হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই দুর্দশার হেতু কী? (১ম পর্ব)

রিয়াদুল হাসান:
মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই দুর্দশার হেতু কী? এ প্রশ্নের উত্তর জানা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত জরুরি। যেমন একজন দণ্ডিত ব্যক্তির জানার অধিকার আছে যে তার অপরাধ কী, তেমনি গত কয়েকশত বছর ধরে অন্য সকল জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা নির্মম নৃশংসতার শিকার এই মুসলিম জনগোষ্ঠীকেও জানতে হবে কী তার অপরাধ? নতুবা এইভাবে মার খেতে খেতে বহু নৃগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মতো তারাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এখনও যে নিশ্চিহ্ন হয় নি তার কারণ মুসলিমদের বীরত্ব নয়, বরং তাদের অগণিত সংখ্যা।
আমাদের মুসলিমদের ভাগ্য আজ ফুটবলের মত। ফুটবল যার পায়ের সামনে যায় সে-ই একটা লাথি মারে, সেটা নারী হোক, শিশু হোক বা বৃদ্ধই হোক। তেমনি আমরা মুসলিমরা যেখানেই বাস করি সেখানেই আমরা লাঞ্ছিত, অপমানিত, নির্যাতিত। মুসলিম বংশোদ্ভ‚ত হয়েও যারা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদেরকে মুসলিম বলতে চান না, তারাও লাথি প্রদানকারীদের লাথি থেকে রক্ষা পান না। উত্তরাধিকারসূত্রে তারাও বোমার আঘাতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন, উদ্বাস্তু শিবিরে বসে ত্রাণের জন্য হা-পিত্তেশ করছেন। সুতরাং তাদেরও জানার প্রয়োজন আছে কেন এই অবস্থা মুসলিমদের। এটা কি তাদের কর্মফল? কোন কর্মের ফল? এটা কি তাদের শাস্তি? কীজন্য এই শাস্তি?
এটা বুঝতে হলে আমাদেরকে রসুলাল্লাহর সময় থেকে আজকের দিন পর্যন্ত পুরো কালখণ্ডকে এক নজরে দেখতে হবে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয় নি, ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি থেকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বিচ্ছিন্ন নয়; সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের থেকে ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষ বিচ্ছিন্ন নয়। সিরিয়ার পরিণতি আর লিবিয়ার পরিণতি এক সূত্রে গাঁথা। সেই সূত্রটাকে চিহ্নিত করতে না পারলে আলাদা আলাদা ভূ-খণ্ডে সংকট মোকাবেলা করে বিন্দুমাত্রও লাভ হবে না। কিছুদিন পর পর একেক জায়গায় রণাঙ্গন খুলে যাবে। এ এখন আমরা বিগত তেরশ বছরের ইতিহাসকে কার্যকারণসূত্রে বন্দী করে এক নজরে দেখানোর প্রয়াস পাবো।
১. মুসলিমদের উদ্দেশ্যচ্যুতি: আল্লাহর রসুল (সা.) যে উদ্দেশ্য নিয়ে একটি জাতি সৃষ্টি করেছিলেন সেটা হচ্ছে সমগ্র পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচার লুপ্ত করে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন মানুষের জীবনে একটি নিখুঁত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সেই জীবনব্যবস্থা স্রষ্টা রসুলাল্লাহকে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ও তাঁর জাতি সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে অর্ধেক পৃথিবীতে সেই সত্যদীন, সঠিক জীবনপদ্ধতির প্রচলন করলেন। তার ফলে সেখানে অভাবনীয় সমৃদ্ধি, প্রগতি, নিরাপত্তা এক কথায় শান্তি (আরবিতে ইসলাম) প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রসুল এসেছিলেন সমগ্র পৃথিবীতে সেই শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে, কিন্তু তাঁর জাতি অর্ধেক দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পর তাঁর বিদায়ের ৬০/৭০ বছর পর তাদের উদ্দেশ্য ভুলে গেল। তাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য পাল্টে হয়ে গেল সাম্রাজ্যবিস্তার ও ভোগ বিলাস করা। একটি কলমের উদ্দেশ্য হচ্ছে লেখা। যখন নষ্ট হয়ে যাওয়ার দরুন সেটা দিয়ে আপনি আর লিখতে পারছেন না অর্থাৎ যখন আর সেটা তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারছেন না তখন আপনি অবশ্যই সেটাকে বাদ দিয়ে অন্য কলম দিয়ে লিখবেন। তেমনি যে উদ্দেশ্যে মুসলিম জাতিটিকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সেটাই তারা বাদ দিল আল্লাহ সেই জাতিকে পরিত্যাগ করলেন। এরপরও তারা আগের মতই নামাজ, রোজা, হজ্ব, তসবিহ, জেকের, দাড়ি, আরবীয় পোশাক-আসাকের চর্চা চালিয়ে যেতে লাগল আর মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে যেতে লাগল যে তারাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তারাই জান্নাতের হকদার।
২. জাতির মধ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভক্তি: যখন মুসলিম জাতি বিপুল সম্পদ ও ক্ষমতার মালিক হয়ে বসল তখন তারা জেহাদ ছেড়ে দিয়ে ভোগবিলাসে মগ্ন হলো। একটি যুদ্ধরত জাতি যখন যুদ্ধ ছেড়ে দিল তাদের বিপুল অবসর ব্যয়িত হতে লাগল কী করে আরো বেশি ‘পরহেজগার’ বান্দা হওয়া যায় সেই গবেষণায়। জাতির মধ্যে জন্ম নিল আলেম শ্রেণি যারা দীনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা, অতিব্যাখ্যা, আরো ব্যাখ্যা শুরু করলেন এবং ক্ষুরধার মেধা খাটিয়ে লক্ষ লক্ষ মাসলা মাসায়েল আবিষ্কার করতে লাগলেন। একেক আলেমের অনুসরণ করে একেকটি মাজহাব/ফেরকা সৃষ্টি হতে লাগল। বহু সুফিবাদী গোষ্ঠীও ইসলামিক ভূ-খণ্ডের নাগরিক ছিল। তাদের মাধ্যমে ভারসাম্যহীন বিকৃত সুফিবাদ এই জাতির সদস্যদেরকে অন্তর্মুখী করে আধ্যাত্মিক সাধনায় বুঁদ করে দিল। এভাবে বহু সুফিবাদী তরিকায় জাতিটি বিভক্ত হয়ে গেল। মুসলিম জাতির মধ্যে দুর্লঙ্ঘ অনৈক্যের প্রাচীর তুলে দিলেন দীনের বিশেষজ্ঞ ও সুফিবাদীগণ। এই প্রাচীর আমরা আজও পার হতে পারি নি। ফলে আমরা পঞ্চান্নটির বেশি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত। যে যার রাষ্ট্রের মুসলিমদের বা নাগরিকদের নিয়ে চিন্তিত। সীমানার ওপারে থাকা মুসলিমরা হাজারে হাজারে আগুনে পুড়ে মরে গেলেও সেটাকে প্রতিহত করা, তাদেরকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী ব্যবহার করে একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার হামলাগুলোকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে ভিন্ন জাতির দ্বারা মুসলিমরা নির্যাতিত হচ্ছে না সেখানেও কিন্তু সহিংসতা বন্ধ নেই। আজকে মধ্যপ্রাচ্যের যে ‘পোড়ামাটি’ অবস্থা এর সূত্রপাত করেছে পূর্ববর্তী শত শত বর্ষব্যাপী শিয়া ও সুন্নীর পারস্পরিক হিংসা, প্রতিহিংসা, হামলা-পাল্টা হামলা। সরকারী দল ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর গৃহযুদ্ধে সিরিয়া এখন পোড়ামাটি। বেলুচিস্তানের মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছে অন্য কেউ নয়, পাকিস্তানী মুসলমানেরাই। ইয়েমেনের উপর দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিয়েছে আরববিশ্বই। নিজেদের মধ্যে এত বিভক্তি নিয়ে শত্রæদের হামলার মোকাবেলা করা মুসলিমদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আসলে মুসলিম জাতিসত্তাই এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে। কেউ আজ আরবীয়, কেউ রোহিঙ্গা, কেউ ইরানী, কেউ ইরাকী ইত্যাদি ভৌগোলিক রাষ্ট্রভিত্তিক পরিচয় নিয়ে তারা ‘ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি’ জপছে। ঐক্যহীনতাই যে তাদের পরাজয়, দাসত্ব ও লাথি খাওয়ার কারণ এটা বুঝতে খুব বেশি চিন্তার প্রয়োজন হয় না।
৩. আল্লাহর গজব ও দাসত্ব: আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে মুসলিম জাতিটিকে গঠন করেছিলেন সেই দায়িত্ব ত্যাগ করায় আল্লাহ এই জাতিটিকে অভিশাপ দিলেন। আল্লাহর ক্রোধের, গজবের শিকার হয়ে তারা প্রথমে মঙ্গোলীয়দের দ্বারা কচুকাটা হলো, তারপর ইউরোপের ক্রুসেডারদের দ্বারা পরাজিত হলো, তাদের দেশ ধ্বংস হলো, নারীরা ধর্ষিতা হলো, তাদের জ্ঞানের পাহাড়, সভ্যতার অহঙ্কার ধূলায় মিশে গেল। তাদের এই পরাজয়ের কারণ এই মহাসত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়া যে, সামরিক শক্তিই হচ্ছে চরম শক্তি। যেদিন তারা পূর্বে উল্লেখিত কারণে জাতীয়ভাবে অন্যায়বিরোধী দুর্ধর্ষ যোদ্ধা চরিত্র হারালো সেই দিন থেকেই এই লাঞ্ছনা তাদের ললাটলিখন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বহু পূর্বেই তাদেরকে সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে, “হে মোমেনগণ! তোমরা যদি অভিযানে বের না হও, তাহলে তিনি তোমাদেরকে ভয়াবহ শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের উপর অন্য জাতিকে প্রভু হিসাবে বসিয়ে দেবেন (সুরা তওবা ৩৯)।” সুতরাং লক্ষ্যবিচ্যুত হয়ে, ঐক্য নষ্ট করে, জেহাদ, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগের অবশ্যম্ভাবী ফল আল্লাহর শাস্তিস্বরূপই মুসলিমরা অন্য জাতির দাসত্ব করছে এবং মার খাচ্ছে। আল্লাহর লা’নত, গজব কোনো জাতির উপর পড়লে সেই জাতিকে রক্ষা করার সাধ্য আর মানবজাতির থাকে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তাদের উপর রহম করে লা’নত, গজব প্রত্যাহার করে নেন। কেন মুসলিমরা আল্লাহর লা’নত ও গজবের শিকার হলো তার কারণ হিসাবে আমি এখানে মাত্র দুটো কোর’আনের আয়াত উল্লেখ করছি।
১) কেমন করে আল্লাহ এমন জাতিকে হেদায়েত দান করবেন, যারা ঈমান আনার পর এবং রসুলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়ার পর এবং তাদের নিকট প্রমাণ এসে যাওয়ার পর কাফের হয়েছে। আর আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না। এমন লোকের শাস্তি হলো আল্লাহ, মালায়েকগণ এবং মানবজাতির সকলেরই অভিসম্পাত (সুরা ইমরান ৩: ৮৬-৮৭)।
২)  হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সাথে মুখোমুখী হবে, তখন পশ্চাৎপসরণ করবে না। আর যে লোক সেদিন তাদের থেকে পশ্চাদপসরণ করবে, অবশ্য যে লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তনকল্পে কিংবা যে নিজ সৈন্যদের নিকট আশ্রয় নিতে আসে সে ব্যতীত অন্যরা আল্লাহর গযব সাথে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। আর তার ঠিকানা হল জাহান্নাম। বস্তুতঃ সেটা হল নিকৃষ্ট অবস্থান (সুরা আনফাল ৮:১৫-১৬)।  (চলবে….)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...