হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

প্রতারকের খপ্পরে মানবজাতি (পর্ব: ০১)

আতাহার হোসাইন
‘আজাদি’ বা ‘স্বাধীনতা’ মানুষের এক পরম আরাধ্য বিষয়, মানবজাতির চির আকাক্সক্ষার বস্তু। যুগে যুগে মানুষ স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় লড়াই করেছে প্রতিকূল পরিবেশে, প্রবল প্রতাপান্বিত শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে, যদিও সে জানত তার শত্রুর সামনে সে সামান্য খড়কুটো মাত্র। শক্তির এই বিশাল ব্যবধান তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি শত্রুর মোকাবেলা করা থেকে। স্বাধীনতা মানব চরিত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা কখনোই মানব অস্তিত্ব থেকে আলাদা করা যায় না। পরম কাক্সিক্ষত সেই স্বাধীনতা লাভের জন্য যুগে যুগে যে সংগ্রাম চলেছে, এটাই মূলত মানবজাতির ইতিহাস। কোনো কোনো মহামানব পরাধীন কোনো জনসংখ্যাকে দেখিয়েছেন স্বাধীনতার পরম সুখ-স্বপ্ন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে বারংবার। আদায় করে নিয়েছে কাক্সিক্ষত সেই স্বাধীনতা। আবার পথ হারিয়ে মানুষ নেতাদের দ্বারা বিভ্রান্তও হয়েছে বারবার। স্বাধীনতা নামের সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে নিজেদের জড়িয়েছে সোনার শিকলে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে গোলামীর জালে।
আমাদের নিকট ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই বহুদিন যাবত ইউরোপে প্রচলিত রাজতন্ত্রে সামন্তবাদী রাজাদের স্বেচ্ছাচারিতা, অত্যাচার, শোষণ, খ্রিস্টধর্মের ব্যর্থতার ফলে রাজা ও পোপদের সংঘাতের ফলে সৃষ্ট সংঘাত, হানাহানি ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে, রাজাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটিয়ে, তাদের উৎখাত করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ধনতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র। কিন্তু এই ধর্মহীন, আত্মাহীন, পুঁজিবাদী, সুদভিত্তিক অর্থনীতি, জড়বাদী জীবন ব্যবস্থার ফলে সৃষ্টি হয় মানুষে মানুষে বিভেদ, অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাস। ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ লোক দুর্ভিক্ষে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকল, না খেয়ে মারা গেল, সর্বত্র শুধু ক্ষুধা আর হাহাকার; চুরি, ছিনতাই ইত্যাদি সামাজিক অপরাধে ছেয়ে গেল সর্বত্র। অপরদিকে গুটিকয়েক মানুষ কুক্ষিগত করে ফেলে সমস্ত সম্পদ। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে এই অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তৎকালীন চিন্তাবিদগণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। ব্যাপক চিন্তা-ভাবনার পর তারা আবিষ্কার করেন আরেক মতবাদ, সাম্যবাদ। “কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না” এই মোহময়ী শ্লোগানে সাম্যবাদের প্রবক্তারা মানুষকে দেখিয়েছিল স্বাধীনতার স্বর্গসুখের প্রলোভন। মুক্তিকামী সাধারণ জনতাও সেই ঘোষণায় প্রভাবিত হয়ে গ্রহণ করে নেয় সাম্যবাদ তথা কম্যুনিজমকে। সাম্যবাদের প্রবক্তারা তাদের এই শাসনব্যবস্থাকে ঘোষণা করে চধৎধফরংব বা স্বর্গ বলে। তারা বহুবার বহুভাবে আকারে ইঙ্গিতে, প্রকাশ্যে তাদের রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রে প্রচার করতে থাকে যে তাদের গৃহিত এই ব্যবস্থা স্বর্গসুখের সমান। কিন্তু যেই তারা এই জীবনব্যবস্থার ফল ভোগ করতে শুরু করল, তারা দেখতে পেল এ তো স্বাধীনতা নয়, স্বর্গসুখ নয়, বরং এ তো সামন্তবাদী রাজাদের শাসনের চেয়ে আরো নিকৃষ্ট, এ যেন কড়াই থেকে চুলোয় লাফ দেয়ার মত, নরক। ফলে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুকাল পরেই তাদের মোহভঙ্গ হলো। এই ব্যবস্থায় তাদের মতপ্রকাশের অধিকার থাকল না, স্বাধীনতা থাকল না। শাসনযন্ত্র প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এই শক্তি রাষ্ট্রের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতে লাগল। অবস্থা এ রকম দাঁড়াল কম্যুনিস্ট অধীন রাষ্ট্রগুলোর সরকার যা চায় শুধুমাত্র তার খবরই সীমানার বাইরে যেতে পারত। বড় বড় দুর্ঘটনার খবর ছাড়া আর কোন খবরই বাইরের পৃথিবীতে যেতে পারত না। ফলশ্রুতিতে বাইরের দুনিয়ায় সাম্যবাদের আওতাভুক্ত তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের নাম হয়ে গেল Iron curtain. আর এই ব্যবস্থা গ্রহণকারী চীনের নাম হয়ে গেল Bamboo curtain. সাধারণ জনগণ আরো দেখতে পেল এই ব্যবস্থায় ব্যক্তির সম্পদ অবৈধ ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্র তা দখল করে নেয়। মানুষ রাষ্ট্রের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পর দেখতে পেল এ থেকে তাদের কোনো রকম ভোগ করার হক নেই, মালিকানা নেই, অধিকার নেই। দীর্ঘ লাইন দিতে হয় শুধুমাত্র দু’ টুকরো রুটির জন্য। ব্যক্তিমালিকানাহীন এই ব্যবস্থা তাদের প্রচণ্ড রকমের হতাশ করে। সব মিলিয়ে এই স্বর্গভুমি (!) থেকে কিভাবে পালানো যায় তাই নিয়ে মানুষ ব্যস্ত হয়ে গেল, যদিও তা সহজ কথা নয়, কারণ কথিত স্বর্গে আবার বন্দুকধারী, মেশিনগানধারী প্রহরী ছিল। এই স্বর্গ থেকে বের হবার অর্থ নিজেদের দেশ, লক্ষ স্মৃতি বিজড়িত প্রিয় জন্মভূমি চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা দেশে, অচেনা সমাজে বাস করা, যাদের ভাষা পর্যন্ত তাদের অজানা। কিন্তু কথিত এ স্বর্গ এমনই স্বর্গ যে, সেখান থেকে সেখানকার অধিবাসীরা না পালিয়ে পারল না, পালাতে বাধ্য হল। কিন্তু তাদের গৃহীত জীবনব্যবস্থা তাদের এমনভাবেই শৃঙ্খলিত করল যে তারা সেখান থেকে পালানোরও কোনো পথ পেল না। মরিয়া হয়ে তবু তারা পালাতে লাগল, পালাতে গিয়ে তারা সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে নিহত হলো, তাদের হাতে বন্দী হলো, চিরতরে পঙ্গু হলো হাজারে হাজারে।
কম্যুনিস্ট পূর্ব বার্লিন থেকে পশ্চিম বার্লিনে পালিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে রাশিয়ানরা বিখ্যাত বা কুখ্যাত বার্লিন দেয়াল তৈরি করল। দেয়াল তৈরি করেও মানুষ পালানো বন্ধ করা যায় না দেখে দেয়ালের উপর প্রতি পঞ্চাশ গজ অন্তর অন্তর স্তম্ভ (Watch Tower) তৈরি করে সেখানে মেশিনগান বসানো হলো। হুকুম দেয়া হলো দেয়াল টপকে কাউকে পালিয়ে যেতে দেখলেই যেন গুলি করা হয়। তবু লোক পালানো বন্ধ হয় না দেখে পরিখা খনন করা হলো, দেয়ালে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হলো, নানা রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বসানো হলো পলায়নকারীদের খুঁজে বের করে হত্যা বা বন্দী করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই এই স্বর্গ থেকে পলায়ন বন্ধ করা গেল না। মানুষ মরিয়া হয়ে বিভিন্ন আত্মঘাতী পথ ধরল, যার বিবরণ পাওয়া যাবে গত শতাব্দীর কম্যিউনিজমকালের ইতিহাস ঘাটলে। এ কেমন স্বর্গ, যেখান থেকে মানুষ পালিয়ে যায়, জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্বর্গের দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়! এ ঘটনা শুধুমাত্র রাশিয়ার ক্ষেত্রেই ঘটেছে তাই নয়, ইহুদি-খ্রিস্টান বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতার উগ্রতম রূপ কম্যিউনিজমকে যারাই স্বাধীন-স্বর্গভূমি পাওয়ার নীতি বলে বিশ্বাস করে গ্রহণ করেছে তাদের প্রত্যেকেরই একই অবস্থা হয়েছে। পৃথিবীর অপরভাগ ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের হস্তক্ষেপে সোভিয়েট রাশিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে কম্যুনিজমের পালে বৈরী হাওয়া লাগে। তাদের এই আসন্ন পতনের ফলে মুক্তির ত্রাতা হয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়েছে পশ্চিমা সভ্যতার আধুনিক পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিশ্বাসে বুকভরা আশা নিয়ে মানুষ গ্রহণ করে নিল পশ্চিমা সভ্যতার আরেক ব্যবস্থা, গণতন্ত্রকে। পশ্চিমা সভ্যতা সারা বিশ্বে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বাকস্বাধীনতা, সমতা, অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবাধিকার ইত্যাদি বুলি আউড়িয়ে ফেরী করে বেড়াল গণতন্ত্রকে, আর মানবজাতি হুমড়ি খেয়ে গিললো তাদের এই বুলি। কিন্তু তাদের কী দিতে পেরেছে ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী পশ্চিমাদের গণতন্ত্র?

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...