হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ব্রিটিশ প্রবর্তিত আত্মাহীন শিক্ষাব্যবস্থায় আমার মাদ্রাসা জীবনের তিক্ত স্মৃতি

রাকীব আল আল হাসান:

বাবার ইচ্ছা ছিল আমাকে কোর’আনের হাফেজ বানাবে। তাই শিক্ষাজীবনের শুরুটা হয় হাফেজিয়া মাদ্রাসার কঠোর অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। এরপর আলিয়া মাদ্রাসায়ও ছাত্রজীবনের বেশ কিছু সময় অতিক্রান্ত হয়। যে বয়সে গ্রামের শিশুগুলো রোদ-ঝড়-বৃষ্টি এক করে বেড়ায়, ফেরারি চিল হয়ে উড়ে বেড়ায়, ক্লান্তি চূর্ণ করার ছলে স্নেহসিক্ত হতে আসে বড়দের কাছে সেই বয়সে চার দেয়ালের মাঝে আটকা পড়েছি পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখির মতো, স্নেহের পরিবর্তে পেয়েছি যাকে শাসন না বলে নির্যাতন বললেই যথার্থ হয়। যাই হোক, সঙ্গত কারণেই মাদ্রসাশিক্ষিত আলেম-মোল্লাদের সম্পর্কে বেশ পরিষ্কার একটি ধারণা আমার আছে। আজ অনেকগুলি বছর পরেও সেই পেছনের দিনগুলির তিক্ততা আমার চিত্তকে বিষময় করে তোলে।
স্মৃতিখণ্ড:
১. এক সহপাঠিকে একদিন ডুকরে কাঁদতে দেখে কারণ জানতে চাইলে সে তার পিঠ দেখাল। পিঠের ওপর প্রায় বার থেকে পনেরটা স্পষ্ট বেত্রাঘাতের দাগ। সাদা পিঠ একেবারে রক্তীম হয়ে আছে। পিঠে হাত দিতেই চাপা কান্নার আওয়াজটা আরও করুণ আর বাধ ভাঙ্গা হয়ে উঠল। অপরাধ ছিল- টেলিভিশন দেখা।
২. মাঝে-মধ্যেই আমাদের হাতের নখ, চুল, দাড়ি, পকেটে মেসওয়াক ও ঢিলা-কুলুখ আছে কিনা ইত্যাদি চেক করা হতো। চুল, নখ, দাড়ি, মেসওয়াক ইত্যাদির জন্য বেত্রাঘাত ছিল সাধারণ ঘটনা। আমার খুব ভালো মনে আছে মিজান ভাইয়ের কথা। সে দাড়ি শেভ করে কিনা এটা বের করার জন্য রীতিমতো গয়েন্দাগিরি, গবেষণা হয়েছে বিস্তর। অবশেষে প্রমাণ হয়েছে যে সে দাড়ি শেভ করেছে। এর শাস্তি স্বরূপ তাকে নিষ্ঠুর বেত্রাঘাত করে মাদ্রাসা থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। এর কিছুদিন পরে তার সাথে আমাদের একবার দেখা হয়েছিল। ক্লিন শেভ করে প্যান্ট শার্ট ইন করে চোখে কালো গ্লাস পরে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল, তখন সে স্কুলে পড়ে। তখন সে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়ায়। তাকে দেখে মনে হয়েছিল-
“ওহে বিহঙ্গ/তোর ঐ পাঙ্খা দে না মরে কর্জ
যাই ঐ দূর নীলিমায়”
৩. একজনের অপরাধ ছিল ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে শার্ট গায়ে ছবি তুলেছিল। সাংঘাতিক দণ্ডনীয় অপরাধ। একইসাথে দুইটি অপরাধ করেছে সে, শার্ট গায়ে দিয়েছে এবং ছবি তুলেছে। দুটিই না’জায়েজ। এই অপরাধে তাকে গ্রীষ্মের প্রখর রোদে সারাটা দুপুর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল এবং শপথ করতে হয়েছিল এমন অপরাধ পুনরায় না করার।
৪. নাসির ভাই নামে একজন সহপাঠি ছিল। সে লজিং বাড়িতে পাপিয়া নামে এক মেয়ের সাথে প্রেম করতো। এই ঘটনা তার সমবয়সী কিছু ছাত্রও জানতো। ব্যাপারটা যখন হাফেজ সাহেবের কানে আসলো তখন মাদ্রাসার বড় হুজুররা বসে তার বিচার করে শাস্তি নির্ধারণ করল। একটা বন্ধ রুমের মধ্যে পাঁচজন শিক্ষক তাকে বেত দিয়ে প্রহার করে রক্তাক্ত করল। রুম থেকে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় বের করা হলো। তার গায়ের জামা এমন রক্তাক্ত হয়েছিল যে শরীরের সব রক্ত যেন শুষে খেয়েছিল তার ছিন্ন বসন। আমি কখনো ভুলতে পারি না সেই স্মৃতি। সেদিন সংগোপনে মনের মধ্যে অনেক অশ্র“বর্ষণ হয়েছিল, ভয়ে কান্না আটকে রেখেছিলাম।
৫. আমার মাদ্রাসা জীবনে এভাবে রক্তাক্ত হতে দেখেছি তিনজনকে। একজনেরটা বললাম। আর অপর দু’জনের মধ্যে একজনের অপরাধ ছিল বিদায় অনুষ্ঠানের মিষ্টি চুরি করে খাওয়া। এটা ছিল আলিয়া মাদ্রাসার হোস্টেলের ঘটনা, যদিও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি ছিল ষড়যন্ত্রের শিকার। তার নাম রওশন। রওশন ভাই অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের বাড়িতে লজিং থাকতেন। তিনি ছিলেন এতিম। খুবই শান্ত মেজাজের মানুষ ছিলেন। অন্য কিছু ছাত্র বিদায় অনুষ্ঠানের মিষ্টি চুরি করে খেয়ে তার ওপর দোষ চাপিয়েছিল। আর এই অপরাধেই তার গায়ের সাদা জামাটি রক্তে লাল হয়েছিল। আমার বাড়ির প্রায় সকলেই তার জন্য কেঁদেছিল।
৬. রক্তাক্ত হওয়ার তৃতীয় ঘটনাটি ছিল সমকামিতার। এই ঘটনা মাঝে মধ্যেই ঘটতো, তবে অপরাধীরা যখন বুঝতে পারতো যে হাফেজ সাহেবের কাছে তথ্য পৌঁছেছে তখনই তারা মাদ্রাসা ছেড়ে পালাতো এবং কখনোই তাদের আর দেখা যেত না। এই ব্যক্তিকে পালাতে দেওয়া হয় নি। কিছু ছাত্র তাকে আটকে রেখে পুণ্য কামিয়েছে। আমার ছাত্রজীবনে যতগুলি হেফজখানা এবং আবাসিক মাদ্রাসায় পড়েছি, এই অপরাধটিই সবচেয়ে বেশি দেখেছি। সব সময়ই দেখেছি প্রায় পাঁচ-ছয় জোড়া সমকামী ছিলই। অনেক শিক্ষককেও সমকামী হওয়ার অপরাধে বিতাড়িত হতে হয়েছে বলে শুনেছি।
৭. অধিকাংশ ছাত্রকেই দেখেছি তাদের অভিভাবকের চাপে, তাদের ইচ্ছা পূরণকল্পে মাদ্রাসায় পড়তে। মাদ্রাসার প্রতি, বিশেষ করে মাদ্রাসার কঠোর অনুশাসনের প্রতি তাদের মোটেও শ্রদ্ধাবোধ নেই। এ ছাত্রই যখন বড় হয়ে শিক্ষক হচ্ছে তখন তাদের মাঝে ইসলাম বলতে শুধু দাড়ি, টুপি আর বিকৃত আরবীয় লেবাস ছাড়া আর কিছুই থাকছে না। আমি খুব কমই দেখেছি কোন জনকল্যাণমূলক কাজে মাদ্রাসাশিক্ষিতদের দান করতে, সহযোগিতা করতে। দীনের কাজের বিনিময় নেয়া, সরকারী পরিদর্শক আসলে তাকে ঘুষ দেওয়া, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, মিথ্যা ফতোয়া দেওয়া তাদের কাছে যেন কোন অপরাধই না।

এগুলি আমার হাফিজিয়া ও আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময়ের কিছু স্মৃতি। আমি নিজে না দেখলেও নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে জানি যে কওমী মাদ্রাসার চিত্র আরো ভয়াবহ। মাদ্রাসাশিক্ষিত মোল্লাদের সবচেয়ে বড় একটি বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তারা জোর করে মানুষের উপর ইসলাম চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ চান মানুষকে পরীক্ষা করতে যে মানুষ তার জ্ঞান বুদ্ধি ব্যবহার করে সঠিক কাজ করে নাকি ভুল কাজ করে। এজন্য তিনি এই দীনের নীতি হিসাবে নিয়েছেন যে, এই দীনে কোনো জবরদস্তি নেই (সুরা বাকারা ২৫৬)। জোর করে কিছু করালে তার পরীক্ষা হবে কিভাবে? উপরন্তু এই মোল্লারা সেটা চাপিয়ে দিতে চাইছে সেটাও আল্লাহ রসুলের ইসলাম নয়। প্রকৃত ইসলাম কারও জন্য কষ্ট বয়ে আনতে পারে না। অথচ তাদের কর্তৃত্বের সীমিত গণ্ডির মধ্যে থাকা কিছু দরিদ্র পরিবারের নিরীহ ছাত্রছাত্রীদেরকে তারা যে পরিবেশে থাকতে বাধ্য করছে সেটা অমানবিক বর্বরতা। যেটা থেকে বেরোনোর জন্য সেখানকার ছাত্র নামক বন্দী জীবগুলির আত্মা সবসময় ওষ্ঠাগত হয়ে থাকে। জানি না এই অবিচারের হাত থেকে তারা কবে রক্ষা পাবে? আফগানিস্তানে তালেবানদের মাধ্যমে ঠিক এই ইসলামটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেখানে জোর করে দাড়ি রাখানো হতো, হেজাব করানো হতো, নামাজ পড়ানো হতো এছাড়াও অনেক কিছুই জোর করে করানো হতো। অথচ আল্লাহ তাঁর রসুলকে বলছেন, “তুমি তাদেরকে উপদেশ দিতে থাকো, নিশ্চয় তুমি তো তাদের নিকট একজন উপদেশদাতা মাত্র। তাদের উপর তোমাকে আমি বলপ্রয়োগকারী দারোগা হিসাবে পাঠাই নি।” (সুরা গাশিয়াহ- ২১, ২২)। আফগানিস্তানে যদি কখনো কাউকে হেজাব বাদে বাইরে দেখেছে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছে, নামাজ কাযা করার জন্য অমানবিক দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সৌদি আরবে এখনও কেবল চোখ আর হাতের কব্জি ছাড়া দেহের আর কোন অংশ উন্মুক্ত থাকলে তাকে ধর্মপুলিসের লাঠিপেটা খেতে হয়। পদে পদে নারী ও পুরুষকে জোর করে ধর্ম মানানো হয়। আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলিতে যে ইসলামটা দেখি সেই একই ইসলাম। পার্থক্য যে সেখানে এটা জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর আমাদের এখানকার মোল্লারা কাপুরুষতার সীমা অতিক্রম করতে পারে নি দেখে নিজেদের বাঁশবাগানের মধ্যে বাঘ সেজে বসে আছে। সুতরাং এইসব মাদ্রাসায় যা চলছে তা ইসলামের নামে ইউরোপীয় বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...