হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

পশ্চিমা ষড়যন্ত্র ও জাতির অনৈক্য

ওবায়দুল হক বাদল

বাঙালি জাতি সম্পর্কে কবি সুকান্ত ভট্টচার্য লিখেছিলেন-
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়!

কিন্তু সে বাঙালি বোধহয় অন্য জাতি ছিল, আজকের এই জাতি নয়। আজকের বাঙালির মধ্যে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার হওয়ার সে স্পৃহা অনুপস্থিত। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি স্বাধীনতা হলেও এরা স্বাধীনতা, স্বকীয়তা বা স্বতন্ত্রতা পছন্দ করে না। এ জাতি সর্বদাই প্রভু খোঁজে। দাসত্বের শৃঙ্খল নিজেদের শরীরে নিজেরাই বেঁধে রাখে। এর একটি কারণ যেমন অজ্ঞতা, তেমন আরেকটি কারণ হলো হীনম্মন্যতা। এটা আমার ব্যক্তিমত নয়, বাস্তবতা। যে কারও চোখের সামনে থেকে আবেগ ও হীনম্মন্যতার পর্দা সরালেই এ দৃশ্য চোখে পড়বে। সে দেখবে এ জাতির অধঃপতনের খাদ কত গভীরে প্রোথিত, জাতি ধ্বংসের পথে কতদূর এগিয়ে গেছে। আমরা বুঝছিনা, কারণ আমরা চোখের সামনে থেকে এই হীনম্মন্যতা ও অজ্ঞতার পর্দা সরাতে পারি নি। বরং পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র যেখানেই যাই সেখানেই এ পর্দার আস্তরণ আরও পুরু হতে থাকে। ফলে বিশাল দেহের হস্তি যেমন শত চেষ্টা করলেও তার নিজের আপাদমস্তক অঙ্গসমূহ অবলোকনে ব্যর্থ হয়, আমরাও আমাদের এ বৃহৎ দুর্বলতা অনুভবে সফল হই না। কিন্তু তাই বলে আমাদের অধঃপতন থেমে নেই।
পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে আমরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি। এমন অবস্থা অতীতে কখনোই হয় নি। আমরা বাঙালিরা আমাদের গৌরবকে হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। তবে সেটা হঠাৎ করে নয়। একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে পড়ে ক্রমে ক্রমে আমরা নিজেদেরকে নিঃস্ব করেছি। প্রথমে স্বাধীনতা হারিয়েছি, তারপর স্বকীয়তা হারিয়েছি, একই সাথে নিজেদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছি, সর্বশেষে নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের পদতলে সমর্পণ করে চরিত্র হারিয়েছি। এ সবকিছুই হয়েছে দখলদার শক্তির ষড়যন্ত্র আর আমাদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে। এখন এ জাতি নিঃস্ব, প্রাণহীন। কিন্তু যখন আমাদের প্রাণ ছিল আমরা এতটাই দুর্দান্ত ছিলাম যে, আমাদের দিকে বহির্বিশ্ব ঈর্শার দৃষ্টি ফেলে রাখত, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও উর্বর মাটি তাদের বিমোহিত করত। তারা অবাক নয়নে আমাদের স্বর্গভূমির পানে চেয়ে থাকত।
মুঘলদের পর ভারতবর্ষে আসলো পরদেশলোভী সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা। তারা আসলো আমাদেরই কৃত ষড়যন্ত্রের মই বেয়ে। ব্রিটিশদের আমলে শুরু হলো এ উপমহাদেশের জাতিগোষ্ঠীগুলোর আক্ষরিক অর্থেই গোলামির জীবনযাপন। অস্ত গেল এতদঞ্চলের স্বাধীনতা, স্বকীয়তার সূর্য। এভাবে চলল দীর্ঘ আড়াই শতাব্দী। আর এ দীর্ঘ সময়ে ব্রিটিশরা আমাদেরকে শাসন ও শোষণ করে এখানকার মাটির ধন-সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করে নিজেদেরকে সম্ভ্রান্ত করল, আর আমাদেরকে নিঃস্ব বানিয়ে দিল। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে কৌশলে আমাদের মধ্যে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হলো। ভারতীয়দেরকে হাতে কলমে শেখানো হলো গণতন্ত্র নামক একটি কামড়া-কামড়ির সিস্টেম। ব্রিটিশ প্রশাসকের ছত্রছায়াতেই তৈরি করা হলো রাজনৈতিক দল। কীভাবে সে দল পরিচালিত হবে, তাও নিজেরা নেতৃত্ব দিয়ে শিখিয়ে দিল। তারপর যা হবার তা এমনি এমনিই হয়ে গেল। ব্রিটিশদের শেখানো গণতন্ত্রই বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র শাসনব্যবস্থা যেটি অনৈক্য আর দলাদলিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহও যোগায়। আর সে উৎসাহে সাড়া দিয়ে আমরা জাতির সর্বনাশ ডেকে এনেছি। গণতান্ত্রিক দলাদলির নগ্ন খেলার বীভৎস রূপ আমাদেরকে প্রতিনিয়তই দেখতে হয়। এ খেলায় আমরা এক ভাই আরেক ভাইয়ের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করি।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,

‘ধর্ম বর্ণ জাতির ঊর্ধ্বে জাগো রে নবীন প্রাণ
তোমার অভ্যুদয়ে হোক সব বিরোধের অবসান’

বস্তুবাদী সভ্যতার হস্তগত সমস্ত পৃথিবীই এখন কার্যত মৃত বেশ ধারণ করে আছে। এ মৃত পৃথিবীকেও জাগাতে হবে। সমস্ত জাতি ধর্ম বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে মানুষ হিসেবে একজাতি হিসাবে গোড়ে তুলতে হবে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...