হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

পবিত্র কোর’আন জঙ্গিবাদের উৎস নয়

রিয়াদুল হাসান
ইসলামবিদ্বেষীরা অনেকেই অভিযোগ করে থাকে যে, পবিত্র কোর’আন থেকেই জঙ্গিবাদের উৎপত্তি হয়েছে। পবিত্র কোর’আনে জেহাদের কথা বলা হয়েছে। এর কারণেই জঙ্গিবাদী মতবাদ উৎসাহিত হচ্ছে। বস্তুত ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বা প্রোপাগান্ডার যে কতগুলো পয়েন্ট আছে তার মধ্যে এটি একটি। ইসলামবিদ্বেষীরা দুনিয়াময় এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য মরিয়া যে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ইত্যাদি মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোর’আন থেকে উৎসারিত হয়েছে। তারা নবী করিম (সা.)-কে পররাজ্য-পরসম্পদ জবরদখলকারী, কাফেলা লুণ্ঠনকারী ইত্যাদি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে (নাউযুবিল্লাহ)। এসব অভিযোগের প্রমাণ হিসাবে তারা যে ঘটনাগুলোকে সামনে আনেন সেগুলো হচ্ছে বনি কুরায়েজার ইহুদিদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান, কোরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলায় হামলা, প্রতিপক্ষ গোত্রের উপর গভীর রাতে অতর্কিত হামলা চালানো ইত্যাদি। তাদের কথা, এসব কাজ যিনি করেন তিনি রাজনৈতিক বা সামরিক ব্যক্তিত্ব হতে পারেন, কিন্তু মহামানব, নবী-রসুল কখনোই নয়। তারা বলে থাকেন, মোহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র একটি রক্তপিপাসু জাতি সৃষ্টি করেছেন যারা তাঁর মৃত্যুর পর পররাজ্য লুণ্ঠন শুরু করেছে। এ শিক্ষা তারা কোর’আন থেকেই পেয়েছে। এ কারণে যারা কোর’আন পড়বে, যারা হাদিস পড়বে বা মোহাম্মদের (সা.) অনুসারী হবে তারা জঙ্গি হবে, তারা সন্ত্রাসী হবে। আজ হয়নি তো কালকে হবে, কারণ ইসলামের গোড়ার মধ্যেই সমস্যা রয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

পূর্ণাঙ্গ চিত্র ও খণ্ডিত চিত্র:
এ বিষয়ের ব্যাপারে আমাদের জবাব হচ্ছে ইসলামে আকিদা নামে একটি কথা আছে। আকিদা হলো Comprehensive concept বা সম্যক ধারণা। একটি হাতির লেজ থেকে শুঁড় পর্যন্ত যদি আপনি সমগ্র হাতিটি একদৃষ্টিতে দেখেন তবে আপনি হাতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারবেন। তখন আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এটি কী? আপনি বলতে পারবেন, এটি একটি বড় পশু হাতি। এই হচ্ছে হাতির শুঁড়, এই হচ্ছে হাতির লেজ, এই হচ্ছে হাতির কান, এই হচ্ছে হাতির পা, সমগ্রটা মিলিয়ে একটা পশু, হাতি, একটি বিরাট তৃণভোজী ভারবাহী পশু। আর যদি আপনি সম্পূর্ণ হাতিটাকে না দেখেন তাহলে ঐ পাঁচ অন্ধের দশা হবে। পাঁচজন অন্ধলোককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল হাতি দেখতে কেমন? যিনি লেজ ধরেছেন, তিনি বলেছেন হাতি হচ্ছে চাবুকের মতো, যিনি কান ধরেছেন তিনি বলেছেন হাতি হচ্ছে কুলার মতো, যিনি শুঁড় ধরেছেন তিনি বলছেন হাতি হচ্ছে অজগরের মতো। এই যে, একেকজন একেকরকম মত প্রকাশ করলো কারণ তারা শুঁড় থেকে লেজ পর্যন্ত সমগ্র হাতিটাকে এক দৃষ্টিতে দেখতে পান নি তাদের অন্ধত্বের কারণে। এটাই হচ্ছে একটি বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে আকিদা বা সম্যক ধারণা। এই আকিদা ভুল হলে ঈমান ভুল হবে আর ঈমান ভুল হলে আমল ভুল হবে। নবী করিম (সা.) সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তিনি কী করতে চেয়েছেন, তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য কী, লক্ষ্য কী তা জানতে হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হলে, তাঁর জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ সমগ্র জীবনটাকে এক দৃষ্টিতে দেখতে হবে, খণ্ডিত নানা ঘটনাকে তুলে এনে উদাহরণ দাঁড় করালে হবে না। প্রত্যেকটি ঘটনার প্রেক্ষাপট থাকে, স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা থাকে। একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য, তাদেরকে পর্যুদস্ত করার জন্য কোথাও কোথাও স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এদেশের ব্রিজ-কালভার্ট পর্যন্ত বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন সময় পরিবর্তিত হয়েছে। এখন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুসরণ করতে গিয়ে নিজ দেশের ব্রিজ কালভার্ট বোমা মেরে উড়িয়ে দিবেন, আর বলবেন যে মুক্তিযোদ্ধারা করেছেন আমরা করলে দোষ কী – তাদেরকে কি দেশপ্রেমিক হিসাবে বিবেচিত হবে- নাকি সন্ত্রাসী হিসাবে? প্রশংসিত হবে নাকি শাস্তির আওতায় আসবে? নিশ্চয়ই ঘৃণিত হবে, সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত হবে, বে-আইনী কাজ করার কারণে শাস্তির আওতায় আসবে, এটাই স্বাভাবিক।

রসুলাল্লাহর নব্যুয়তি জীবনজুড়ে দীনের বিকাশ:
আল্লাহর রসুলের জীবনীও তেমনি, ইসলামও তেমনি। সমগ্র বিষয়টি এক দৃষ্টিতে দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন আল্লাহর রসুল আগমনের উদ্দেশ্য কী, কোর’আন নাজিলের উদ্দেশ্য কী, ইসলামের উদ্দেশ্য কী, রসুল কোন কাজ কেন করেছিলেন। নবী করিম (সা.) মানবজাতিকে শুধুমাত্র একটা কথা বলেছিলেন, তোমরা যদি আল্লাহর হুকুম মেনে নাও, তবে তোমরা শান্তি পাবে। তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, তোমাদেরকে রিযিক দিচ্ছেন আল্লাহ, তোমরা কোন পথে চললে শান্তি পাবে, তোমাদের সমাজ সুখময় হবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে সেটা তোমাদের থেকে তিনি ভালো জানেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তোমরা তাঁর হুকুম মেনে নাও। এই আহ্বানটার সারকথাই হচ্ছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না। এক কথায় সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে মানবজাতিকে তাদের ইতিহাস ও সম্পর্কের গোড়ার কথাটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছেন, সকল মানুষ এক বাবা মায়ের সন্তান। তারা এক পরিবার। তারা যেন তাদের জ্ঞাতিবন্ধন সম্পর্কে সতর্ক থাকে (সুরা নিসা, আয়াত ১)। অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মানবজাতিকে একটি মহাজাতিতে পরিণত করার জন্যই মূলত আল্লাহর রসুলের আবির্ভাব হয়েছিল। মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর দেওয়া দীনকে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা করার জন্যই রসুলাল্লাহর সংগ্রাম। তিনি এ লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম শুরু করলেন। এ কথা বলায় যাদের স্বার্থে আঘাত লাগল তারা একে অস্বীকার করল এবং তাঁর মুখ বন্ধ করার জন্য তাঁর উপর আক্রমণ চালাল, তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার শুরু করল ও বিভিন্ন অপবাদ আরোপ করল। তাঁকে পাগল, গণক, জাদুকর, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি বলে মানুষের মনকে তাঁর বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু একদল সত্যনিষ্ঠ মানুষ তাঁকে রসুল হিসাবে মেনে নিলেন। শেষ পর্যন্ত রসুলকে নির্মূল করে দেয়ার জন্য আঘাত করা হলো, আক্রমণ চালানো হলো, জন্মভূমি থেকেই বিতাড়িত করা হলো।
তখন এই অত্যাচারী জালেমদের বিরুদ্ধে রসুল যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। এই যুদ্ধ একদিনে হুট করে শুরু হয়নি। নিজ বাসভূমি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া একদল মানুষ যদি নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য শক্তি সঞ্চয় করে লড়াইতে প্রবৃত্ত হয় তাদের এই ন্যায়সঙ্গত প্রতিরোধ সংগ্রামকে তাহলে কোন বিচারে একে ইসলামবিদ্বেষীরা অন্যায় বলতে পারেন? সমাজের অন্যায়, অবিচার, শোষণ, জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করা তো প্রত্যেক মানুষের কেবল অধিকার নয়, দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে।
রসুলাল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করলেন। সমগ্র পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচার দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার মতো বৃহৎ কাজ কারো একার পক্ষে ও এক জীবনে সম্ভব না। তাই তিনি একটি জাতি গঠন করলেন। সে জাতির নাম আমরা বলতে পারি উম্মতে মোহাম্মদী অর্থাৎ মোহাম্মদের (সা.) অনুসারী। তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর নবগঠিত জাতির অবিসংবাদিত নেতা হলেন তিনি। স্বভাবতই জাতির সদস্যদের নানাবিধ সমস্যার সমাধান করার দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই বর্তালো। তারা কীভাবে ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনা করবে, কীভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করবে, কীভাবে তারা যুদ্ধ-সন্ধি করবে, কীভাবে বিচার ফয়সালা করবে ইত্যাদি প্রশ্নগুলো একে একে সামনে আসতে লাগল। সে সমস্যাগুলোর সমাধান রসুলাল্লাহ দিতে লাগলেন। ২৩ বছর ধরে একটা জাতির সকল সমস্যার সমাধানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই বিধানগুলো নাযিল হয়েছে। ওসমান (রা.) এর সময়ে সেই হুকুমগুলোকে একত্র (ঈড়সঢ়রষব) করা হয়েছে। সেই সংকলিত রূপটিই হচ্ছে আজকের কোর’আন। তাই কোর’আনের কোনো বিচ্ছিন্ন আয়াতকে আলাদাভাবে মান্য করার সুযোগ নেই, কারণ সকল আয়াতের পেছনে একটি প্রেক্ষাপট আছে, স্থান-কাল-পাত্রের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। একটি গাড়ির ক্ষুদ্র একটি যন্ত্রাংশকে যদি গাড়ি থেকে আলাদা করা হয় তাহলে সেটার অস্তিত্বের কোনো মূল্য থাকে না। যতক্ষণ তা গাড়ির নির্দিষ্ট জায়গায় যুক্ত থাকে ততক্ষণই সেটা গাড়ির প্রকৃত উদ্দেশ্য পুরণে অবদান রাখে।

যুদ্ধনীতি সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ পরিচ্ছদ:
পৃথিবীর সব সংবিধানেই যুদ্ধনীতি আছে, মানবাধিকারের কথা, শিক্ষাব্যবস্থার কথা আছে, শাসনকার্য পরিচালনার বিধান, বিচার-ব্যবস্থা নিয়ে কথা আছে। যখন রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সেই বিষগুলোর বাস্তবায়ন ঘটানোর প্রসঙ্গ আসে। তার আগে বিচ্ছিন্নভাবে, ব্যক্তি-উদ্যোগে সংবিধানের যুদ্ধনীতির চর্চা আরম্ভ করা হাস্যকর বৈ নয়। আল্লাহর কিতাব মানবজীবন পরিচালনা করার জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ বিধান। সুতরাং এতেও উল্লিখিত বিষয়াদি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, কোর’আন শুধুমাত্র বিজ্ঞানের বই নয় যদিও এসে অনেক বৈজ্ঞানিক সত্য তুলে ধরা হয়েছে, এটি কেবল কোনো আইনশাস্ত্রের বই নয় যদিও কিছু দণ্ডবিধি এতে বর্ণিত হয়েছে, এটি কোনো অর্থশাস্ত্রের বইও নয়, যদিও এতে অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। তাহলে কোর’আন কী? কোর’আনকে আল্লাহ পাক বলেছেন যিকির, স্মারক বা (Reminder) (সুরা আম্বিয়া ২১), কোর’আন উপদেশগ্রন্থ। (কোর’আনের বিশটিরও অধিক নাম কোর’আনেই আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন।) মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক কী কী সংকট আসতে পারে তার সমাধানের মূল সূত্র এখানে পাওয়া যাবে। মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন যিনি ভবিষ্যৎ জানেন, যেটা মানুষ জানে না। তিনি সবকিছু বিবেচনাতে নিয়েই সে বিধানগুলো একে একে সেখানে নাযিল করেছেন। আজকে যারা অভিযোগের সুরে বলেছেন রসুল যুদ্ধবাজ ছিলেন, তাদেরকে বলব, না- তিনি যুদ্ধবাজ ছিলেন না। কিন্তু কখনও কখনও দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনের জন্য যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে যায়, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই লক্ষ্যে তিনি যুদ্ধ করেছেন, তিনি যোদ্ধা নবী। সমাজ থেকে যখন অন্যায় নির্মূল করার জন্য সমস্ত প্রচেষ্টা ও আহ্বান ব্যর্থ হয়, তখন চ‚ড়ান্ত যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সে যুদ্ধের পশ্চাতে কী রয়েছে? যদি সেখানে ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থ থাকে তবে সেটা অন্যায়। আর যদি শুধু মানবতার কল্যাণে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে যুদ্ধ করতে হয় সেটা ন্যায়যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, সেটা জেহাদ। রসুল সেটাই করেছেন।
জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ইসলাম থেকে আসেনি। এই জঙ্গিবাদ ধর্মব্যবসায়ী এবং সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্রব্যবসায়ী শক্তিগুলোর সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফল। এটা আমার রসুলের ইসলাম নয়। যাদের সামনে ইসলামের প্রকৃত আকিদা (সম্যক ধারণা- Comprehensive Concept) নেই, তারা জেহাদ, কেতাল আর সন্ত্রাসকে আলাদা করতে পারবে না। তবে কখন কোন নিয়ম প্রযোজ্য হবে, কার বেলায় কোন আয়াত প্রযোজ্য হবে, সেটা কোনো মসজিদের ইমাম, কোনো মাদ্রাসার শিক্ষক, মুহাদ্দিস বা খানকার পীর বললেই কার্যকর করা যাবে না। আল্লাহর আয়াত কার্যকর করার জন্য প্রথমে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এক জাতি হতে হবে। অতঃপর সেই জাতিকে আল্লাহর হুকুমের উপর অটল থাকার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই জাতির নেতা বা পরিচালক হবেন একজন। ঐ নেতা জাতির সামগ্রিক কল্যাণের লক্ষ্য আল্লাহর কেতাবে বর্ণিত নীতি ও স্থান-কাল-পাত্র সকল কিছু মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।
আবারো বাংলাদেশের উদাহরণে আসি। সত্তর এর নির্বাচনে যে দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও জনগণের রায় নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিল সেই দলকে যখন ক্ষমতা দেয়া হয় নি, তখন কি যুদ্ধ অনিবার্য হয় নি? বাঙালিরা কি শখ করে যুদ্ধ করেছে? তাদেরকে যুদ্ধের কারণে বহু প্রাণহানী হয়, ক্ষয়ক্ষতি হয় এটা সবারই জানা, তবু যুদ্ধ করতে হয়েছে। যখন যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন প্রয়োজন পড়ে যুদ্ধের নীতি নির্ধারণ করা। স্বাভাবিক সময়ের নীতি দিয়ে যুদ্ধ চলে না। এজন্য কোনো রাষ্ট্রের সংবিধানের মধ্যেই যুদ্ধনীতি থাকে, যদি রাষ্ট্র বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন কী করণীয় সেটা নির্ধারণের জন্য। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানেও যুদ্ধনীতি রয়েছে। এটি না থাকলে সেই সংবিধান হবে অসম্পূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত সংবিধান বা জীবনবিধান। একই কারণে পবিত্র কোর’আনে অন্যান্য সকল বিধি-বিধানের পাশাপাশি যুদ্ধসংক্রান্ত বিধানাবলিও রয়েছে।

যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ:
আমার কথা হচ্ছে এই, বর্তমানের যে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ এটা ইসলাম থেকে সৃষ্টি হয়নি। ইসলাম এসেছে শান্তি কায়েমের জন্য, অশান্তি সৃষ্টির জন্য নয়, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য, বিভাজিত করার জন্য নয়। হ্যাঁ, কোর’আনে বলা আছে যে শত্রুর গর্দানে আঘাত করো, গিরায় গিরায় মারো (সুরা আনফাল ১২), ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে ওঁত পেতে বসে থাক (সুরা তওবা ৫)। আমাদের নবী করিম (সা.) একটা জাতিকে সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছেন। উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে তাঁকে জীবন উৎসর্গের কথা বলতে হয়েছে, শাহাদাতের জন্য ব্যাকুলতা পোষণের কথা বলতে হয়েছে। পবিত্র কোর’আনেও এর হুকুম এসেছে যে, “হে আল্লাহর রসুল! আপনি মো’মেনদেরকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করুন।” (সুরা আনফাল ৬৫)। একাত্তর সালেও বহু কালজয়ী গান রচনা করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করার জন্য। আপনারা জানেন যুক্তরাষ্ট্র যখন অন্যায়ভাবে ইরাক ধ্বংস করার জন্য তার সৈন্যদের পাঠাল তখন সেনাবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বাগদাদ পর্যন্ত চলে এসেছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর উদ্দেশে কী ধরনের উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়েছেন তা গণমাধ্যমে এসেছে। আপনারা অনেকেই জানেন, তাদের দেশের চলচ্চিত্রগুলো আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের মতো পারিবারিক বা রোমান্টিক গল্পনির্ভর নয়। তারা একটি জাতীয় উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। তাদের রাষ্ট্র প্রতিদিন এখানে ওখানে যুদ্ধ লাগিয়ে রাখে আর সেনাবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য র‌্যাম্বো জাতীয় চরিত্র তৈরি করে আমোরিকার মহানায়করূপে চিত্রায়িত করে। তারা দেখাতে চায় যে আমাদের সৈন্যরা দুর্বার, দুর্ধর্ষ, বিজয়ী। একটি বড় মিশন সফল করতে তাদের একজনই যথেষ্ট। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে তারা সফল হবে, বিজয় ছিনিয়ে আনবে। এজন্য এ জাতীয় সিনেমাগুলো বানানো হয়েছে।
বিশ্বের সকল জাতির প্রধান তার জাতিকে শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়লাভ করার জন্য যেকোনো কলাকৌশল (Policy) শিক্ষা দিবেন এটাই স্বাভাবিক, এটাই ন্যায়সঙ্গত। রসুল সেটাই করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ করা হয়েছিল, যুদ্ধের নাম আহযাব। আহযাব মানে হলো সম্মিলিত সামরিক বাহিনী। তাঁকে মক্কা থেকে বের করে দিলে তিনি মদিনায় আসলেন। কাফেররা যখন সমগ্র মদিনাকে অবরোধ করল, আরবের সমস্ত গোত্রের সেনাবাহিনীকে সমবেত করল তখন রসুলাল্লাহর কি তাদের গিরায় গিরায় না মেরে আদর-আপ্যায়ন করা উচিত ছিল? যদি সেদিন মদিনা থেকে শত্রুকে বিতাড়িত করা না হতো, মদিনার প্রত্যেকটা নারী মো’মেনা ধর্ষিতা হতেন এ কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। কিন্তু আল্লাহ তাঁদেরকে রক্ষা করেছেন কারণ রসুলাল্লাহও যুদ্ধের মাধ্যমেই আক্রমণকারীদেরকে সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন।
কাজেই শত্রুকে পরাজিত করার জন্য, শত্রুকে নির্মূল করার জন্য, শত্রুর মনে ভয় ঢোকানোর জন্য, ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য জাতির নেতা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করবেন, নীতি-নির্ধারণ করবেন, কলাকৌশল শেখাবেন এটা বিশ্বের সকল জাতির মধ্যেই ন্যায়সঙ্গত ও গৃহীত এবং খুবই স্বাভাবিক। রসুলাল্লাহ সেটাই করেছেন এবং সবকিছ্রু উদ্দেশ্য ছিল মানবতার কল্যাণ।
প্রাচীন ভারতবর্ষে সংঘটিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আঠারো অক্ষৌহিনী সৈন্য নিহত হয়েছে। সেই ধর্ম ও অধর্মের লড়াইয়ে বা ধর্মযুদ্ধে ধর্মের পক্ষে সেনাপতি ছিলেন ছিলেন পঞ্চপাণ্ডবের বড় ভাই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। কৃষ্ণ বলেছিলেন, “ সংসার থেকে যখন ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন করুণাও নষ্ট হয়ে যায় আর সত্যও নষ্ট হয়ে যায়। আগামী প্রজন্মের যাতে ধর্ম প্রাপ্তি হয় সেজন্য আজ অধর্মীদের নাশ করে ধর্মের পুনস্থাপনা করা অত্যন্ত অনিবার্য।” সেই ধর্মযুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদেরকে সনাতন ধর্মের লোকেরা বীরগতিপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করেন। তাহলে আমাদের রসুল যুদ্ধ করেছেন, লড়াই করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, তাঁর জীবনের সবকিছুর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মুক্তি, মানুষের কল্যাণ। তা না হলে বেলালদের (রা.) মতো লোকদের ঐ দাসত্ব কোনোদিন দূর হতো না, নারীদেরও মুক্তি হতো না।

রায় দেওয়া সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের কাজ:
জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ইসলাম থেকে আসে নি। এই জঙ্গিবাদ ধর্মব্যবসায়ী এবং সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্রব্যবসায়ী শক্তিগুলোর সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফল। এটা আমার রসুলের ইসলাম নয়। যাদের সামনে ইসলামের প্রকৃত আকিদা (সম্যক ধারণা- Comprehensive Concept) নেই, তারা জেহাদ, কেতাল আর সন্ত্রাসকে আলাদা করতে পারবে না। তবে কখন কোন নিয়ম প্রযোজ্য হবে, কার বেলায় কোন আয়াত প্রযোজ্য হবে, সেটা কোনো মসজিদের ইমাম, কোনো মাদ্রাসার শিক্ষক, মুহাদ্দিস বা খানকার পীর বললেই কার্যকর করা যাবে না। আল্লাহর আয়াত কার্যকর করার জন্য প্রথমে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এক জাতি হতে হবে। অতঃপর সেই জাতিকে আল্লাহর হুকুমের উপর অটল থাকার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই জাতির নেতা বা পরিচালক হবেন একজন। ঐ নেতা জাতির সামগ্রিক কল্যাণের লক্ষ্য আল্লাহর কেতাবে বর্ণিত নীতি ও স্থান-কাল-পাত্র সকল কিছু মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে জাতির প্রত্যেক লোকের ওপর ফরযে আইন। সোজা কথা, একটি সার্বভৌমত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই যে কোনো আইন বা শরিয়াহ কার্যকর হয়। এর বাইরে অন্য কারো দ্বারা আইন প্রয়োগ করতে যাওয়া হবে বে-আইনী। আজকে তো মাদ্রাসায় কিছু মাসলা-মাসায়েল শিখিয়ে ‘মুফতি’ হিসাবে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যিনিই মুফতি সার্টিফিকেট পাচ্ছেন তিনিই ফতোয়া দেওয়ার অধিকারী বলে নিজেকে সাব্যস্ত করছেন। যখন রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত ছিল অর্থাৎ খলিফাদের যুগ থেকে শুরু করে সর্বশেষ সুলতানি যুগ পর্যন্ত ‘মুফতি’ ছিল সরকারি বিচারবিভাগীয় একটি পদ। সরকারি মুফতিরা ছাড়া সে সময় অন্য কেউ ফতোয়া দেওয়ার অধিকারী ছিলেন না। আজকে কোনো আইনজীবী বা সংবিধানের ধারা-উপধারা জানেন এমন কোনো সাধারণ মানুষ কি বাংলাদেশের দণ্ডবিধি মোতাবেক কোনো অপরাধীকে সাজা দিতে পারেন? তিনি দিলেই কি সেটা ‘রায়’ বলে গৃহীত হবে? কখনো নয়। রায় দিবেন বিচারপতি (কাজী), তাকে সহযোগিতা করবেন জুরিবৃন্দ (মুফতি)। ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই ‘মুফতি’ পদটি ছিল অনেকটা বর্তমানের জুরিদের মতোই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলেও আদালত ও ফৌজদারি বিভাগে এই পদগুলোই বহাল ছিল। এখন তো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কাজেই কোর’আনের এই যুদ্ধসংক্রান্ত হুকুমগুলো একেকজন একেকভাবে বললেই কার্যকরী হয়ে যাবে এমন ধারণা ইসলাম স্বীকার করে না। কোনো ব্যক্তির সাজাপ্রাপ্তি হবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে। এখন যেহেতু জাতীয় জীবনে ইসলামের হুকুম প্রতিষ্ঠিত নেই তাই কোনো মুফতির এই সিদ্ধান্ত প্রদানের অধিকার নেই যে অমুক ফাসেক, অমুক মুরতাদ, অমুক কাফের, অমুক নাস্তিক- তাকে হত্যা করো, তাকে জ্বালিয়ে দাও। কে সধর্মী কে বিধর্মী, কে শত্রু কে মিত্র ইত্যাদি নির্ধারণ করবেন জাতির কর্তৃপক্ষ বা নেতা। আজকে ইসলামের সেই একক কর্তৃপক্ষ কোথায়? সেই ঐক্যবদ্ধ জাতি কোথায়? জাতি এখন কার কথা শুনবে? সেই কর্তৃপক্ষ নেই, সেই জাতিও নেই। অখণ্ড নেতৃত্ব না থাকার কারণে জাতি এখন বিচ্ছিন্নভাবে যে যার খেয়ালখুশিমতো আমল করে যাচ্ছে। জাতির মধ্যে এখন হাজার হাজার ইমাম, লাখ লাখ মুফতি, মুফাসসির, মোহাদ্দিস, আলেম, শায়েখ, পীর। তারা একেকজন একে তরিকা, ফেরকা, মাজহাবে বিভক্ত। একদল আরেকদলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে লিপ্ত। তাদের অনেকেই ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হয়ে নিজেকে নিজে কর্তৃপক্ষ মনে করে ফতোয়া জারি করছেন, আর জাতির সদস্যরাও যাকে যার পছন্দ তার অনুসরণ করছে। এভাবে কোর’আনের একই আয়াতের হাজারটা ব্যাখ্যা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, একেকজন একেক বিধানের একেকরকম চর্চা করছে। এতে করে তারা প্রচলিত আইনে যেমন অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন, তেমনি ইসলামেরও বদনাম হচ্ছে। আর চ‚ড়ান্ত অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে আল্লাহ ও রসুলের উপর।
জাতির এমাম চাইলে অনেক সময় চিহ্নিত শত্রুকে পর্যন্ত ক্ষমা করে দিতে পারেন, মুনাফিককে পর্যন্ত ক্ষমা করে দিতে পারেন। আবু সুফিয়ানের মতো লোক যিনি মক্কা বিজয়ের দিন পর্যন্ত আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, আল্লাহর রসুল সেই আবু সুফিয়ানকে পর্যন্ত ক্ষমা করে দিয়েছেন বহু সুযোগ আসা সত্ত্বেও। মদিনায় আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মতো কট্টোর মুনাফিক, জাতির ক্ষতি করার জন্য সদা তৎপর ছিল, সেই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে পর্যন্ত রসুলুল্লাহ হত্যা করেন নি বহুবার সুযোগ পেয়েও, ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও। এই সামগ্রিক বিবেচনাটা জাতির এমাম করবেন। কাজেই কাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে কাকে ক্ষমা করা হবে, কার সঙ্গে সন্ধি-চুক্তি করা হবে, কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে বা হবে না ইত্যাদির সিদ্ধান্ত আমার আপনার জন্য না। সেটা নিতে হবে জাতির অর্থাৎ জাতির পক্ষ থেকে অবিসংবাদিত নেতার তথা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত কর্তৃপক্ষের।

[লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ। facebook.com/riyad.hassan.ht
ফোন: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০-১৭৪৬৫১]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...