হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

প্রিয় দেশবাসীর উদ্দেশে আমার কিছু কথা

আবহমান বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এখানকার আপামর মানুষ দীর্ঘ শত-সহস্র বছর ধরে একত্রে বসবাস করে এসেছে। সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামল এই বাংলার মাটিতে তারা জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পাশাপাশি সহাবস্থান করেছে, একে অপরের সুখ-দুঃখ, হাসি-বেদনা, আচার-অনুষ্ঠানাদি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এখানকার হিন্দু-মুসলমান এক গাছের ছায়ায় ঘুমিয়েছে, এক গাছের ফল খেয়ে পুষ্ট হয়েছে। একতারা, দোতারার সুরে তারা সকলেই আপ্লুত হয়েছে। একসাথে দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবেলা করেছে, পান্তা-ইলিশ খেয়ে তৃপ্ত হয়েছে। এই সহাবস্থান, এই পারস্পরিক সম্প্রীতি আবহমান বাংলার সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ঐতিহ্যগতভাবেই তারা শান্তিপ্রিয়, অতিথিপরায়ণ। কিন্তু এই বাংলার মানুষকে বহু বিদেশি শক্তি দ্বারা পদদলিত হতে হয়েছে। বলা যায়, প্রাচুর্যে পূর্ণ এদেশের মানুষের অতিথিপরায়ণতার সুযোগ নিয়ে বহু জাতি বেনিয়ার বেশে এদেশে প্রবেশ করেছে এবং পরবর্তীতে প্রভুর আসনে আসীন হয়েছে। ফলে বারবার এই ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এদেশের ইতিহাস আমরা যতটুকু জানি, ১৫৭৬ সালে টাঙ্গাইলের পন্নী বা কররানি পরিবারের সুলতান দাউদ খান পন্নী জীবন দিয়েছিলেন বহিঃশক্তির হামলা থেকে এদেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে। মূলত দাউদ খান পন্নীর পরাজয় ও মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। পরবর্তীতে বাংলার শাসক হিসেবে যে নবাবদের নাম আমরা পাই বাস্তবে তারা কেউ স্বাধীন ছিলেন না। অবশেষে পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইংরেজরা এদেশের শাসনব্যবস্থায় প্রবেশ করে। দীর্ঘ দুইশ’ বছরের অবর্ণনীয় শোষণের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে তারা যখন উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে যায়, তখনো বাঙালির মুক্তি মেলেনি। সে ইতিহাস আমাদের সকলের জানা। এভাবে যখনই এ দেশের মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে, নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, বহিঃশক্তির শোষণের শিকার হয়েছে, তখনই বহু মনীষী, বিপ্লবী আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মানুষকে তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছে, বিক্ষুব্ধ হয়েছে, সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে। এমন হতে হতে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে বাংলার মাটি ও জনগণ মুক্তি পায়। সেই থেকে আজ অবধি আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৭১ সালে অর্জিত এই স্বাধীনতা এ দেশের মানুষের জন্য একটি বিরাট মাইলফলক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও একটা সহজ সত্য এই যে, শত শত বছর ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে থাকার কারণে নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, স্বাধীন জাতির মন-মানসিকা, নিজের ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বতন্ত্র পরিকল্পনা আমরা হারিয়ে ফেলি। সেই মন-মানসিক কিন্তু আজ পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ইংরেজরা যে পথ আমাদের দেখিয়ে গেছে আজ অবধি আমরা সেই পথেই হাটছি। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হয়েছে দেশটা কিভাবে চলবে তা নিয়ে মতভেদ। শাসন ব্যবস্থা কেমন হবে, এক দলীয় নাকি বহুদলীয় তা নিয়ে সংঘাত। সংস্কৃতিটা কেমন হবে? আরবীয় নাকি ভারতীয়? পরিচয়টা কী হবে? বাঙালি নাকি বাংলাদেশি? এ রকম বহু বিষয় নিয়ে মতভেদ চলে আসছে। রাজনৈতিক বিভক্তি, দলাদলি, স্বার্থ নিয়ে কামড়াকামড়ি, রক্তপাত, রাষ্ট্রনায়ক হত্যা, সেনাপ্রধান হত্যা, এসব করতে করতে আমরা এ পর্যন্ত এসেছি। বর্তমানে আমাদের অবস্থা অনেক মৃত্যু উপত্যকার কিনারে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। আমাদের বিভক্তি এবং পারস্পরিক ঘৃণা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। জাতি বৃহৎ কোনো সংকটে পড়লে তাকে মোকাবেলা করার কতটুকু সামর্থ্যও আমাদের আছে তা বিচারের ভার সাধারণ জনগণের উপরই ছেড়ে দিলাম। এরই মধ্যে কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী আমরা পার করে এসেছি। এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর আজকে আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছি।
আমাদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির পাশপাশি বিশ্ব পরিস্থিতির কথাও বিবেচনা করতে হবে। আজকের বিশ্বকে বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজ; অর্থাৎ পুরো পৃথিবীই একটি গ্রামের মতো। একটা গ্রামের কোথাও ডাকাত ঢুকলে যেমন মুহূর্তের মধ্যে এর খবর সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, এক চিৎকারে সারা গ্রামের মানুষ বেরিয়ে আসে, বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতিটাও অনেকটা এরকম। রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ বহুভাবে সারা পৃথিবী এখন কানেক্টেড, একে অপরের সাথে যুক্ত। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, জাতিতে জাতিতে অসংখ্য, চুক্তি, সন্ধি এবং সমঝোতা ইত্যাদি হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে যুক্ত হয়েছে। তো এখন যে পরিস্থিতি, বিশ্বের যে টাল-মাটাল অবস্থা তাতে বাংলাদেশও গভীরভাবে যুক্ত। জঙ্গিবাদ ইস্যুকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলছে। আফগানিস্তান মাটির সাথে মিশে গেল, সিরিয়া আজকে ২ পরাশক্তির যুদ্ধের রণক্ষেত্র, ইরাক গণকবর হলো, লিবিয়া ধ্বংস হলো। একের পর এক মুসলিম দেশকে টার্গেট করা হচ্ছে। এই হুমকি মোকাবেলায় মুসলিম দেশগুলোর মধ্যেও কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা নেই। বরং আমরা দেখে আসছি আরব দেশগুলোই একে অপরের মুখোমুখি। বর্তমানে তো একেবারে যুদ্ধংদেহী অবস্থান। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য ভয়ের বিষয় হলো, এখানেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ (শেষ জরিপ হিসেবে ৮৮%) মুসলিম। এখন এই ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ঈমানকে, ধর্মবিশ্বাসকে বহুভাবে বিভিন্নদিকে প্রবাহিত করে এ পর্যন্ত অনেক ঘটন অঘটন ঘটানো হয়েছে। কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থে আর কেউ রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করেছে। কেউ আবার ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করছেন। যে কারণে এখন অর্থনীতিবীদরা বলেন বাংলাদেশে ধর্মের নামে অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থা। ২০% ইকোনমি। অন্য দিকে চরমপন্থা অবলম্বনকারী গোষ্ঠীগুলোও ধর্মকে ব্যবহার করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা এমন সব ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি যেগুলো এক সময় আমরা সংবাদপত্রের আন্তর্জাতিক পাতায় পড়ে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু একই ধরনের ঘটনা এখন আমাদের এখানে ঘটছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখন এই ধর্মীয় ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে দুনিয়া যখন টাল-মাটাল তখন বাংলাদেশকেও কানেক্ট করে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব, বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বোভৌমত্ব সমস্ত কিছু ভয়াবহ হুমকির মুখে। এখন এটা নিয়ে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর জনগনকে ভাবতে হবে। জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করতে গিয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রগুলোও শুধুমাত্র শক্তি ব্যবহার করে ব্যর্থ হয়েছে। এখন সবাই বলছেন, একে মোকাবেলা করতে হলে অবশ্যই আদর্শ লাগবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকে, তারা যদি স্বার্থ নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত থাকে, জাতির অস্তিত্বের সংকটেও নির্বিকার স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন করে, তাহলে জঙ্গিবাদের মতো বৃহৎ সংকটকে মোকাবেলা করা কি আদৌ সম্ভব? সরকারগুলো শুধু শক্তির জোরে এই পর্যন্ত মোকাবেলা করে এসেছে। কিন্তু এভাবে কতদিন তারা চালিয়ে যেতে পারবে? ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। বৃটিশদের শিখিয়ে দিয়ে যাওয়া এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার গোড়াতেই রয়েছে এক দলের বিরুদ্ধে আরেকদলের ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার আর বিষোদগার, কর্মীদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ যাবতীয় বেআইনী কর্মকা-। এই রাজনৈতিক সিস্টেমে অর্থ আর পেশীশক্তিই সব কিছু, এখানে আদর্শের কোনো জায়গা নেই। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে যে যা পারছে করছে, কারো কাছে কোনো আদর্শ নেই। রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে মিলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে একদল ক্ষমতায় যাচ্ছে, পরের দিন থেকে অন্য দল বা জোটগুলো ক্ষমতাসীনদের গদি থেকে নামানোর জন্য জ্বালাও-পোড়াও হরতাল ভাঙচুর করছে। বলা হচ্ছে এগুলো করা তাদের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকার আবার জনগণের জান-মাল হেফাজতের কথা বলে, নিরাত্তার কথা বলে, স্থিতিশীলতার কথা বলে ভয়ানক দমন পীড়ন শুরু করে। এভাবে এই গণতন্ত্রের বলির পাঠা হচ্ছে দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ আর শত শত মানুষের জীবন। আর শত্রুতা, পারস্পরিক আস্থাহীনতা যে কি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে তাও বলার বাকি রাখে না। এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এক সময় ছিল রাজধানীভিত্তিক। এখন তা গ্রামের পাড়া, মহল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। দক্ষিণপাড়া উত্তরপাড়া এখন মুখোমুখি। সামান্য ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় ভয়ানক ঘটনা। একেকটা নির্বাচন মানে একেকটা লাশের সারি। দা, চাপাতি, বল্লম নিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর হামলা করে; কখনো বিরোধী দলের উপর, কখনো নিজ দলেরই প্রতিপক্ষের উপর। প্রত্যেক নির্বাচনের আগে সীমান্ত দিয়ে দেশে অস্ত্র প্রবেশ বেড়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই ‘গণতান্ত্রিক সন্ত্রাস’ দেশ ও জনগণের কি পরিমাণ জান-মাল নষ্ট করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
অর্ধ শতাব্দী হতে চললো আমরা এগুলো করে এসেছি। আর কত? আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে যেখানে সবচেয়ে জরুরি হলো কেন্দ্রীভূত হওয়া, ঐক্যবদ্ধ হওয়া, বিভেদের দেয়াল চুরমার করণ, সেখানে এই বিভাজনের রাজনীতি আমরা আর কতদিন জিঁইয়ে রাখব সেটাই বড় প্রশ্ন। এখানে বিশ্বপরাশক্তিগুলি ইতোমধ্যে দুনিয়া দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কোনো একটি ইস্যু পেলেই বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান ভূ-খ-গুলোতে হামলা চালানোর জন্য তারা মুখিয়ে আছে। পাশাপাশি আছে আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিগুলো। এমতাবস্থায় জাতিসত্ত্বা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সমস্ত বিভক্তির পথ বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এখানে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র বা ধর্মতন্ত্র বড় কথা নয়। তন্ত্র-মন্ত্রের প্রসঙ্গটা এখানে পরে। কি করলে সমাজের মানুষগুলো ঐক্য হবে, তাদের মধ্যকার বিভক্তি-হানাহানি দূর হবে সেই পথ খুঁজতে হবে। নিজেদের মধ্যে দলাদলি করে আমরা বিদেশি পরাশক্তিদের কাছে একে অন্যে বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে যাচ্ছি, তাদের কাছে সমাধান চাচ্ছি, তাদের কূটনীতিকদের নিয়ে মিটিং করে একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফর্দ তুলে ধরছি। তারা আমাদেরকে আমন্ত্রণ দেয়, সাহায্য দেয়, আবার এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে তাদের কাছে আমরা আশ্রয়ও পাই। কেন? নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরা করতে পারি না? আমাদের বুঝতে হবে, তারা যে রাজনীতি আমাদের শিখিয়েছে তা চিরদিন আমাদেরকে তাদের নতজানু করে রাখবে। আমরা দলাদলি করে বিভক্ত হয়ে থাকব, নিজেরা মারামারি করে শেষ হয়ে যাব, তারা মাঝেমধ্যে এসে শাসন করে যাবে, এভাবে চলতে থাকবে। আর কখনো কেউ তাদেরকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করতে না চাইলে তারা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ গড়তে মদদ দেবে, অস্ত্র, অর্থ সকরবরাহ করবে। প্রয়োজনে সেখানে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় ঠিক এটাই করা হয়েছে। আজকের সিরিয়া কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদেরও না, সিরিয়ার জনগণেরও না। সিরিয়ার মানুষ যদি বলে এদেশ আমাদের সেটা ভুল হবে। সিরিয়া এখন পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর। সিরিয়ায় কি ঘটবে, সিরিয়া আর কতদিন টিকে থাকবে, সিরিয়া একটা দেশ থাকবে নাকি ভেঙে টুকরো টুকরো হবে, সেখানে মানুষগুলো সুখে থাকবে নাকি তাদেরকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে, সামরিক গ্যরিসন বানানো হবে, এসবই কিন্তু পরাশক্তিগুলোর করুণার উপর নির্ভর করছে। দেশগুলো কিন্তু একেবারে আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তাদের দুর্বলতাগুলো আসলে কোথায় ছিল তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এই বিভাজনের নীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৃহৎ সংস্কার নিয়ে আসতে হবে। হীনম্মন্যতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের কৌশল নিজেদেরই ঠিক করতে হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, সারা বিশ্বকে শোষণ করে নিয়ে সম্পদের প্রাচুর্যের উপর বসে তারা যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দিয়ে চলছে তা দিয়ে আমরা চলতে পারি না। এভাবে চলতে থাকলে অনাদিকাল পর্যন্ত আমাদেরকে তাদের গোলামি করে যেতে হবে কিংবা কোনো এক সময় তাদের আগ্রাসনের শিকার হতে হবে।
আর দ্বিতীয় বৃহৎ সংস্কারটি করতে হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। এ পর্যন্ত আমাদের নিজস্ব কোনো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। সেই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই আমরা এখনো ধুঁকে ধুঁকে চলছি। এখানে শিক্ষাব্যস্থার মূল ধারা দু’টি- মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষা। জাতিটাকে একেবারে গোঁড়াতেই মনস্তাত্বিকভাবে দু’টি ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। একদিকে কিছু মানুষ মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামের সঠিক শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি আদর্শ নিয়ে বড় হচ্ছে, আরেকটি দিকে বাকিরা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষাহীন সম্পূর্ণ ভোগবাদী একটি আদর্শ নিয়ে বেড়ে উঠছে। সেখানে মাদরাসার মধ্যে আবার দুই ভাগ। একটা হলো শত শত বছরের প্রাচীন কওমী ধারা আর একটা হলো ব্রিটিশদের তৈরি করা আলিয়া। সাধারণ শিক্ষায়ও আবার দুই ভাগ- ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম। ইংলিশ মিডিয়ামের সমস্ত সিলেবাস, কারিকুলাম সব ইংরেজিতে। শেক্সপিয়ার, বায়রন, কীটসদের গল্প, উপন্যাস, কবিতা পড়ে তারা বড় হচ্ছে। মধ্যযুগের পরিপন্থিতে জন্ম নেওয়া রেনেঁসার ভিত্তিতে তারা যে সাহিত্য রচনা করে গেছেন তাদেরকে সেগুলো পড়ানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবচেতনভাবেই একটি মানসিকতা গড়ে উঠছে, আমাদের দেশের চিন্তা-চেতনা থেকে ব্রিটিশরা ভালো, ফ্রান্স ভালো, জার্মানি ভালো। পশ্চিমাদের প্রতি প্রচ- হীনম্মনতা সৃষ্টির কৌশল চালু করে রাখা হয়েছে। আবার রয়েছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আর পাবলিক ইউনিভার্সিটি। এখানে আবার চলে বিরাট শিক্ষাবাণিজ্য। এবটা বিশেষ শ্রেণি আবার শিক্ষিত হওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা দিয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। এভাবে শিক্ষব্যবস্থাকে বহুভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের সামনে উত্তম কোনো আদর্শ তুলে ধরা হচ্ছে না। এর শেষ ফলাফল হচ্ছে একটা গোষ্ঠী বের হয়ে আসছে চূড়ান্ত স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে, আরেকটি গোষ্ঠী বের হচ্ছে ধর্মকে বিক্রি করে রুটি-রুজি করতে। একদল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুরি মারামারি করছে, টেন্ডারবাজি নিয়ে খুনোখুনি করছে। আরেকদল ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে হুজুগে মাতিয়ে তুলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করছে, জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। তারা না শিখছে দেশপ্রেম, না পাচ্ছে ধর্মের সঠিক শিক্ষা, না শিখছে নীতি-নৈতিকতা কিংবা মানবতা। যে যত শিক্ষিত হয়ে যত বড় পদে যাচ্ছে সে দেশ ও জনগণের সম্পদ তত বেশি লুট করছে, খাবারে-ওষুধে বিশ মেশাচ্ছে। আত্মিক শিক্ষাহীন এই কথিত শিক্ষিত শ্রেণিটি জাতির সম্পদ গ্রাস করে নিজেদের সমৃদ্ধ করছে। এখানে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট হয়ে গেলে তা ঠিক করার ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, অথচ নিজে অসুস্থ হলে বিমান খরচ করে যাবে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে থেকে চিকিৎসা করিয়ে আসছে। অথচ ওই বিমানের ভাড়া দিয়ে ১০০টি অ্যাম্বুলেন্স কেনা যায়।
আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ব লড়াইয়ের সংগ্রামে আমাদের গোড়া থেকে ভাবতে হবে। কোথায় আমরা পথ হারিয়েছি সেটা আগে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, আমাদের বড় বড় মারণাস্ত্র নেই, আমরা পারমাণবিক শক্তির দাপটে কথা বলবো সেই সুযোগ নেই। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তাদের সাথে কম্পিটিশনে নামব সেই সামর্থও আমাদের নেই। আমাদের দেশের সব মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, সবাইকে শিক্ষিত করে তোলা, নিজস্ব অর্থায়নে একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ- এগুলোই এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে স্বপের মতো বিষয়। সুতরাং টাল-মাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখা এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই স্বতন্ত্র পরিকল্পনা থাকতে হবে। যে বিভাজনের নীতি দিয়ে দেশ এতদিন চলে আসছে তা পরিবর্তন করতেই হবে। বিকল্প পথ খুঁজতেই হবে। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, সেই বিকল্প, সেই সম্ভাবনা আমাদের কাছে আছে। একটি পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে, একটি সম্ভাবনাহীন জাতিকে বিশ্ব নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে শক্তিশালী আদর্শ প্রয়োজন সেটা হেযবুত তওহীদের কাছে রয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা তা মানুষের সামনে তুলে ধরছি।
এ দেশের সাধারণ জনতার উদ্দেশে কিছু কথা বলে লেখাটি শেষ করব। আজকের এই রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে জনগণ কি করবে? তারা প্রচলিত এই সিস্টেমে আর কতদিন পদদলিত হবে? কত আর জনগণ পয়সা খেয়ে মার্কার পিছনে দৌঁড়াবে, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ থাকবে? জনগণ আর কত মোল্লাকে টাকা দিয়ে জান্নাত কিনবে? জনগণ আর কতো বিদেশিদের দিকে হা করে চেয়ে থাকবে? জনগণ আর কতো বোমা খেয়ে মরবে? জনগণ আর কত হরতাল অবরোধের কবলে পড়ে জান-মাল হারাবে? চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হতে দেখেও নীরবে সহ্য করে যাবে? দেশি-বিদেশি না না ষড়যন্ত্র দেখেও আর কতদিন ভাগ্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেবে? এই অচলায়তন ভাঙার সময় কি এখনো হয় নি? এদেশের প্রতিটি মানুষকে জেগে উঠতে হবে, নতুন রেনেসাঁর জন্ম দিতে হবে। ধর্মের নামে যত অধর্ম আর রাজনীতির নামে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, এক ইস্পাতকঠিন দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। এই সাংঘাতিক নবজাগরণের প্রয়োজনে আত্মকেন্দ্রিকতা আর স্বার্থপরতার বেড়াজাল থেকে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি আমরা তা করতে পারি তবে নিশ্চিত করে বলব, আমাদের দেশ-মাটিও রক্ষা পাবে, আমাদের ধর্মও টিকবে, ইজ্জতও টিকবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও সুরক্ষিত হবে। আর যদি তা করতে না পারি তাহলেও আরেকটি কথা নিশ্চিত করে বরতে পারি, আজ হোক কাল হোক, আমাদেরকেও ইরাক-সিরিয়ার ভাগ্য বরণ করতে হবে। এই কথাটুকু বলার জন্য পীর ফকির হওয়ারও প্রয়োজন নেই, নবী-রসুল হওয়ারও প্রয়োজন নেই, এটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিণতি, আমাদের কর্মফল। এতো ধর্মান্ধতা, এত বিভক্তিকরণ, এত ধান্দাবাজি, দুর্নীতি, এত অপরাজনীতি, এত স্বার্থপরতা জিঁইয়ে রেখে কোনো জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে না। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে আমাদের ধ্বংস কেবল সময়ের ব্যাপার। আমাদের সেই শত বছরের সীমানা বেষ্টনির মধ্যে ধাঁই ধাঁই করে জনসংখ্যা বাড়ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার থাকা, খাওয়াই এখানে মহাচিন্তার বিষয়। এই বিরাট জনগোষ্ঠীর সামনে সামগ্রিক কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো আদর্শ নেই। এখানে তরুণ ক্রিকেট উন্মাদনায় অস্থির হয়ে থাকে, মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। রাষ্ট্র, দেশ, বিশ্ব কোন্ দিকে যাচ্ছে, তরুণ প্রজন্মকে কে কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। যে যেভাবে পারছে মরা গরুর মতো জাতিকে খুবলে খাচ্ছে। কেউ দিনের বেলায় খাচ্ছে, কেউ রাতের বেলায় খাচ্ছে। লাল পাসপোর্ট রেডি করে রাখছে, বিদেশে সেকেন্ড হোম বানিয়ে রাখছে। খাওয়া শেষে এখানে থাকা অনিরাপদ মনে করলে, সেকেন্ড হোমে চলে যাচ্ছে, রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমাদের কিন্তু সেকেন্ড হোমও নেই, লাল পাসপোর্টও নেই। লন্ডনে, নিউইয়র্কে, মস্কোতে গিয়ে আশ্রয় পাব সেই সুযোগও নেই। সুতরাং এই দেশকে কোনোভাবেই আমরা সিরিয়া-ইরাক হতে দিতে পারি না। আমাদেরকে বুক পেতে দিয়ে এ মাটিকে রক্ষা করতে হবে। যারা ঈমানদার তাদের উদ্দেশ্যে বলব, রসুল (স.) ও তাঁর সঙ্গীরা যেমন মদীনার মাটিকে রক্ষা করেছিলেন, আমাদেরকেও এই মাটিকে রক্ষার শপথ নিতে হবে। নয়তো আমাদের কোনো ধর্ম পরিচয়ও থাকবে না, জাতি পরিচয়ও থাকবে না। আমাদের সবার তখন একটাই পরিচয় হবে, উদ্বাস্তু।

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
-এমাম, হেযবুত তওহীদ

ফোন: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫,
০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...