হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

বনি কুরাইজা: হত্যাকাণ্ড নাকি রাষ্ট্রদ্রোহীর দণ্ড? (২য় পর্ব)

মোহাম্মদ আসাদ আলী

(পূর্ব প্রকাশের পর) বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার খবর আল্লাহর রসুলের হৃদয়ে কেমন ভাবাবেগ সৃষ্টি করেছিল? আমরা সেটা জানি না, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় অনুমান করতে পারি তিনি কতটা বিস্মিত হয়েছিলেন। বিস্মিত হবার কারণ বনি কুরাইজা নামক ইহুদি গোত্রটির চুক্তিভঙ্গের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। নিজস্ব ধর্ম পালনে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। আল্লাহর সত্যনবীকে তারা অস্বীকার করেছে তওরাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও- তবু আল্লাহর রসুল তাদেরকে কোনোদিন জোরাজুরি করেননি। কোনো বিষয়েই তাদের সাথে অন্যায় করা হয়েছে এমন নজির নেই, কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দেওয়া হয়নি। শত্রুতার তো প্রশ্নই ওঠে না!

আল্লাহর রসুল মদীনায় হিজরতের পর একদিন সবগুলো গোত্রকে নিয়ে বসলেন। সর্বসম্মতিক্রমে একটি সনদ রচনা করলেন। সেখানে ঘোষণা করা হলো- ‘ইহুদি ও মুসলিমরা এক জাতি। আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করব না। মদীনা আক্রান্ত হলে সবাই মিলে যুদ্ধ করে স্বদেশকে শত্রুমুক্ত করব।’ আল্লাহর রসুল সর্বদা চেয়েছেন মদীনার প্রত্যেক গোত্র বর্ণের মধ্যে সম্প্রীতি ও সংহতি স্থাপন করতে এবং সর্বোপরি মদীনার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। এতে বনি কুরাইজার মত গোত্রগুলোও কি যথেষ্ট লাভবান হয়নি? এত ন্যায়-শান্তি-সুবিচার ও নিরাপত্তা তাদের জীবদ্দশায় তারা ভোগ করেছে কখনও? তবু বহিঃশত্রুর পক্ষ নিয়ে এই বিশ্বাসঘাতকের দল স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে মনস্থির করল! এতদিন যে মুসলিমরা নিজেদের জীবন দিয়ে মদীনার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এসেছে, সেই মদীনার সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আজ সেই মুসলিমদেরই নিশ্চিহ্ন করতে অস্ত্রধারণ করা- এই অপরাধের কেবল একটাই শাস্তি হতে পারে, যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকদের যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

মদীনার আরও দুই ইহুদি গোত্র বনি কায়নুকা ও বনি নাজির এখানে প্রাসঙ্গিক। বেশিদিন আগের কথা নয়। তারাও মদীনায় বসবাস করত। মদীনার সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। এক পর্যায়ে তারা নিরাপত্তা চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু তাসত্ত্বেও তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি, এমনকি বন্দী করা বা সমস্ত সহায়-সম্পদ কেড়ে নেওয়ার মত কঠোরতাও দেখানো হয়নি। কেবল মদীনা থেকে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়! কিন্তু সেই উদারতার মর্যাদা ওরা রক্ষা করতে পারল না। তারা আবারও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, এই খন্দকের যুদ্ধেই তারা কুশীলবের ভূমিকা পালন করেছে। সমগ্র আরবকে একত্রিত করে মদীনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে, এমনকি মদীনার ভেতরে ঢুকে স্বজাতীয় ইহুদিদেরকে প্ররোচিত করে ‘রাজাকার’ বানিয়ে ছেড়েছে। এই গোত্রগুলো ‘উদারতা’কে দুর্বলতা বিবেচনা করে। আসলে উদারতা এদের জন্য নয়। এদের প্রাপ্য যথাযথ ‘দণ্ড’।

যা হোক পরবর্তী ঘটনা সংক্ষেপে এই যে, রসুলাল্লাহর সফল কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কোরাইশদের সাথে বনি কোরাইজার সমঝোতা ভেস্তে যায়। তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস দানা বাঁধে। কোন্দল সৃষ্টি হয়। তারা একত্রিত হয়ে মুসলিমদের উপর চড়াও হবার যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র করেছিল- সেটা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরই মধ্যে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দৃঢ়তা ও অবিচলতার পুরস্কার দিতে শুরু করেন। রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয়ে মোশরেকদের তাঁবু ও রান্নার আসবাবপত্র লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আগুন নিভিয়ে দেয়। আবু সুফিয়ান তার দলবল নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা দেয়, গাতফানীরাও কুরাইশদের অনুসরণ করে অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে স্বদেশভূমির দিকে রওনা হয়। এভাবে যুদ্ধের একাংশ সমাপ্ত হয় বিনা রক্তপাতেই। কিন্তু অপর অংশ তখনও বাকি।

৩. বনি কুরাইজা অভিযান
বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার দণ্ড তখনও দেয়া হয়নি। আল্লাহর রসুল লোক পাঠালেন তাদের গতিবিধি দেখার জন্য। মুসলিমরা বনি কুরাইজায় পৌঁছলে ইহুদিদের মধ্যে নমনীয়তার বদলে যেন আরও ঔদ্ধত্য ফুটে উঠল। তারা আল্লাহর রসুল ও তাঁর স্ত্রী-পরিজন নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। তাদের মনোভাব যুদ্ধংদেহী। সম্ভবত তারা আশা করেছিল খায়বার থেকে অন্যান্য ইহুদিরা তাদের সাহায্যের জন্য আসবে। তাই কোরাইশরা চলে গেছে দেখে তারা মোটেও ভয়-ভীত নয়, বরং আনন্দিত এই ভেবে যে, এখন তারা সমস্ত ইহুদি মিলে মদীনাকে জব্দ করতে পারবে। তারাই হবে মদীনার সর্বেসর্বা।

আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা দৃঢ়তার সাথে বনি কুরাইজা গোত্রকে অবরুদ্ধ করে রাখল। অবরুদ্ধ ইহুদিরা সাহায্যের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকল। কিন্তু প্রায় পঁচিশ দিন পেরিয়ে যাবার পরও কোনোদিক থেকে সাহায্যের ছিটেফোঁটাও এলো না। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করল। ঘটনাটি এরকম- অবরোধ চলাকালে একদিন আলী (রা.) চিৎকার করে বললেন, ‘হে মো’মেন যোদ্ধারা! আমরা আজ হামজার মত শাহাদাতের পেয়ালা পান করব, অথবা ওদের দূর্গ জয় করব।’ এই বলে তিনি ও যুবায়য়ের (রা.) সামনে অগ্রসর হলেন। ইহুদিরা তখন ভয় পেয়ে দূর্গ থেকে বেরিয়ে এলো। তারা বলল, হে মুহাম্মদ! আমরা আত্মসমর্পণ করতে মনস্থির করেছি। তবে একটি শর্ত আছে। আমাদের ব্যাপারে ফয়সালা আপনি করবেন না। আমরা সা’দ ইবনে মু’আযের ফয়সালা অনুযায়ী আত্মসমর্পণ করছি। সাদ যেই ফয়সালা দিবেন আমরা সেটাই মেনে নিব। . . . (চলবে)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...