হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

রম্য রচনা: আমার মহান আবিষ্কার!

মোহাম্মদ আসাদ আলী

১.
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। একে তো রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, তার উপর লোকাল বাসে যাত্রা। পরিস্থিতি বড়ই সঙ্গীন। আমার পাশে দাড়িওয়ালা বুজুর্গ চেহারার একজন চাচামিয়া। তিনি বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘অ্যায় ড্রাইভার! তোগো গাড়ির কি কষা হইছে? ইঞ্জিন খালি ভুমভাম করে, চাকা তো এক রাউন্ডও ঘোরে না।’
সাধারণত লোকাল বাসের ড্রাইভারদের ‘ড্যাম কেয়ার’ মাইন্ডের হতে হয়। আমাদের ড্রাইভার সেই গুণে গুণান্বিত। তবে কন্ডাক্টরকে হতে হয় চরম ‘গলাবাজ’। কন্ডাক্টরের প্রধান দায়িত্ব থাকে সর্বাবস্থায় ওস্তাদের পক্ষে নৈতিক সমর্থন যোগানো এবং তার প্রতি নিক্ষিপ্ত প্যাসেঞ্জারের প্রত্যেকটি অভিযোগের তীর দ্বিগুণ গতিতে প্যাসেঞ্জারের দিকেই ফিরিয়ে দেওয়া। এখানেও ব্যতিক্রম হলো না। বুজুর্গ টাইপ চাচামিয়ার দিকে কন্ডাক্টরের তীব্র বাক্যবাণ বর্ষিত হতে লাগল, যার সারমর্ম হচ্ছে- ‘চাচামিয়া প্লেনে চড়ে বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন না। তিনি ছয় টাকার ভাড়া পাঁচ টাকা দিয়ে বাস ভ্রমণ করছেন। আর এই বাস নামক যানবাহনটির পক্ষে ডানা মেলে উড়াল দেওয়া সম্ভব নয়। একে চাকায় ভর দিয়ে চলতে হয় এবং চাকা ঘোরার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ফাঁকা থাকতে হয়। কাজেই চাচামিয়ার উচিত বকাবকি থামিয়ে মনোযোগ দিয়ে ওয়াজ শোনা।’
উল্লেখ্য, রাস্তায় পাশেই একটি মাঠে ওয়াজ মাহফিল চলছে। সেখান থেকে কোকিলকণ্ঠী বক্তার সুমধুর ওয়াজের ধ্বনি ভেসে আসছে।
২.
অন্তত পনেরো মিনিট গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। নট নড়ন চড়ন। এতক্ষণ জ্যাম থাকার কথা না। সম্ভবত কোনো দুর্ঘটনা বা রাস্তা মেরামতের ব্যাপার আছে। কাজেই গাড়ির সবাইকে বাধ্য হয়েই ওয়াজ শুনতে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ওয়াজ শোনার কারণেই কিনা যাত্রীদের চেহারায় একটা দুঃখী দুঃখী ভাবও চলে এসেছে।
ওয়াজের এক পর্যায়ে বক্তা চেঞ্জ হলেন। এতক্ষণ শুনছিলাম ‘অজ্ঞাত’ ব্যক্তির ওয়াজ, এবার যিনি বক্তব্য শুরু করলেন তার নামধাম ও বিশেষণ জানা গেল। তার নামের আগে আন্তনগর ট্রেনের মত বিশেষণের দীর্ঘ লাইন বয়ে গেছে, একটি বিশেষণ হলো ‘বাতিলের আতঙ্ক’। খানিক বাদেই তিনি যে অনলবর্ষী ভাষণ শুরু করলেন তাতে সত্যিই বাতিলের আত্মা কেঁপে ওঠার কথা। সেই আত্মা হয়ত বাতিল ব্যক্তিটাকে ত্রাহীসুরে চিৎকার করে বলবে, ‘ভাইজান, একটু সাইড হবে? আপনে বাতিল মানুষ, আপনার বডিতে নিরাপত্তা বোধ করছি না।’ সৌভাগ্যক্রমে আমি বাতিল নই বিধায় আমার আত্মা আতঙ্কিত হবার প্রয়োজন বোধ করল না।
আমি চাচামিয়াকে বললাম, ‘বক্তা তো ফাটায়া দিতাসে, কী বলেন চাচা?’
চাচা মিয়া বললেন, ‘এহানে ফাটায়া দিয়ার কি হইল? এইটা কি কনসার্ট হইতাছে? বক্তারা পারফরমেন্স করে?’
আমার উৎসাহ দমে গেল। চাচা যথেষ্ট উত্তেজিত। কিন্তু কী জন্য উত্তেজিত বোঝা যাচ্ছে না। হতে পারে বক্তার রক্ত হিম করা হুংকারে সমস্ত বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে উত্তেজিত। আবার এও হতে পারে বক্তার বিরুদ্ধেই উত্তেজিত! আমি বরং তাকে আর না ঘাটাই। তার চাইতে গুরুতর বিষয় মাথায় এসেছে, সেটা নিয়ে ভাবা যাক। আমার গুরুতর বিষয় ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা’। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার অবস্থা আমরা সকলেই জানি। সা¤্রাজ্যবাদীদের হামলায় একটা একটা করে ধ্বংস হয়েছে দেশগুলো। তাদের মতন বাংলাদেশও যে কোনোদিন হামলার শিকার হবে না তার গ্যারান্টি নেই। যদি হামলার শিকার হয় তাহলে আমাদের করণীয় কী? প্রত্যেক নাগরিকের এ বিষয়ে ভাবা আবশ্যক এবং নাগরিক দায়িত্বও বটে। বিচিত্র কারণে আমার ওই নাগরিক দায়িত্ববোধ জেগে উঠল। আমি ভাবনায় ডুব দিলাম. . .।
৩.
হঠাৎ মনে হলো ‘ইউরেকা’। পশ্চিমাদের খবর হয়ে যাবে। কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই আমরা তাদের কাবু করে ফেলতে পারব। শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতিকে কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তগুলো ধারাবাহিকভাবে মাথায় আসছে এবং সবগুলোকেই হারবাল কোম্পানির ওষুধের মতন ‘অব্যর্থ’ ‘আদী’ ও ‘আসল’ মনে হচ্ছে।
সিদ্ধান্ত ১:
দেশে যতগুলো ‘বাতিলের আতঙ্ক’ আছেন, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ওয়াজের আয়োজন করে দেওয়া এবং সেই ‘খাইয়ালামু-কাইট্টালামু’ টাইপ ওয়াজ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা। সেটা দেখেই পৃথিবীর তাবৎ বাতিল শক্তির আত্মায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে যাবে। তারা আর সামনে এগোনোর দুঃসাহস দেখাবে না। ফলে আমরা কোনো যুদ্ধ না করেই বিজয়ের মাল্য গলায় পরতে পারব। তবে ‘বাতিলের আতঙ্ক’রা ব্যর্থ হলেও দুশ্চিন্তা নয়! আমাদের সামনে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের পথ খোলা থাকছে।
সিদ্ধান্ত ২:
দেশে যতগুলো ‘মুফতিয়ে আজম’ আছেন তাদেরকে খুঁজে বার করা। তাদের দিয়ে এমন একটা ফতোয়া জারি করা যেই ফতোয়া শোনামাত্র দেশের ১৬ কোটি মানুষ তাদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। মুফতিয়ে আজম যিনি, অবশ্যই তার ফতোয়ার আনুগত্য করতে সর্বস্তরের মানুষ প্রস্তুত থাকে। আমার ধারণা হারবাল কোম্পানির এক ফাইলই যথেষ্ট’র মতন মুফতিয়ে আজমের এক ফতোয়াই যথেষ্ট হবে, আর বিফলে তৃতীয় পথ তো খোলাই থাকছে।
সিদ্ধান্ত ৩:
কথিত ‘পীরে কামেলদের’ একত্রিত করা। একত্রিত করে তাদের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া। তারপর নাকে তেল দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুমিয়ে পড়তে হবে, কারণ এরপর সাধারণ মানুষের আর কোনো কাজ নেই। লড়াই তো হবে কেরামতির শক্তিতে। যারা জানেন তাদের জন্য বলছি না, যারা জানেন না তাদের জন্যই বলা- বঙ্গদেশের পীরে কামেলদের ‘ক্ষমতা’ তুলনাহীন! ক্ষমতার কয়েকটি নমুনা-
একদিন একজন কামেল পীর লঞ্চ ভ্রমণে বেরোলেন। এতবড় কামেল পীর যেই লঞ্চে পদধূলি দিয়েছেন সেই লঞ্চে টেলিভিশনের মতন বেশরিয়তী যন্ত্র থাকতে পারে না। এটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। থাকলেও চালানো উচিত হয় না। কিন্তু পীর সাহেবের উপস্থিতি উপেক্ষা করে সেদিন টিভি অন করে রাখা হলো। মুরিদরা এসে সতর্ক করলেও শোনা হলো না। মুরিদরা ফিরে গেল ব্যর্থ মনোরথে। খানিক বাদেই ‘ঠাস’ করে একটি শব্দ হলো। মুরিদরা তড়িঘড়ি করে এসে দেখল, টিভি বার্স্ট হয়ে গেছে। যিনি দূর থেকে টিভি বার্স্ট করার ক্ষমতা রাখেন, দূর থেকে আরও অনেক কিছুই বার্স্ট করতে পারার কথা।
আরেকজন পীর ফুঁ দিয়ে পানির গ্লাস ভাঙতে পারেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তার ‘ফুঁ’ এর সদ্ব্যবহার করা গেলে শত্রুসেনার বহু যুদ্ধ-উপকরণ ও সরঞ্জামাদি শুধু ফুঁ দিয়েই ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। একজন আছেন ঘূর্ণিঝড় থামিয়ে দিতে পারেন। থামানোর ক্ষমতা যখন আছে, আরম্ভ করার ক্ষমতাও নিশ্চয়ই আছে। শত্রুশিবিরে ঘূর্ণিঝড় পাঠিয়ে তছনছ করে দিলেই খেল খতম। একজন কামেল পীর নষ্ট স্পিডবোট ঠিক করেছিলেন কেবল একটু আঙ্গুল স্পর্র্শ করেই। জাতির প্রয়োজনে তার আঙ্গুলটিও বিরাট অবদান রাখতে পারে। (উপরোক্ত ঘটনাগুলোর সত্যতা নিশ্চিত নই, কথিত পীরে কামেলদের মুরিদরা ইন্টারনেটে লিখে রেখেছেন, সেটার সূত্রধরেই বলা)
এছাড়াও আমাদের দেশে এক ধরনের ক্ষমতাধর আছেন, তারা জাদু-টোনা ও বাণ মেরে মানুষকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত করতে পারেন। যাকে বাণ মারা হবে সেই ব্যক্তি আস্তে আস্তে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে। বিশ্বের সেরা ডাক্তারও তার চিকিৎসা করা দূরে থাক, রোগই সনাক্ত করতে পারবে না। এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় আমরা শত্রুপক্ষের বড় বড় সেনা অফিসারদের বাণ মেরেই কুপোকাত করে ফেলতে পারি।
শত্রুসেনার হাতে আধুনিক সব প্রযুক্তি আছে বলে অনেকে ভয়ভীত হতে পারেন। তাদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, আমাদের হাতে কিন্তু তার চাইতেও বড় প্রযুক্তি আছে। অবশ্য সেটাকে ‘প্রযুক্তি’ বলে খাটো করা কোনো কাজের কথা হচ্ছে না, ধরা যাক সেটা একটা গুপ্ত ‘জ্ঞান’। বিচিত্র উপায়ে এক বা একাধিক পীরে কামেল তৈরি হয়েছেন তারা বাতেনি জ্ঞান অর্জন করতে করতে এই পর্যন্ত গেছেন যে, আল্লাহ-রসুলের সাথে এখন তাদের নাকি প্রায়ই কথা চালাচালি হচ্ছে! ইউটিউবে ‘আল্লাহর সাথে কথা’ লিখে সার্চ দিলেই এ বিষয়ে একাধিক ভিডিও দেখতে পাবেন। অবশ্য তার সত্যাসত্য আমি জানি না। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীরা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। তবে আমার ধারণা- এমন দাবিদার ব্যক্তিও থাকতে পারেন, অসম্ভব নয়। কিছুদিন আগে জনৈক ব্যক্তির ছাপানো একটি হ্যান্ডবিল আমার হাতে আসে। উক্ত হ্যান্ডবিলে চ্যালেঞ্জ করে বলা হয়- তিনি স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখাতে পারবেন। স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখবার মতন স্পর্ধা এই অধমের নেই বলে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি।
আমার দুশ্চিন্তার জায়গাটা হচ্ছে, এমন মহা মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তি যেই জাতির মধ্যে আছেন সেই জাতির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পাপের ভাগী হচ্ছি কিনা! সেই জাতির অভিধানে তো কেবল একটাই শব্দ থাকা উচিত- ‘বিজয়’।
সিদ্ধান্ত ৪:
এই মুহূর্তে অন্তত কয়েক শত ইমাম মাহদী (আ.) ও ঈসা (আ.) দাবিদার ব্যক্তি বাংলাদেশের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই তথ্য আমার মনগড়া নয়, ইন্টারনেটে বহু লেখালেখি আছে এই নিয়ে। গুগলে ‘ইমাম মাহদী দাবি’ লিখে সার্চ দিলেই আপনি বহু ইমাম মাহদী দাবিদার ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য উপাত্য পাবেন। তাদের সবার দাবি তারা আখেরী জামানার সেই বহুল প্রতীক্ষিত মহামানব- যারা মুসলিম উম্মাহর ভাগ্য পরিবর্তনের কারণ হবেন। তাদের সবাইকে খুঁজে খুঁজে বঙ্গভবনে জড়ো করে রাষ্ট্রপতি বলতে পারেন, ‘সারা মুসলিম উম্মাহর ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে না, আপাতত এমন কিছু করুন যাতে বিশ্বের বাঘা বাঘা পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে।’ তারা কিছু করে দেখাবেন বলেই আমার বিশ্বাস। একদিকে দেশটাও রক্ষা পেল, অপরদিকে তারা হয়ত উপযুক্ত শত্রুর অভাবে এতদিন নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারেননি, তারও একটা সুযোগ এসে গেল!
৪.
হঠাৎ চাচামিয়ার হেড়ে গলায় আমার ধ্যান ভাঙে।
– ‘এই ছেলে! তুমি উঠ না ক্যান? গাড়ি তো মালিবাগের কাছে আইয়া পড়ছে।’
– ‘চাচা, আপনার পরিচিত কয়েকজন বাতিলের আতঙ্ক, মুফতিয়ে আজম, পীরে কামেল ও মাহদীর নাম বলতে পারেন? বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়া আলাপ করতে চাই।’
– ‘গাঞ্জা খাইসো নাকি?’
গাঞ্জা খেয়েছি কিনা- এরকম একটি প্রশ্নের মুখোমুখী হবার পরেও কারো সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া যায় না। আমি হতোদ্যম হয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম। তবে আফসোস হলো চাচামিয়ার জন্য। তিনি আমার মহান আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পারলেন না!
[বি.দ্র: আখেরী জামানায় ইমাম মাহদী (আ.) ও ঈসা (আ.) এর আগমন ঘটবে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃত ইমাম মাহদী (আ.) ও ঈসা (আ.) এর প্রতি আমার আত্মা থেকে সালাম ও দোয়া রইল। তাদের জন্য আমার জান কোরবান।]
মোহাম্মদ আসাদ আলী: কলাম লেখক। (facebook/asadali.ht)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...