হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

যখন আমরা স্বাধীন ছিলাম

55মোহাম্মদ হাসানুয্যামান

স্বাধীনতা ও পরাধীনতা। এই দু’টি প্রেক্ষাপট একটি জাতির জাতীয় চরিত্রে যেমন প্রভাব ফেলে তেমন বোধহয় আর কিছুতে ফেলে না। স্বাধীন জাতির মানুষগুলি হয় উন্নতশির, পরাধীন জাতি হয় নতশির, স্বাধীন জাতির মানসিকতা থাকে উদার, পরাধীন জাতি সব সময় ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে থাকে, তাদের মন থাকে সঙ্কীর্ণ। কবিগুরুর ভাষায়:
অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।
কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে ‘হায় হায়’ ॥
অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে – আধুনিক বিশ্বে বাঙালি জাতি দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত একটি জাতি হিসাবে পরিচিত। শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এবং সামরিক শক্তির মাপকাঠিতে উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাঙালিরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবে আজকের এই পিছিয়ে পড়া দেখে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এই জাতি চিরটাকালই এমন পশ্চাদপদ। এই জাতির অতীত ঐতিহ্য যে কোনো প্রাচীন সভ্যতার জন্য ঈর্ষণীয়। ঐতিহ্যমণ্ডিত এ জাতিটি সময়ের স্রোতে যে ইতিহাস রচনা করে এসেছে তার সাথে বর্তমান অবস্থার রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাদেরকে চিরকাল গোলাম বানিয়ে রাখার জন্য সেই ইতিহাস আড়াল করে রাখা হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস খুঁড়ে দেখলে দেখা যায়, আজকের বাঙালি আর অতীতের বাঙালি জাতির মধ্যে ভাষা ব্যতীত আর কোনো বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য নেই। বিজাতির গোলামি করতে করতে তাদের নিজেদের ভিতরে সৃষ্টি হয়েছে ভয়ানক হীনম্মন্যতা। তথাপি তাদের বিলুপ্তপ্রায় যে ইতিহাসটুকু এখনও বিরাজমান আছে তাতেই স্পষ্ট হয় তাদের বীরত্বগাঁথা গৌরবান্বিত ইতিহাস।
সুলতানি আমল শেষে মুঘলরা যখন উপমহাদেশ দখল করল উপমহাদেশের প্রায় সবগুলো জায়গা তাদের করায়ত্ব হলেও এক বাংলাকে দখল করতেই তাদের লাগে প্রায় এক শতাব্দী। কারণ এই ‘বাংলা’ বাদে উপমহাদেশের বাকি সব জায়গাই মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। অপরদিকে বাংলাকে বার বার আক্রমণ করেও তারা দখল করতে পারে নি। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন তখন বাংলা, বিহার, ওড়িষ্যা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ থেকে পুরি পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট গৌড় অঞ্চলের স্বাধীন সুলতান। পন্নী সুলতানদের এই শাসনামল ইতিহাসের পাতায় কররানী শাসন (Karrani Rule) নামে অঙ্কিত। প্রকৃতপক্ষে পন্নী বংশীয়দের পূর্বপুরুষগণ আফগানিস্তানের কাররান এলাকার অধিবাসী ছিলেন আর গোটা আফগানিস্তানই ছিল বৃহত্তর ভারত তথা মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত। দাউদ খান পন্নী সম্পর্কে বাংলাপিডিয়াতে উল্লেখিত আছে,
“Daud Khan Karrani (1573-1576) the younger brother of BAYAZID KARRANI and the last independent sultan of Bengal. When Bayazid was killed through the treachery of Hansu, Daud ascended the throne of Bengal with the help of the faithful nobles of SULAIMAN KARRANI and continued his brother’s policy of independence. He, as a mark of royalty, read the Khutbah and issued coins in his name”
অর্থাৎ দাউদ খান কররানী (১৫৭৩-১৫৭৬) ছিলেন বায়াজীদ কররানীর ছোটভাই এবং বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান। বায়াজীদ খান হাঁসু নামক এক বিশ্বাসঘাতক দ্বারা নিহত হলে দাউদ খান তার বাবা সুলায়মান খান কররানীর শুভাকাক্সক্ষীদের সহায়তায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তার বড় ভাইয়ের মতই স্বায়ত্বশাসনের নীতি বজায় রাখেন। স্বাধীনতার চিহ্নস্বরূপ তিনি নিজের নামে খোতবা পাঠ ও মুদ্রা প্রবর্তন করেন।
উল্লেখ্য, সারা উপমহাদেশে তখন দিল্লির সম্রাট আকবরের নামে খোতবা দেওয়া হলেও আমাদের দেশে খোতবা দেওয়া হতো দাউদ খান পন্নীর নামে। মুঘলরা বহুভাবে চেষ্টা করেছে বাংলা দখল করতে কিন্তু সমর্থ হয় নি। বাঙালিদের দেশপ্রেম, রণ কৌশল আর বীরত্বের কাছে মোঘলরা ছিল নিরুপায়। দাউদ খান এতটাই স্বাধীনচেতা ও দুর্ধর্ষ ব্যক্তি ছিলেন যে, মুঘল শাসনের বশ্যতা স্বীকার দূরের কথা তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সীমান্ত দুর্গগুলিতে আক্রমণ শুরু করেন। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সম্রাট আকবরের সেনাপতি মুনিম খান দাউদ খান পন্নীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। একটার পর একটা যুদ্ধ চলতে থাকে, মোঘলরা দাউদ খানের বাহিনীর বিরুদ্ধে এঁটে উঠতে পারেন না। এক পর্যায়ে দাউদ খান পন্নীকে দমন করতে বাদশাহ আকবর স্বয়ং নিজে সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তখন কৌশলগত কারণে দাউদ খান বাদশাহের সাথে সাময়িকভাবে সন্ধিতে আবদ্ধ হন। কিছুদিন পরেই আবার তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বেধে যায় আবার যুদ্ধ। দীর্ঘ এই যুদ্ধে দাউদ খান পন্নী পরাজিত হন এবং তাকে খানজাহান হোসেন কুলী বেগ বন্দী অবস্থায় হত্যা করলেন। এই হত্যাকাণ্ড ঐতিহাসিক গ্রন্থ “রিয়াজুস সালাতীন”-এ লেখক মন্তব্য করেন যে, “মুঘল সেনাপতি খানজাহানের বীরধর্মের সম্পূর্ণ অভাব লক্ষ্য না করে পারা যায় না। তার অব্যবহিত পূর্বসূরী খান-ই-খানানের এক চতুর্থাংশ বীরধর্মবোধ যদি এর থাকত, তাহলে তিনি এরূপ হিংস্র ও কাপুরুষোচিত নৃশংসতা করতে পারতেন না। দাউদ শাহের মতো যোগ্য ও বীর প্রতিদ্বন্দ্বীর এতদপেক্ষা মহৎ ব্যবহার প্রাপ্য ছিল। খানজাহানের প্রভু মহান আকবর এই প্রকার দুষ্কার্যের প্রতিরোধের ব্যবস্থা আগে থেকে না করায় তার স্মৃতিও কলঙ্কিত হয়।”
মুঘলদের পর ইংরেজরা যখন এই উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিস্তার শুরু করল তখনও বাঙালি জাতি তাদের স্বভাবতই বীরত্বের প্রমাণ রেখেছে। ইংরেজরা বঙ্গবাসী বাঙালিদের সম্পর্কে সর্বদায় শঙ্কিত থাকত। এ বিষয়ে জনাব মোহাম্মাদ বায়াজীদ খান পন্নী তাঁর নিজস্ব শিকারী জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই ‘বাঘ বন বন্দুক’-এ বলেছেন, “পশু শিকার মানুষের আদি পেশা ও নেশা। সভ্যতার পর্যায়ক্রমে মানুষ তার এই পেশাকে ভুলে গেলেও নেশাকে সে কাটিয়ে উঠতে পারে নি। আর তাই আজও দাদা-দাদি অথবা বৃদ্ধদের কাছ থেকে শোনা যায় শিকারের গল্প। যদিও আস্তে আস্তে এই শিকার হয়ে যাচ্ছে রূপকথার উপকরণ। ব্রিটিশ আমলেও স্থানীয় জমিদাররা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় শিকার করতেন। তবে তখন শিকার করতে ব্যবহার করা হতো বন্দুক বা রায়ফেল। এমনই এক ধরনের .২২ বোরের  Air gun অর্থাৎ পাম্প করে হাওয়া ভরা খেলনা বন্দুক পাওয়া যেত। এই বন্দুকের ক্যাটালগে লেখা থাকত – No license required except in Bangal  অর্থাৎ বাংলা ছাড়া অন্য কোনো লোকদের এই বন্দুকের জন্য লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই।
সেদিক দিয়ে অবশ্য গর্ব করাই যেতে পারে, কারণ উদ্ধৃতিটিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে – যেখানে তামাম উপমহাদেশের লোকদের ইংরেজরা মোটেও ভয় পেতো না, সেখানে বাংলা ছিল তাদের শঙ্কার বিষয়। কিন্তু দু’শ বছরের পরাধীনতার শিকল বাঙালিদের সেই স্বাধীনচেতা ডানাকে ভেঙে দিয়েছিল। যার ফলে আজ আমরা এতটা নিবীর্য জাতি।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...