হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

মুসলিম নামক এই জাতির করণীয়

মাহবুব আলী :
বর্তমান পৃথিবীতে মুসলিম বলে পরিচিত ১৬০ কোটির এই জনসংখ্যাটির কী করুণ অবস্থা! পৃথিবীর অন্য সব জাতিগুলি এই জনসংখ্যাকে পৃথিবীর সর্বত্র ও সর্বক্ষেত্রে পরাজিত করছে, হত্যা করছে, অপমানিত করছে, লাঞ্ছিত করছে, তাদের মসজিদগুলি ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে বা সেগুলিকে অফিস বা ক্লাবে পরিণত করছে। এই জাতির মা-বোনদের তারা ধর্ষণ করে হত্যা করছে। অথচ আমরা এক সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি ছিলাম। পৃথিবীর অন্যান্য সব জাতি সভয় সম্ভ্রমসহ আমাদের পানে তাকিয়ে থাকত। এই পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি জায়গায় শাসন ক্ষমতা এই মুসলিম বলে পরিচিত জাতির হাতে ছিল। তারা ঐ ক্ষমতাবলে ঐ বিশাল এলাকায় আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখন পৃথিবীতে সামরিক শক্তিতে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সভ্যতায়, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে, Technology-তে, আর্থিক শক্তিতে এই জাতি সমস্ত পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ছিল; তাদের সামনে দাঁড়াবার, তাদের প্রতিরোধ করার মতো কোন শক্তি পৃথিবীতে ছিল না। এরপর তাদের ওপর নেমে এল আল্লাহর গযব। কয়েক শতাব্দী আগে আল্লাহ ইউরোপের খ্রিষ্টান রাষ্ট্রগুলিকে দিয়ে মুসলিম বলে পরিচিত এই জাতিটিকে সামরিকভাবে পরাজিত করে তাদের গোলাম, দাস বানিয়ে দিলেন। এই সামরিক পরাজয়ের পর থেকে এই শোচনীয় পতনের কারণ কী? অনেক চিন্তাশীল লোকই অনেক রকম কারণের কথা বলেছেন; আমাদের ঈমান দুর্বল হয়ে গেছে, আমাদের মধ্যে ঐক্য নেই, শিক্ষা নেই ইত্যাদি নানা প্রকার কারণ তারা পেশ করেছেন। কিন্তু ওগুলো আসল কারণ নয়, ওগুলো ফল মাত্র। আসল কারণ হলো মুসলিম বলে পরিচিত জাতিটি কালিমা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই কালিমা ইসলামের আত্মা, ভিত্তি, মূলমন্ত্র। এই কালিমা ছাড়া কোন ইসলাম নেই। এই কালিমা সঠিক অর্থে অন্তরে বিশ্বাস না করে, মুখে প্রচার না করে এবং এর উপর আমল না করে অর্থাৎ একে মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম না করে কেউ মুমিন বা মুসলিম হতে পারে না। পৃথিবীময় কালিমার আজ ভুল অর্থ করা হয়। আজ সর্বত্র শেখানো হয় এবং বিশ্বাস করা হয় যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য অর্থাৎ মা’বুদ নাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কালিমা হচ্ছে – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। ইলাহ অর্থ মা’বুদ নয়। ইলাহ হচ্ছেন তিনি সেই সত্তা যার আদেশ শুনতে হবে, মানতে হবে, পালন করতে হবে অর্থাৎ সার্বভৌম। আর উপাস্য, মা’বুদ হচ্ছেন তিনি সেই সত্তা যাকে উপাসনা করা হয়। দু’টো ভিন্ন অর্থ। ইসলামের কালিমার সঠিক অর্থ হচ্ছে শুধু আল্লাহকে ইলাহ হিসাবে, একমাত্র আদেশদাতা হিসাবে বিশ্বাস করা, মেনে নেওয়া অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম ছাড়া অন্য সকল হুকুম বিধান প্রত্যাখ্যান করা।
কালিমার এই ভুল অর্থের পরিণাম হয়েছে এই যে, পৃথিবীর মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যা অর্থাৎ আমরা আল্লাহকে হুকুমদাতা, আইনদাতা হিসাবে ভুলে গিয়ে তাঁকে শুধু উপাস্য, মা’বুদ বিশ্বাস করে আপ্রাণ তাঁর উপাসনা করে, নামাজ, যাকাত, হজ্ব, রোযা করে আসমান জমিন ভর্তি করে ফেলছি, কিন্তু আমাদের সমষ্টিগত জীবনে কেউ তাঁর আদেশ, হুকুম শুনি না, পালন করি না। আল্লাহর দেওয়া জীবন-ব্যবস্থা (দীন) কে বাদ দিয়ে আমরা সমষ্টিগত জীবনে পাশ্চাত্য ইহুদি খ্রিষ্টানদের তৈরি জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ থেকে অর্থাৎ কালিমা থেকে বের হয়ে কার্যতঃ মুশরিক ও কাফের হয়ে গেছি। আজ জাতীয় জীবনে, সমষ্টিগত জীবনে, রাষ্ট্র্রীয় জীবনে পৃথিবীর কোথাও আল্লাহর আদেশ পালন করা হচ্ছে না, মুসলিম বলে পরিচিত দেশগুলোতেও না। সর্বত্র মানুষের নিজেদের তৈরি এবং ইহুদি, খ্রিষ্টানদের তৈরি জীবন-ব্যবস্থাকে মেনে নেয়া হয়েছে আল্লাহর দেওয়া জীবন-ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে। এই কাজ করে আমরা কালিমা থেকে, ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছি। আজ পৃথিবীর ‘অতি মুসলিমরা’ নামাজে, রোযায়, হজ্বে, তাহাজ্জুদে, তারাবীতে, দাড়ি, টুপি-পাগড়িতে, পাজামায়, কোর্তায় নিখুঁত। শুধু একটিমাত্র ব্যাপারে তারা নেই, সেটা হলো তওহীদ, কালিমা–একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে সামগ্রিক জীবনের বিধানদাতা, আদেশদাতা হিসাবে মানি না। যে আংশিক অর্থাৎ ব্যক্তিগত ঈমান (যা প্রকৃতপক্ষে শিরক) তাদের মধ্যে আছে তা আল্লাহ আজও যেমন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছেন, হাশরের দিনেও তেমনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবেন।
একেবারে কালিমা থেকে বিচ্যুতি ছাড়াও আমরা এ সত্য যামানার এমামের কাছ থেকে বুঝেছি যে, আল্লাহ তাঁর শেষ নবীর মাধ্যমে যে ইসলাম পৃথিবীর মানুষের জন্য পাঠিয়েছিলেন তা নানা কারণে ক্রমে ক্রমে বিকৃত হয়ে বর্তমানে যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে তাতে এই ইসলাম আর সেই ইসলামই নেই। আল্লাহর সেই প্রকৃত ইসলাম যেটা আল্লাহ নবীর মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন যারা সেটা গ্রহণ করল তাদের উপর তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে তারা কঠিন জিহাদের (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সংগ্রাম) মাধ্যমে সেটাকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করবে। এবং এও তিনি সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, তারা যেন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম পরিত্যাগ না করে। (সুরা তওবা-৩৮-৩৯)। কিন্তু এই জাতি ৬০/৭০ বছর আল্লাহর আদেশ মোতাবেক সংগ্রাম চালিয়ে অর্ধেক পৃথিবীতে এই সত্যদীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর দুর্ভাগ্যক্রমে আকিদার বিকৃতির কারণে আল্লাহর সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে সংগ্রাম পরিত্যাগ করে অন্যান্য রাজা বাদশাহদের মতো রাজত্ব বাদশাহী উপভোগ করতে আরম্ভ করল। আল্লাহর সাবধানবাণী কখনও মিথ্যা হতে পারে? পারে না। তাই তিনি ইউরোপের খ্রিষ্টান জাতিগুলি দিয়ে মুসলিম জাতিটিকে সামরিকভাবে পরাজিত করে তাদের গোলাম বানিয়ে দিলেন। সেই গোলামি আজও চলছে।
আমাদের আজ ব্রিটিশ খ্রিষ্টানদের তৈরি করা বর্তমানে প্রচলিত বিকৃত, বিপরীতমুখী ইসলাম ত্যাগ করে আল্লাহ- রসুলের প্রকৃত ইসলামে ফিরে যেতে হবে। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই বিকৃত ইসলাম ত্যাগ করে, এ থেকে হেজরত করে যারা আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামে ফিরে যাবেন তারা অর্থাৎ আমরা সৌভাগ্যবান। আল্লাহ তাঁর অশেষ দয়ায় এই অমানিশার ঘোর অন্ধকারে রসুল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সেই সঠিক, প্রকৃত ইসলামের দিকে আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমরা পথহারা, গোমরাহ ছিলাম, আমরা বিকৃত, বিপরীতমুখী ধর্মটাকেই সঠিক ইসলাম মনে করে সেটাকেই প্রাণপণে পালন করছিলাম, সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করছিলাম। আজ আমরা আমাদের সাংঘাতিক ভুল বুঝতে পেরেছি। যামানার এমামের মাধ্যমে আজ আমরা বুঝেছি প্রকৃত ইসলাম কী, ইসলামের সঠিক আকিদা কী, তওহীদ কী, ঈমান কী, ইবাদত কী, মুমিন কী, মুসলিম কী, উম্মতে মোহাম্মদী কী, হেদায়াহ কী, তাকওয়া কী, সালাতের (নামাজ) সঠিক উদ্দেশ্য কী, দীন প্রতিষ্ঠার তরিকা, কর্মসূচি কী এবং কিভাবে তাকে প্রয়োগ করতে হয়। বুঝেছি কেন সংখ্যায় মাত্র পাঁচ লাখ উম্মতে মোহাম্মদী অশিক্ষিত, চরম দরিদ্র, অস্ত্রহীন হওয়া সত্ত্বেও ৩০ বছরের মধ্যে অর্ধেক পৃথিবীর কর্তৃত্ব পেয়েছিলেন, দু’টি বিশ্ব-শক্তিকে (Super Power) একটা একটা করে নয়, এক সাথে সামরিকভাবে পরাজিত, ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলেন, কেন উম্মতে মোহাম্মদীর নাম শুনলে শত্র“র অন্তরাত্মা ভয়ে কেঁপে উঠত এবং কেন আজ এ জাতি সংখ্যায় ১৬০ কোটি হওয়া সত্ত্বেও, এদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ফকিহ, মোহাদ্দেস, মোফাস্সের, মুফ্তি, আলেম, লক্ষ লক্ষ পীর দরবেশ থাকা সত্ত্বেও, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিরাট অংশের মালিক হওয়া সত্ত্বেও, অন্য সব জাতির লাথি খাচ্ছে। তারা আল্লাহ প্রদত্ত সংজ্ঞা মোতাবেক মুমিন নয়। আল্লাহ কোর’আনে মুমিনের সংজ্ঞা দিচ্ছেন- “প্রকৃত মুমিন শুধু তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে বিশ্বাস করে, তারপর (ঈমান আনার পর) আর তাতে কোন সন্দেহ করে না, এবং তাদের জান ও সম্পত্তি দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে” (সুরা হুজরাত ১৫)। তাছাড়াও আল্লাহ কোর’আনে কাফেরের যে সংজ্ঞা দিচ্ছেন তা হলো – আল্লাহ যে আইন, বিধান নাযিল করেছেন তা দিয়ে যারা হুকুম করে না অর্থাৎ শাসনকার্য, বিচার ফায়সালা পরিচালনা (এখানে বিচার অর্থে আদালতের বিচার, শাসনকার্য সব বুঝায়, কারণ শব্দটা হুকুম) করে না তারাই কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা- ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এখানে আল্লাহ-রসুলের প্রতি বিশ্বাস ও কোন প্রকার ইবাদত করা বা না করার শর্ত রাখা হয় নি।
কাজেই এই কুফরি থেকে, শেরক থেকে কালিমাতে, তওহীদে ফিরে এসে মুমিন-মুসলিম হতে হবে এই জাতিকে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...