেরাতাল মুস্তাকীম) ও ভ্রান্তপথ (দালালাত)। সেজন্য পরকালের পরিণতিও দুইটা- জান্নাত আর জাহান্নাম। আর পৃথিবীতে পরিস্থিতি হতে পারে দুইটার একটা – শান্তি অথবা অশান্তি। এই হলো মূলচিত্র। শান্তি আর অশান্তি নির্ভর করে জীবনবিধানের উপর। আল্লাহর হুকুম আল্লাহ পাঠিয়েছেন। সেটা মানুষ না মানলে ইবলিস তো হুকুম দিবেই। জীবন তো আর থেমে থাকে না। জীবনব্যবস্থা ছাড়া মানুষ বাস করতে পারে না। এ কারণেই আল্লাহ নবী-রসুলের হাতে তাঁর হুকুম দিয়ে পাঠিয়েছেন আর সেই দীনের ভিত্তি রেখেছেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, জীবনের সর্বাঙ্গনে যেখানেই আল্লাহর কোনো হুকুম বা সিদ্ধান্ত রয়েছে সেখানে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। নবী রসুলদের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী করিম (সা.)। তাঁরা সকলেই চেষ্টা করেছেন মানুষকে আল্লাহর হুকুমের প্রতি অনুগত করে তোলার জন্য; ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে ন্যায়ের দিকটা গ্রহণ করার জন্য; তাদের মধ্যে যাবতীয় অনৈক্য দূর করে ঐক্য গঠন করার জন্য; শত্রুতা মিটিয়ে দিয়ে সবাইকে ভাই বানানোর জন্য; স্বার্থপরতা দূর করে নিঃস্বার্থ, পরোপকারী, মানবতার কল্যাণকামী করার জন্য; কাপুরুষতা দূর করে সাহসী হওয়ার জন্য, অন্যায় দূর করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী হওয়ার জন্য; অন্তর্মুখী না হয়ে বহির্মুখী হওয়ার জন্য; স্থবিরতা পরিবর্তন করে গতিশীলতা আনয়নের জন্য; কূপমণ্ডুকতা ছেড়ে চিন্তাশীল হওয়ার জন্য; ক্ষুদ্রতা পরিহার করে দূরদৃষ্টি অর্জনের জন্য। এটাই হল ডানের রাস্তা গ্রহণের ফলাফল।
আল্লাহর শেষ নবীর সঙ্গে পূর্বের নবী-রসুলদের দায়িত্বের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অন্যরা এসেছেন অনেক সীমিত দায়িত্ব সীমা নিয়ে- কেউ কোনো গোত্রের জন্য, কেউ একটি ভূখ-ের জন্য। কিন্তু শেষ নবী এসেছেন সমস্ত মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁর উপরে আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্বটাই হচ্ছে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য, উম্মাহর মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ নিজেই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, যেন কেউ এ বিষয়ে দ্বিধা সৃষ্টি না করতে পারে। তিনি বলেছেন, আল্লাহ হেদায়াহ ও সত্যদীন সহকারে স্বীয় রসুল প্রেরণ করেছেন এই উদ্দেশে যে, তিনি যেন একে অন্য সকল দীনের উপর বিজয়ী করেন। এর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট (সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯, সুরা তওবা ৩৩)। অর্থাৎ সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করাই রসুল প্রেরণ তথা উম্মতে মোহাম্মদীর মূল উদ্দেশ্য।
আরেকটু সুস্পষ্ট করার জন্য রসুলাল্লাহর জীবন থেকে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমত, যখন মক্কায় মো’মেনদের উপর চরম নির্যাতন নিপীড়ন চলছিল, ইসলাম প্রচারকে কেন্দ্র করে মক্কায় তুমুল সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তখন কাফের সর্দারেরা তাঁর চাচার মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠালেন যে যদি তিনি চান তাঁকে আরবের বাদশাহ বানিয়ে দেওয়া হবে, যদি চান আরবের সবচেয়ে সুন্দরী ললনাকে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে আর যদি এটা তাঁর কোনো অসুস্থতাজনিত সমস্যা হয়ে থাকে তবে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক এনে তাঁকে সুস্থ করা হবে। তিনি পরিষ্কার বলে দিলেন, “যদি আমার এক হাতে চন্দ্র আর আরেক হাতে সূর্যও এনে দেওয়া হয় তবু আমি এ কাজ পরিত্যাগ করব না। হয় আল্লাহ আমাকে বিজয়ী করবেন, নয়তো মোহাম্মদ এ পথে ধ্বংস হয়ে যাবে।” এটা সুস্পষ্ট যে, ক্ষমতা, অর্থ বা ভোগবিলাসে গা ভাসানোর জন্য তাঁকে নবুয়তের দায়িত্ব দেয়া হয় নি, তিনিও উম্মতে মোহাম্মদী জাতি গড়ে তোলেন নি। আল্লাহর বিজয় মানেই ন্যায়ের বিজয়, মানবতার বিজয়, সত্যের বিজয়।
দ্বিতীয়ত, একজন নির্যাতিত সাহাবী রসুলের কাছে এসে বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি দোয়া করেন তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু রসুল কাফেরদের ধ্বংস কামনা করেন নি। এখানেই প্রমাণ হয়ে যায় যে তিনি মানুষকে ধ্বংস করার জন্য আসেন নি, তিনি তাদেরকে দুর্দশা থেকে উদ্ধার করতে এসেছেন। তিনি জবাবে বললেন, শোনো, সেদিন বেশি দূরে না, যেদিন একজন যুবতী সুন্দরী মেয়ে সারা গায়ে অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত পথ রাতের অন্ধকারে হেঁটে যাবে। তার মনে আল্লাহ ও বন্যপ্রাণীর ভয় ছাড়া আর বিপদের আশঙ্কাও জাগ্রত হবে না। অর্থাৎ রসুলাল্লাহ একটি শান্তিময় সমাজব্যবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। একটি সমাজের শান্তিময়তা বোঝার জন্য এর চেয়ে বড় কোনো নির্দেশক থাকতে পারে না।
তৃতীয়ত, মক্কা বিজয়ের দিন তিনি পরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দিলেন। তারপর তিনি বেলালকে (রা.) কাবার উপরে উঠিয়ে আজান দেওয়ালেন। সেই বেলাল কোন বেলাল? সেই কোরায়েশদের দ্বারা অত্যাচারিত নিপীড়িত বেলাল, যার কোনো বলার অধিকার ছিল না, বিনোদনের অধিকার ছিল না, যাকে জন্তুর মতই ব্যবহার করা হতো। সেই ক্রীতদাস বেলালকে তিনি কাবার উপরে উঠালেন। উঠিয়ে প্রমাণ করে দিলেন মানুষ ঊর্ধ্বে মানবতা ঊর্ধ্বে। মানবতাকে সর্বোচ্চ আসনে উঠানোর জন্যই তিনি এসেছিলেন। এজন্যই তাঁর উপাধি আল্লাহ দিয়েছেন তিনি রহমতাল্লিল আলামিন, বিশ্বজগতের জন্য রহমত।
বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি বললেন, আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নাই। সমস্ত বৈষম্যের উঁচু নিচু দেয়াল তিনি ভেঙ্গে দিলেন। তিনি বললেন, তোমরা যা খাবে তোমাদের অধীনস্থদেরও তাই খাওয়াবে, যা পরবে তা-ই তাদেরকে পরাবে। গোটা জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করলেন, সুশৃঙ্খল করলেন, সত্যের পক্ষে সংগ্রামে অবতীর্ণ কলেন। তিনি যেমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন তার ফল হলো যে একজন মেয়ে একা রাতের অন্ধকারে হেঁটে যেতে পারত। মানুষ উটের পিঠভর্তি করে খাদ্য, সম্পদ নিয়ে দরিদ্র মানুষের সন্ধানে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। রাস্তায় একটি মূল্যবান বস্তু হারিয়ে ফেললে সেটা খুঁজে যথাস্থানেই পাওয়া যেত। দোকান খোলা রেখে মানুষ মসজিদে যেত, বছররের পর বছর আদালতে কোনো অপরাধসংক্রান্ত মামলা আসতো না। সেখানে পথচারীদের খাওয়ার জন্য রেস্তোরা বসানো হতো না, বসানো হতো সরাইখানা। স্থানীয় লোকেরা তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য, ফলফলাদি, গৃহপালিত পশু সরাইখানাতে দিয়ে যেত যেন মুসাফির আর ক্ষুধার্তরা এসে খেতে পায়। একজন নিঃস্ব মানুষ দেশ ভ্রমণে বের হতো, কোথায় তার আশ্রয়ের সঙ্কটে পড়া তো দূরের কথা, সে মানুষের কাছ থেকে উপহার উপঢৌকন নিয়ে ধনী মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরত।
তাহলে ইসলামের আগমনের উদ্দেশ্যটা কী। এটাই হচ্ছে রসুলাল্লাহর (সা.) আগমনের উদ্দেশ্য, সকল নবী রসুলের আগমনের উদ্দেশ্য। মানবজীবন থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচার রক্তপাত দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর সাথে ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে বিজয়ী করা। ইসলাম মানুষের ভিতরে, তার আত্মায় পরিবর্তন এনেছে, কলুষমুক্ত করেছে। মানুষ স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হয়ে মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করবে। ঐ সমাজে পরোপকারের, কল্যাণকর কাজের একটি প্রতিযোগিতা লেগে গেল। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এটা চলমান ছিল। এ কারণেই রসুলাল্লাহর ইন্তেকালের পরে আসহাবরা, যারা তাঁর পায়ের কাছে বসে ইসলাম শিখেছেন, তাঁরা নিজেদের রক্তের বিনিময়ে অর্ধপৃথিবীতে দীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কাউকে জোর করে বা কায়দা করে চাপে ফেলে ধর্মান্তরিত করা ইসলামের উদ্দেশ্য না, কারো বিশ্বাসের উপর আঘাত করা নয়, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে দখল করা নয়, কারো খাদ্যাভাস রুচি পোশাক ইত্যাদি জোর করে চাপিয়ে দেয়ার জন্যও নয়। কে আল্লাহ বিশ্বাস করল, কে ভগবান বিশ্বাস করল ইত্যাদি জোরপূর্বক পরিবর্তনের জন্য নয়। ইসলামের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যটাই হলো মানুষের শান্তি, মানুষের কল্যাণ, মানুষের ঐক্য, দয়া মায়া, ভালোবাসা, প্রেম, স্নেহ, মমতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভাতৃত্বপূর্ণ একটি সমাজ।
এই একক অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে রসুলাল্লাহ তার জাতিটাকে ধাবিত করে দিয়ে গেলেন। পরবর্তী সর্বনাশা ঘটনা ঘটল যখন সমগ্র জাতি এই লক্ষ্য থেকে তাদের মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারা তাদের সৃষ্টির লক্ষ্য, আকিদাই ভুলে গেল। তারা স্বার্থহীনতা ত্যাগ করে স্বার্থপর হলো, তারা সাহসী না হয়ে কাপুরুষে পরিণত হলো। যোদ্ধা হওয়ার পরিবর্তে তারা সুফি হলো। মানবতার কল্যাণকামী হওয়ার পরিবর্তে তারা রঙ্গরসে লিপ্ত হলো। যে জাতির শাসকরা গাছের নিচে ঘুমোতেন, যাদের খলিফারা পিঠে আটার বস্তা বয়ে নিয়ে যেতেন দরিদ্র মানুষের দুয়ারে, সেই শাসকেরা হয়ে গেল সুলতান, আমীর, ওমরাহ, বাদশাহ, মালিক। অপরদিকে পণ্ডিত শ্রেণি দীনের বিধিবিধান নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে জাতিটাকে হাজারো ফেরকা মাজহাবে বিভক্ত করে দিল। শাসকদের নেক দৃষ্টি পাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ জাল হাদিস বানালো, বানোয়াট সব কেচ্ছা কাহিনী রচনা করল। এভাবে কালপরিক্রমায় বিকৃতি ঢুকতে ঢুকতে বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে এটা আল্লাহ রসুলের সেই ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গেছে।
এখন একদল লোক আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য দরজা জানালা বন্ধ করে যেকের করছেন, আরেকদল মাজারে গিয়ে মোমবাতি জ্বালছেন, পীরের দরবারে গিয়ে ওরশ করছেন। আরেকদল অপরাজনীতি, জ্বালাও পোড়াও করে সব ধ্বংস করে দিচ্ছেন। আরেরকদল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নাম করে নিজের গায়েই বোমা মেরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। শরিয়ার ফতোয়া দিয়ে গ্রামে গঞ্জে চলছে সীমাহীন নারী নির্যাতন, চলছে চাপাতি দিয়ে ইসলামবিদ্বেষীদের গুপ্তহত্যা। চলছে অপ্রয়োজনীয় ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের বাড়াবাড়ি। কিন্তু এসব করে ইসলামের আসল কাজ কিছুই হচ্ছে না। এতে করে ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা ইসলামের কোনো সুফল পাচ্ছে না, জাতিও ইসলামের ন্যায়বিচার সাম্যনীতি পাচ্ছে না। এর মধ্যে ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনকারীরা স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে।
জাতির লক্ষ্য হারিয়ে যাওয়ার ফলেই তারা শিয়া-সুন্নীতে বিভক্ত হয়েছিল। আজকে মধ্যপ্রাচ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে প্রস্তুতি চলছে যার মূল কারণ এই শিয়া সুন্নি বিভক্তি। এজন্য পবিত্র কোর’আনে শিয়া-সুন্নি ইত্যাদি বর্ণবাদী পরিচয়ে জান্নাতের নিশ্চয়তা দেওয়া হয় নি। বরং বলা হয়েছে জান্নাতে যাবে শুধু মো’মেন। আল্লাহ সাহায্য করবেন শুধু মো’মেনদেরকে, রক্ষা করবেন শুধু মো’মেনদেরকে। আল্লাহ উদ্ধার করবেন শুধু মো’মেনদেরকে। আল্লাহ মো’মেনদের ওয়ালী। এ জাতি তেরশত বছরে শিয়া হয়েছে, সুন্নি হয়েছে, সুফি হয়েছে, হাম্বলি হয়েছে, তরিকা-মাজহাবে-ফেরকায় বিভক্ত হয়েছে। আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করে পথভ্রষ্ট জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছে। এদের জীবনের কোনো লক্ষ্য নাই, জাতির কোনো উদ্দেশ্য নাই। কেতাবের কোনো লক্ষ্য জানে না নবী রসুলের আগমের লক্ষ্য উদ্দেশ্যও জানে না। একেকজন একেক দিকে পাগলের মত আচরণ করছে। এরা ভুলে গেছে এদের জাতি এক, নেতা এক, কেতাব এক, এদের হুকুম এক, রাস্তা এক, লক্ষ্য এক। তাদের বহু দলমতের বিভক্ত ইসলাম আল্লাহ গ্রহণ করছেন না। এখন কে তাদের মূল লক্ষ্যে ফিরিয়ে আনবে। কে তাদেরকে সীসাগলা প্রাচীরের মত ঐক্যবদ্ধ করবে, কে তাদের দুনিয়াতে সেই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করাবে? হতাশার চাদর মুড়ি দিয়ে তো আর ঘরের কোণে বসে থাকতে পারি না। সত্য যখন পেয়েছি তখন তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই হবে। সফলতা আল্লাহর হাতে।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...