হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী যেমন ছিলেন

কাজী মাহফুজ:

আজ মুসলিম দাবিদার জনসংখ্যাটির মধ্যে যারা নানা রকম সওয়াব উপার্জনে ব্যস্ত আছেন তারা মেহেরবানি করে নিজেদের আল্লাহর রসুলের হাতে গড়া উম্মাহ, জাতির সঙ্গে নিজেদেরকে একটু তুলনা করে দেখুন যে বিশ্বনবীর (সা.) হাতে গড়া জাতিটি এবং আজকের আমরা একই জাতি, একই উম্মাহ কিনা।  তারা দেখতে পাবেন এক তো নয়ই বরং সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দু’টো জাতি।  রসুলাল্লাহ (সা.) যে সর্বত্যাগী সংগ্রামী জাতি সৃষ্টি করেছিলেন তার ঠিক উল্টো যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা বর্তমানের আমরা (বর্তমানের মুসলিম জাতি)।  আমরা যে ‘সওয়াব’ কামাইয়ের কাজে অত্যন্ত ব্যস্ত আছি তা এবং প্রকৃত সওয়াব কী তা বিশ্বনবীর (সা.) একটি কাজ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।  যিনি ঐ সংগ্রামী জাতি সৃষ্টি করেছিলেন তার কাছে সওয়াব কী আর আমাদের কাছে সওয়াব কী তার তফাৎ দেখা যায় এই হাদিসটি থেকে।  আল্লাহর রসুল (সা.) একদিন একজন লোকের জানাজা পড়তে আসলেন।  যখন মৃত ব্যক্তিকে রাখা হলো তখন ওমর বিন খাত্তাব (রা.) বললেন, “ইয়া রসুলাল্লাহ! এর জানাজা পড়বেন না, এ লোকটি একজন ফাজের।” তখন মহানবী (সা.) সমবেত জনতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ এই লোককে ইসলামের কোনো কাজ করতে দেখেছ?” একজন লোক বললেন, “হ্যাঁ রসুলাল্লাহ! ইনি কোনো অভিযানে অর্ধেক রাত্রি প্রহরা দিয়েছেন।” এই শুনে রসুলাল্লাহ (সা.) ঐ লোকের জানাজায় নামাজ পড়ালেন এবং দাফন করার পর কবরের উপর মাটি ছিটালেন।  তারপর (মৃত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে) বললেন, “তোমার সঙ্গী-সাথীরা ভাবছে তুমি আগুনের সঙ্গী (জাহান্নামী)। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তুমি জান্নাতের অধিবাসী।  হে ওমর! নিশ্চয়ই তোমাকে মানুষের কাজ সম্বদ্ধে প্রশ্ন করা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন করা হবে অন্তর্নিহিত চরিত্র সম্বন্ধে (হাদিস- ইবনে আ’য়েয (রা.) থেকে- বায়হাকি, মেশকাত)”।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ওমর (রা.) মৃত লোকটি সম্বন্ধে যে শব্দটা ব্যবহার করলেন সেটা হলো ফাজের; যার আভিধানিক অর্থ হলো যার চলাফেরা-কাজকর্ম খারাপ, গুনাহগার, এক কথায় দুষ্কৃতকারী।  যেহেতু ওমরের (রা.) ঐ অভিমত কেউ আপত্তি করলেন না এবং তারপর বিশ্বনবী (সা.) যখন জিজ্ঞাসা করলেন যে ঐ লোকটিকে কেউ কোনো দিন ইসলামের কোনো কাজ করতে দেখেছে কিনা, তখন ঐ এক রাত্রি সামরিক ছাউনী পাহারা দেয়ার কাজ ছাড়া আর কেউ কিছু বলতে পারলেন না সেহেতু ঐ মৃত ব্যক্তি নিঃসন্দেহে অতি খারাপ, অতি গোনাহগার লোক ছিলেন। কিন্তু ঐ একটি কাজের জন্য আল্লাহর নবী (সা.) তার জানাজার নামাজ তো পড়ালেনই, তার উপর সকলের সামনে প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন যে ঐ দুষ্কৃতকারী পাপী জান্নাতবাসী।  আজ আমরা গোনাহ ও সওয়াবের যে হিসেব করি সে হিসাবে রসুলাল্লাহর (সা.) কাজ অবশ্যই বিপরীত। আসলেই বিপরীত।  বিশ্বনবীর (সা.) ও তাঁর আসহাবের (রা.) ইসলাম আর আজকের আমাদের ইসলাম এ দু’টো বিপরীতমুখী দীন। কারণ এই দু’টোর আকিদা বিপরীত।  একটি বহির্মুখী, সত্য প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামী; অন্যটি অন্তর্মুখী, সংগ্রামবিমুখ।  গোনাহগার দুশ্চরিত্র হওয়া সত্ত্বেও ঐ মৃত লোকটির একটি কাজ থেকে বোঝা গেল যে শেষ নবী (সা.) যে সংগ্রামী জাতি সৃষ্টি করেছিলেন সে তাতে বিশ্বাসী ছিল, তাতে অংশ নিয়েছিল এবং প্রহরা দেওয়ার মতো সামান্য কাজ হলেও তা করেছিল।  এই দীনের যে প্রকৃত, আসল কাজ তাতে সে যোগ দিয়েছিল।  কাজেই সে কত সওয়াব কামিয়েছে তার কোনো হিসাব দরকার নেই, সে কত গোনাহ করেছে সে হিসাবেরও দরকার নেই, আল্লাহ তাকে জান্নাতে দেবেন।  আল্লাহর রসুলের (সা.) ঐ কাজ প্রমাণ করে সত্য, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই ঈমানের পর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য।
বিশ্বনবীর ও তাঁর উম্মাহর উপর আল্লাহ যে কর্তব্য ও দায়িত্ব অর্পণ করলেন সেই দায়িত্ব অর্থাৎ পৃথিবী থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, যুলুম নির্মূল করে সত্য, ন্যায় ও শন্তি প্রতিষ্ঠা এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে যে চরিত্রের প্রয়োজন বিশ্বনবীকে অবশ্যই সেই চরিত্রের মানুষ ও জাতি গঠন করার চেষ্টা করতে হয়েছে। এবং ইতিহাস সাক্ষী তিনি এমন সফল হয়েছিলেন যেমন সফল মানব জাতির মধ্যে কেউ হতে পারে নি। তিনি যে চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন সেটা কী চরিত্র? সাধু সন্ন্যাসী? ফকির-দরবেশ? কবি সাহিত্যিক? ফকীহ মোফাসসীর? এর জবাব আমরা পাই তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে। তার অতি আদরের অতি মোহাব্বতের মেয়ে ফাতেমাকে (রা.) বিয়ে দিলেন তার সাহাবা আলীর (রা.) সঙ্গে।  একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মহানবী তার উম্মাহর যে চরিত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন আলীর (রা.) মধ্যে সে চরিত্র পরিপূর্ণভাবে বিকাশ হয়েছিল, তা না হলে আল্লাহর রসুল জান্নাতের রানীকে তার হাতে তুলে দিতেন না। এখন দেখা যাক কী ছিল সেই চরিত্র।  বিয়ে ঠিক হবার পর বিশ্বনবী আলীকে (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন তার কাছে কী আছে? বিয়েতে কিছু খরচ হবে তো।  আলী (রা.) জবাব দিলেন টাকা পয়সা কিছুই নেই। থাকার মধ্যে তার কাছে আছে শুধু একটি ঘোড়া, একটি তলোয়ার আর একটি লোহার বর্ম। লক্ষ্য করুন একটি মানুষের পার্থিব সম্পদ বলতে আছে একটি ঘোড়া, একটি তরবারি আর বর্ম। তিনটিই যুদ্ধের উপকরণ এবং ওগুলি ছাড়া তার আর কিছুই নেই।  অর্থাৎ এক কথায় আলীর (রা.) জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও বোধহয় একমাত্র লক্ষ্য হলো সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।  এই মনোভাব, আকিদা শুধু আলীর (রা.) ছিল না, প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর প্রত্যেকেরই তাই ছিল। আলীর (রা.) বিয়ের বহু পরে এই প্রকৃত উম্মতে মোহম্মদী যখন তাদের উপর আল্লাহর ও রসুলের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে করতে সুদূর মিসরে যেয়ে পৌঁছেছিল তখনও তাদের একজন উবায়দা (রা.) খ্রিস্টান শাসনকর্তাকে বলেছিলেন- আমরা (উম্মতে মোহাম্মদী) বেঁচেই আছি শুধু সংগ্রাম করার জন্য।  এ দুনিয়াতে শুধু বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া আর গায়ে পরার কাপড় ছাড়া আমরা আর কিছুই চাই না।  আমাদের জন্য ঐ দুনিয়া (পরকাল)।  এই হলো প্রকৃত মুমিন, মুসলিম আর উম্মতে মোহাম্মদীর সঠিক আকিদা।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...