হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

পাঠকের প্রশ্ন-আমাদের জবাব: “আপনাদের সাড়ে তিন হাত শরীরেই তো ইসলাম নাই”

share-tin-hatহেযবুত তওহীদের মতাদর্শ অর্থাৎ প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে লেখা এই পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হোচ্ছে। আমাদের এই লেখাগুলি পড়ে অনেক পাঠক টেলিফোনে যোগাযোগ কোরছেন এবং তাদের মনে কোন প্রশ্ন আসলে সেগুলির জবাব জানতে চাইছেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, পাঠকদের থেকে আগত এই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব আমরা ধীরে ধীরে পত্রিকার পাতায় প্রকাশ কোরব। এতে কোরে আরও অনেকেই হয়তো উপকৃত হবেন। যেহেতু আমাদের বিষয়বস্তু ইসলাম, তাই এই প্রশ্নকর্তাদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ আছেন যারা মাদ্রাসা শিক্ষিত। তাদের প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি অতি উচ্চারিত প্রশ্ন হল, “আপনারা ইসলামের কথা বলেন, কিন্তু যারা হেযবুত তওহীদ আন্দোলন করে তাদের সাড়ে তিন হাত শরীরেই তো ইসলাম নাই?” এ প্রশ্নটি পরিষ্কার হওয়ার জন্য আমরা প্রশ্নকর্তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম “শরীরে ইসলাম নাই” বলতে আপনি কি বুঝাতে চেয়েছেন? উত্তরে তিনি বোলেছিলেন, ‘হেযবুত তওহীদের অনেককেই আমি চিনি, তাদের অনেকের মুখে দাড়ি নাই, মাথায় টুপি নাই, পাগড়ী নাই, গায়ে জুব্বা নাই ইত্যাদি। আগে তো নিজেদের শরীরে ইসলাম কায়েম কোরতে হবে, তারপরে দুনিয়াতে কায়েম করার প্রশ্ন’।
এ প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই আমি বোলব, ইসলাম আসলে কি এবং কেন, তা আগে আমাদের বুঝতে হবে। যদি এই প্রশ্ন দুটির উত্তর আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়, তাহোলে আশা করি আমরা বুঝতে পারব আসলে দাড়ি, টুপি, পাগড়ীর সাথে ইসলামের সম্পর্ক কতটুকু।
ইসলাম একটি আরবি শব্দ। ইসলাম শব্দটির উৎপত্তি সীন-লাম-মীম বা ‘সাল্ম’ ধাতু থেকে। এই একই ধাতু ‘সাল্ম’ থেকে এসেছে সালাম, তাসলীম, সেলিম ইত্যাদি শব্দাবলী। ইসলাম শব্দের অর্থ আপত্তিহীনভাবে কর্তার আদেশ নিষেধের আনুগত্য করা (ইসলামিক ফাইন্ডেশন থেকে প্রকাশিত আরবী-বাংলা অভিধান: ১ম খণ্ড, পৃ:১৯৭)। একইভাবে সালাম শব্দের অর্থ হোচ্ছে: ইসলাম, সন্ধি, শান্তি, যুদ্ধের বিপরীত, আত্মসমর্পণ, শান্তিপ্রিয় ইত্যাদি (ইসলামিক ফাইন্ডেশন থেকে প্রকাশিত আরবি-বাংলা অভিধান: ২য় খণ্ড, পৃ:৭২)। সালাম শব্দের অর্থ শান্তি। এই ইসালাম শব্দ থেকেই এসেছে ইসলাম। অর্থাৎ শান্তি ও ইসলাম সমার্থক শব্দ। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম একটি জীবন-ব্যবস্থার নাম। এ নামটি দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। সমস্ত রকম অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, মারামারি, রক্তপাত থেকে মানবজাতির মুক্তির জন্য, মানুষ যেন শান্তিতে থাকতে পারে সেজন্য তাঁর সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (দ:)-এর মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতির জন্য আল্লাহ যে জীবন-ব্যবস্থা পাঠালেন তার নাম তিনি নিজেই রেখেছেন ইসলাম। এক কথায় ইসলাম আল্লাহর দেওয়া একটি জীবন-ব্যবস্থা। আল্লাহর দেওয়া এই জীবন-ব্যবস্থা যদি মানুষ তার পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচার-ব্যবস্থায় অর্থাৎ তার সামগ্রিক জীবনে মেনে নেয় এবং এই জীবন-ব্যবস্থা দিয়ে তাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করে তাহোলে তাদের জীবন থেকে সমস্ত রকম অন্যায়, অবিচার, রক্তপাত দূর হয়ে যাবে, ফলশ্র“তিতে সমাজে, রাষ্ট্রে তথা সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি আসবে।
ইসলাম বা শান্তি হোচ্ছে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রয়োগের ফল। অর্থাৎ এই জীবনব্যবস্থা কার্যকরী করা হোলে মানবজীবন থেকে অন্যায় অবিচার বিলুপ্ত হোয়ে যে নিরাপত্তা, সুবিচার, ন্যায় ইত্যাদি অর্থাৎ এক কথায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে- এই শান্তিটাই হোচ্ছে ইসলাম। এই দীনের প্রকৃত নাম দীনুল হক অর্থাৎ সত্য ও ন্যায় জীবনব্যবস্থা। ১৪০০ বছর আগে অর্ধেক পৃথিবীতে এই দীন প্রবর্ত্তন করার ফলে ঐ সমস্ত এলাকায় মানবজীবনের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত, অর্র্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সকল প্রকার শোষণ, অবিচার, অন্যায়, নিরাপত্তাহীনতা দূরীভূত হোয়ে প্রতিষ্ঠিত হোয়েছিল চুড়ান্ত শান্তি, নিরাপত্তা ও সুবিচার। এই জন্য এই দীনের নাম ইসলাম।
এই হলো ইসলাম শব্দের শাব্দিক ও প্রায়োগিক অর্থ, ইসলামের সঠিক আকিদা বা ধারণা। এই ধারণা মোতাবেক আসলে ইসলামের সাথে দাড়ি, টুপি, পাগড়ী, জুব্বার সম্পর্ক কোথায়? ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা অর্থাৎ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই ইসলাম নামক জীবন-ব্যবস্থার এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সুতরাং যারা আমাদের শরীরে ইসলাম নাই এই প্রশ্ন করেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন জীবন-ব্যবস্থার এগুলোকে কিভাবে শরীরে রাখা যায়? তাছাড়াও একটি দেশের সব মানুষ যদি দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জোব্বা গায়ে দেয় কিন্তু তাদের অর্থনীতি যদি সুদভিত্তিক হয়, বিচারব্যবস্থা ইসলামের না হোয়ে ইহুদি খ্রিস্টানদের তৈরি আইন দ্বারা হয় তাহোলে কি সেই দেশে শান্তি এসে যাবে? সাধারণ জ্ঞান কি বলে?
অনেকের ধারণা এই যে, দাড়ি ছাড়া ইসলামই হয় না, সেই দাড়ি তো আল্লাহর রসুলের বিরোধীতাকারী, ঘৃণিত কাফের আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়েবার মুখেও ছিল। তারাও জুব্বা পরতো, রসুল (দ:) যে জুব্বা পরতেন ঠিক একই ধরনের জুব্বা। প্রকৃতপক্ষে দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, জুব্বার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই, প্রকৃতির আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থার সাথে এগুলোর সম্পর্ক রোয়েছে। টুপি তো ইহুদিরা, শিখরা বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুরাও পরেন, তাদেরও দাড়ি আছে, তারাও জুব্বা পরেন, তাদের অনেকেই পাগড়ী পরেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাড়ি, টুপি, জোব্বা সবই ছিলো। শুধু ধর্মীয় সাধু সন্ন্যাসী নয়, আল্লাহর অস্তিত্বে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচিত অনেকেরই দাড়ি ছিলো যেমন কার্ল মার্কস, চার্লস ডারউইন, আব্রাহাম লিঙ্কন প্রমুখ। হয়তো বোলতে পারেন তাদের টুপি, জুব্বা, পাগড়ী, দাড়ি আর মোসলেমদের টুপি, জুব্বা, পাগড়ী, দাড়ি তো এক না। হ্যাঁ, তা হয়তো ঠিক, কিন্তু টুপির আকার-আকৃতি ও রং নিয়ে, জুব্বার আকার-আকৃতি নিয়ে, পাগড়ীর রং, দাড়ির পরিমাণ ইত্যাদি নিয়ে তো প্রচলিত ইসলামের আলেম ওলামাদের মধ্যেও বিস্তর মতোভেদ রোয়েছে। কার দাড়ি, কার টুপি, কার জুব্বা, কার পাগড়ী যে ইসলামের আর কারটা ইসলামের না- এ নিয়ে বিরোধ রীতিমত ব্যাপক আকার ধারণ কোরেছে। সুতরাং ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধে গিয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকে আমরা বিচ্যুত হোয়ে যাওয়া একপ্রকার মূর্খতা বোলে আমরা মনে কোরি। গত কয়েক শতাব্দী ধোরে এই জাতির দুর্ভাগ্যজনক পরাজয়ের কারণ এগুলিই। অথচ এটা ইতিহাস যে রসুলের একদল সর্বত্যাগী সাহাবী যাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হোত, তারা বাড়ী-ঘরে যেতেন না, মসজিদে নববীতে থাকতেন আর অপেক্ষা কোরতেন রসুল (দ:) কখন কি হুকুম দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সে হুকুম বাস্তবায়ন কোরতেন, সেই সাহাবীদের অনেকেরই গায়ে জুব্বা তো দূরের কথা ঠিকমত লজ্জাস্থান ঢাকার মতো কাপড় সংস্থান কোরতেও কষ্ট হোত।
আল্লাহ দিলেন সহজ সরল পথ, সেরাতুল মোস্তাকীম ইসলাম। আদম (আ:) থেকে শুরু কোরে শেষ নবী মোহাম্মদ (দ:) পর্যন্ত— ইসলামের অর্থাৎ দীনুল কাইয়্যেমার মর্মবাণী তওহীদ- এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো তৈরি জীবন-বিধান মানি না, স্বীকার করি না। এই সেরাতুল মোস্তাকীম, সহজ-সরল পথ ছেড়ে মহাপণ্ডিতরা দীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ কোরে এই কোরলেন যে, সহজ-সরল পথটি হোয়ে গেলো একটি অত্যন্ত দুর্বোধ্য জীবন-ব্যবস্থা, খুঁটিনাটি মসলা-মাসায়েলের জটিল জাল। এই জটিল জালে আটকা পড়ে সমস্ত জাতিটাই মাকড়সার জালে আটকা পড়া মাছির মতো অসহায়, স্থবির হোয়ে গেলো। ঐ স্থবিরতার অবশ্যম্ভাবী ফল হোয়েছে শত্র“র ঘৃণিত গোলামি ও বর্তমান অবস্থা; যেখানে অজ্ঞানতায়, অশিক্ষায়, কুশিক্ষায় ইসলামের আগের জাহেলিয়াতের অবস্থাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই জাতির ধর্ম ব্যবসায়ী আলেম সমাজ আজ কুয়োর ব্যাঙ। দুনিয়ার খবর যারা রাখেন তাদের চোখে এরা অবজ্ঞার পাত্র, হাসির খোরাক। আসমানের মতো বিরাট উদাত্ত দীনকে এরা তাদের লম্বা কোর্ত্তার পকেটে পুরে মিলাদ পড়ে, বাড়ী বাড়ী দাওয়াত খেয়ে আর সুর কোরে ওয়াজ কোরে বেড়ান। তবু যদি তাদের ওয়াজের মধ্যে অন্তত কিছু সার কথা থাকতো! তাও নেই, কারণ দীনের মর্মকথা, এর উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া এ সবের কিছুই তাদের জানা নেই। আসল দিক অর্থাৎ জাতীয় জীবনের দিকটাকে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তি দিকটার সামান্য যে বাহ্যিক অংশকে এরা আঁকড়ে ধোরে আছেন তা পর্যন্ত— ভুল। যে দাড়ি রাখাকে এরা দীনের অতি প্রয়োজনীয় কর্তব্য বোলে মনে করেন, প্রতি ওয়াজে প্রতি উপদেশে যারা দাড়ির প্রয়োজনীয়তার উপর অনেক সময় নষ্ট করেন সেই দাড়িকেই ধরুন। এদের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই দাড়িকে তার নিজের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছেন, যেটা বাড়তে বাড়তে সারা বুক ছেয়ে যায়। এই দাড়ি এই দীনের দাড়ি নয়। এ দাড়ি ইহুদিদের দাড়ি এবং এ রকম দাড়ি রাখা যে মহনবীর (দ:) নিষেধ তা তারা জানেন না। তাঁর (দ:) নির্দেশিত দাড়ি নিচের ঠোঁটের নিচ থেকে, অর্থাৎ যেখান থেকে দাড়ি গজায় সেখান থেকে একমুষ্ঠি মাত্র, এর বেশি হোলেই তা ছেটে ফেলার নিয়ম। ফকীহদেরও অধিকাংশের মতো হোচ্ছে চার আঙ্গুল লম্বা দাড়ি হোচ্ছে শরাহ অনুযায়ী। ইহুদিদের রাব্বাইরা লম্বা আলখেল্লা পরেন ও মাথায় লম্বা টুপি লাগান, লম্বা দাড়ি তো প্রত্যেকেরই আছে। কাজেই একদল রাব্বাইদের মধ্যে আমাদের একদল ‘ধর্মীয়’ নেতাদের দাঁড় করিয়ে দিলে তাদের আলাদা কোরে চেনা যাবে না। এই উড়ন্ত দাঁড়ির সঙ্গে তারা যোগ করেন ন্যাড়া মাথা। তারা বলেন, আল্লাহর রসুলকে (দ:) মাথা ন্যাড়া অবস্থায় দেখা গেছে বোলে হাদিসে আছে, কাজেই ন্যাড়া করাও সুন্নাহ। এ ধারণাও ভুল। মহানবী (দ:) সব সময়ই লম্বা চুল অর্থাৎ আমরা যাকে বাবরী বলি তাই রাখতেন এবং তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোকে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যে দেখেছেন স্বভাবতঃই। আম্মা আয়েশা (রা:) বর্ণনা কোরেছেন, “পবিত্র কানের নিচ থেকে কাঁধ পর্যন্ত—” অর্থাৎ সময়ে লম্বা হোয়ে পবিত্র কাঁধ পর্যন্ত— এসেছে এবং তখন ছেটে ফেললে আবার কানের নিচ পর্যন্ত— ছোট হোয়েছে। যারা তাঁকে মাথা কামানো অবস্থায় দেখেছেন, তারা দেখেছেন হজ্বের সময়- যখন সবাইকে মাথার চুল কামিয়ে ফেলতে হয় হজ্বের আরকান হিসাবে। যেহেতু হজ্বের সময়ই একত্রে বহু সংখ্যক লোক তাঁকে মাথা কামানো অবস্থায় দেখেছেন এবং পরে বর্ণনা কোরেছেন যে, “আমি রসুলাল্লাহকে (দ:) মাথা কামানো অবস্থায় দেখেছি,” তাই তার মাথা কামানো অবস্থার কথা হাদিসে এবং সীরাতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু এটা তার স্বাভাবিক অবস্থায় সুন্নাহ নয়, হজ্বে তো সবাইকে মাথা কামাতে হবে। কিন্তু ঐ বর্ণনাগুলিকে ভিত্তি কোরে এরা একদিকে মাথা কামিয়ে, অন্যদিকে হাওয়ায় উড়ন্ত বিশাল ইহুদি দাড়ি রেখে এক ভয়াবহ চেহারা সৃষ্টি করেন। (চোলবে…)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...