হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

মহানবীর সমগ্র জীবনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

মোহাম্মদ আসাদ আলী:
যে সময়ের কথা বলছি তখনও রসুলাল্লাহ নবুয়তপ্রাপ্ত হন নি। আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াহ ও সত্যদ্বীন পাওয়ার অনেক আগের ঘটনা। সেই সময়েও আল্লাহর রসুল যুদ্ধ-রক্তপাত ও সহিংসতার বিরুদ্ধে কীভাবে অবদান রেখে গেছেন তা ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’ এ বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়।
রসুলাল্লাহর বয়স তখন পঁয়ত্রিশ বছর। এই সময় কুরাইশরা পবিত্র কাবার সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্কারকাজ তারা ভালোভাবেই শেষ করল, কিন্তু হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত দেয়াল নির্মাণ সম্পন্ন হলে হাজরে আসওয়াদকে যথাস্থানে কে স্থাপন করবে তা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হলো। এ নিয়ে গোত্রগুলো সংঘবদ্ধ হতে লাগলো, এমনকি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। বলা বাহুল্য, অনেক ছোটখাটো বিষয় নিয়েও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যুদ্ধ করে যাবার ইতিহাস তাদের ছিল। সে হিসেবে হাজরে আসওয়াদের বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঐ বিবাদের দ্রæত কোনো নিস্পত্তি না হলে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। ইতিহাসে দেখি সেই ভয়াবহ যুদ্ধের হাত থেকে কুরাইশদেরকে  যিনি রক্ষা করলেন তিনি আর কেউ নন, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.)।
বর্ণিত আছে যে, ঐ সময় সমগ্র কুরাইশ সম্প্রদায়ের প্রবীণতম ব্যক্তি আবু উমাইয়া ইবনুল মুগীরা বললেন, ‘‘হে কুরাইশগণ, এই পবিত্র মসজিদের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি প্রথম প্রবেশ করবে, তাকেই তোমরা এই বিবাদের মীমাংসার দায়িত্ব দাও।’’ সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। দৈবক্রমে তাদের সবার অত্যন্ত বিশ্বস্ত, আমানতদার, আল আমীন মোহাম্মদ (সা.) সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। সবাই বলে উঠল, ‘‘আরে এতো আমাদের আল আমীন মুহাম্মাদ। তাঁর ফয়সালাই আমরা মাথা পেতে নিব।’’ রসুল ঘটনা অবগত হয়ে বললেন, ‘‘তোমরা আমাকে একখানা কাপড় দাও।’’ কাপড় দেওয়া হলে তিনি তা বিছিয়ে হাজরে আসওয়াদকে কাপড়ের মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘প্রত্যেক গোত্রকে এই কাপড়ের চারপাশে ধরতে হবে।’’ দেখা গেল সবাই তা ধরে উঁচু করে যথাস্থানে নিয়ে গেল। তারপর তিনি নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ তুলে যথাস্থানে রাখলেন এবং তার উপর গাঁথুনি দিলেন। এভাবে একটি ভয়াবহ যুদ্ধের উন্মাদনা অংকুরেই শেষ হয়ে গেল। বেঁচে গেল হাজারো মানুষের প্রাণ।
তারও আগের একটি ঘটনা দেখুন। আল্লাহর রসুল তখন তরুণ, পনেরো থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে বয়স। এই বয়সে তিনি ফিজারের যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। কী করা যায় তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। এত দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গৃহযুদ্ধ, রক্তপাত, ঘৃণা ও বিদ্বেষের চর্চা তিনি কীভাবে বন্ধ করবেন? তাঁর বিবেকবোধ তাঁকে সমাজের অন্য দশজনের মত হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দিল না। কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একটি সংগঠন গড়ে তুললেন যার নাম ‘হিলফুল ফুজুল’। এই সংগঠনের লক্ষ্যগুলো কী ছিল খেয়াল করুন।
(১) শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা,
(২) বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা,
(৩) অত্যাচারিতকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করা,
(৪) দুর্বল, অসহায় ও এতিমদের সাহায্য করা,
(৫) বিদেশি বণিকদের জান ও মালের নিরাপত্তা বিধান করা এবং
(৬) সর্বোপরি সব ধরনের অন্যায় ও অবিচার অবসানের চেষ্টা করা।
এভাবে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) নবুয়তপ্রাপ্তির আগেই যুদ্ধ-রক্তপাতের বিরুদ্ধে অগ্রদূত হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও যখন দেখলেন অশান্তি বন্ধ হচ্ছে না, যুদ্ধবিগ্রহ থামছে না, তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে সফল হওয়া যাবে না। তাই সঠিক পথের সন্ধানে ধ্যানমগ্ন হলেন। নিজের সবটুকু আকুলতা ঢেলে দিলেন পরম করুণায় স্রষ্টার প্রতি। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবের ডাক উপেক্ষা করলেন না। জিবরাইল (আ.) এসে পাঠ করে শোনালেন মুক্তির অমিয় বাণী। পৃথিবী থেকে সমস্ত অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত বন্ধ করার সঠিক পথ পাওয়া গেল। এই ঘটনা একদিকে রসুলাল্লাহর চিত্তকে প্রশান্ত করলেও, আরেকদিকে একটি দুশ্চিন্তার ছাপ থেকে গেল যে, কোরাইশরা সত্য গ্রহণ করবে তো? কিছুকাল পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এল- যে সত্য আপনি পেয়েছেন সেটা প্রকাশ্যে প্রচার করুন। আল্লাহর রসুল প্রচার করতে লাগলেন। তিনি সকল গোত্রের মানুষকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তির পথ তুলে ধরলেন, সবাইকে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানালেন। সাধারণ জনগণ, গোত্রপতি, পুরোহিত সবার দারে দারে গেলেন, সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদেরকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে পশু জবাই করে আপ্যায়ন করলেন এবং আল্লাহর দেওয়া হেদায়াহ তাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। কিন্তু কী ঘটল সে ইতিহাস কারো অজানা নয়। তারা তাদের স্বভাবজাত নৈরাজ্য, রক্তপাত, হানাহানি চালিয়ে যেতে থাকল। শাসিতের উপর শাসকের অবিচার চলতেই থাকল। গোত্রে-গোত্রে অনৈক্য, দস্যুবৃত্তি, রেষারেষি ও নিরাপত্তাহীনতা রয়েই গেল। গোত্রপতি ও পুরোহিতরা তাদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত মনে করে নিজেরাও হেদায়াহ গ্রহণ করল না, সাধারণ জনগণকেও করতে দিল না। যে মুষ্ঠিমেয় মানুষ তওহীদ গ্রহণ করল তাদের অমানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হলো। কয়েকজনকে তো হত্যাই করে ফেলল। শেষাবধি রসুলাল্লাহকে পর্যন্ত হত্যার চক্রান্ত করল কোরাইশরা। অগত্যা রসুলাল্লাহর সামনে যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কোনো পথ খোলা রইল না।
এরই মধ্যে মদীনা নামক এক চিলতে ভূখণ্ড আল্লাহ তাঁর রসুলের হাতে তুলে দিলেন। সেখানকার ইহুদি, পৌত্তলিক, মুসলিম সবাইকে নিয়ে আল্লাহর রসুল চুক্তি করলেন যে, আমরা যে ধর্মেরই হই, যে গোত্রের হই, যে মতাদর্শের হই, আমরা সর্বদা থাকব ঐক্যবদ্ধ। আজ থেকে আমরা এক জাতি। আমাদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত হলে সবাই মিলে তাকে হেফাজত করব। কেউ অন্যায় করলে সবাই মিলে তাকে প্রতিহত করব। একজন অপরজনের বিরুদ্ধে, এক গোত্র অপর গোত্রের বিরুদ্ধে, এক ধর্মের অনুসারী অপর ধর্মের অনুসারীর বিরুদ্ধে কোনো শত্রæতা করব না, যুদ্ধ-রক্তপাত করব না। এই ঘোষণার ভিত্তিতে মদীনায় ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য ও ভ্রাতৃত্বের সমন্বয়ে গড়ে উঠল একটি নিরাপদ সমাজ। কিন্তু তখনও আরব উপদ্বীপের সর্বত্র অনৈক্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধ-রক্তপাত চলছেই। সেগুলোও বন্ধ করতে হবে। মদীনার নিরাপত্তা ছড়িয়ে দিতে হবে পুরো আরব উপদ্বীপ হয়ে সারা বিশ্বে। আর তা করজোড়ে অনুনয়-বিনয়ের মাধ্যমে যে হবে না তা তো প্রমাণিত। কাজেই মাত্র ১০ বছরের মধ্যে ছোটবড় মিলিয়ে ১০৭টি যুদ্ধ করলেন আল্লাহর রসুল। কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে সমস্ত আরব উপদ্বীপ থেকে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এক কথায় অনিরাপত্তা ও অশান্তি দূর করে এই বিশাল এলাকায় ঐক্য, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করলেন। নবুয়তের পূর্বে যে নিরাপদ আরবের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন নবুয়তের মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে ঠিক সেই স্বপ্নই সত্যে পরিণত হলো।
এক শ্রেণির ইসলামবিদ্বেষী আছেন দিবারাত্রি তারা আল্লাহর রসুলকে খাটো করার জন্য, তাঁর সংগ্রামী জীবনকে বিতর্কিত করার জন্য কতই না ছল-চাতুরির আশ্রয় নেন। রসুলের পুরো জীবনের অসংখ্য ঘটনা ও ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি-প্রেক্ষাপটকে আঁধারে রেখে নির্দিষ্ট কিছু ঘটনার উপর আলো ফেলেন- যেমন রসুলের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধগুলো। কখনও সামগ্রিক ইতিহাস থেকে কেবল যুদ্ধের বিষয়টিকে আলাদা করে আবার কখনও অনেকগুলো যুদ্ধের ধারাবাহিকতা থেকে কেবল একটি বা দুইটি ঘটনাকে আলাদা করে নিয়ে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেন এবং দেখানোর প্রয়াস পান আল্লাহর রসুল কত নির্মম ছিলেন! তাদেরকে বলব ইতিহাসকে যেন তারা ইতিহাসের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেন এবং খণ্ডিত ইতিহাসের চর্চা ছেড়ে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের উপর আলো ফেলেন। তা করতে পারলে আমাদেরকে আর কিছু বলতে হবে না, তারা নিজেরাই ১৪০০ বছর পূর্বের সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতে নিমজ্জমান মানুষগুলোর মধ্যে এমন একজন মহামানবের বৈপ্লবিক জীবন খুঁজে পাবেন, যাঁকে অধঃপতনের মাঝসাগর থেকে আস্ত একটি জাহাজকে একাই তীরে টেনে তুলতে হয়েছে। তাঁর জীবনীতে কোমলতা আছে, কঠোরতাও আছে, ক্ষমা আছে, দণ্ডও আছে, ধ্বংস আছে, নির্মাণও আছে। কিন্তু এইসবকিছুই নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে, এমন সমাজ নির্মাণের স্বপ্নকে সামনে রেখে, যে সমাজে হানাহানি থাকবে না, রক্তারক্তি থাকবে না, দাঙ্গা-হাঙ্গামা থাকবে না, অনিরাপত্তা ও অস্থিতিশীলতা থাকবে না এবং সেই সমাজ তিনি নির্মাণ করেই দেখিয়েছেন।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...