হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়?

তাহের হোসেন মারুফ
ধর্মবিশ্বাস, যা যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে ও সমাজে স্থান করে আছে। আর করবে নাই বা কেন, মানব সমাজে শান্তি দিতে পেরেছিল কেবল ধর্মই। কিন্তু মানুষ যখন এই ধর্ম নিয়েই বাড়াবাড়ি করা শুরু করে, নিজেদের স্বার্থের হাতিয়ার বানায় আর ধর্মের ছোটখাটো বিষয়গুলোকে ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য বানিয়ে ফেলে তখনই নেমে আসে বিপর্যয়। আর যখন এই বিপর্যয় নেমে আসে তখন ধর্মের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য হারিয়ে তা শান্তির বদলে মানুষকে অশান্তি দিতে থাকে।
সময়টা যীশু খ্রিষ্ট্রের জন্মের প্রারম্ভের। তখন ইহুদিদের কাঁধে শত শত বছরের অত্যাচার আর নিপীড়নের বোঝা। তাদের উপরে ব্যাবিলন, পারস্য, গ্রিস, রোম প্রায় সবাই ছড়ি ঘোরাল, তবু তাদের জীবনে শান্তি এলো না। তখন ইহুদিরা অপেক্ষা করছিল তাদের কেতাবে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে একজন মসীহের (নবী) আগমনের যে তাদেরকে রক্ষা করবে। আর একটা সময় সত্যিই যখন তিনি এলেন তখন এতোদিন ধরে যারা তার অপেক্ষার প্রহর গুনছিল তারাই হয়ে উঠল তাঁর পরম শত্রু। ইহুদিদের শাসক হেরদ ও রোমান কর্তৃপক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে তারা (ইহুদি) যীশু খ্রিষ্টকে গ্রেফতার করল। অপরাধ হিসেবে খোদ ইহুদিদের ধর্মীয় নেতারা দাঁড় করাল যে, যীশু ধর্মের অবমাননা করেছেন। আর অপরদিকে রোমানদের চোখে তার অপরাধ ছিল রাজনৈতিক। রোমান শাসক যীশু খ্রিষ্টকে শাস্তি দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না কিন্তু ইহুদি ধর্মীয় নেতাদের চাপে পড়ে তিনি তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হন। আর এভাবেই ইহুদীদের মুক্তির বাহক হিসেবে যিনি এসেছিলেন তাকে নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এই অপরাধের ফল ইহুদিরা পরের কয়েক শত বছর ভোগ করে নিজেদের জীবন দিয়ে। তাদের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে- কখনো অন্য জাতির হাতে মার খেয়ে আবার কখনো বিতাড়িত হয়ে। তবে সবচেয়ে বড় যে কারণ তা হলো, কেউ যদি অন্য ধর্ম থেকে ইহুদি ধর্মে আসতে চাইতো তবে তা সহজ ছিল না। কারণ তখন ইহুদিদের ধর্মে এতোটাই গোড়ামী ছিল যে শুধুমাত্র কেউ যদি ইহুদি পরিবারে জন্ম নিতো তবেই সে ইহুদিদের ধর্মের বিধি-নিষেধ গুলো আয়ত্ত করতে পারতো।
এই ইহুদিদের মধ্য থেকে পল নামে একজন ব্যক্তির আবির্ভাব হলো যিনি যিশুর শিক্ষাকে ইহুদি জাতির বাইরে প্রচার করতে শুরু করলেন। এই কাজের মাধ্যমে পল যিশুর শিক্ষার মূল নীতিকেই বর্জন করলো, কারণ যীশুর শিক্ষা বনী ইসরাইলের বাইরের কারো জন্য প্রযোজ্য ছিল না।
সেন্ট পলের প্রচারের দরুন খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনেক শাসকও একে গ্রহণ করে। একটা সময় খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও বিভক্তি সৃষ্টি হলো। তারা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যেই মতোবিরোধ শুরু করলো। একটি দল প্রাচীন মতে বিশ্বাসী হলে তাদেরকে বলা হলো “গোড়া” (অর্থোডক্স)। গ্রিক ভাষায় অর্থোডক্সের অর্থ হলো “সরল বিশ্বাসী”। আরেকটি দল প্রাচীন ধর্মকে খারিজ করে দিয়ে নতুন নিয়মকানুনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল বলে তাদের বলা হলো “নব্যতান্ত্রিক” (হেরেসিস)। গ্রিক ভাষায় হেরেসিস অর্থ “হলো নিজের জন্য বেছে নেওয়া।” এভাবে আরও কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে গেলো খ্রিষ্টান জাতি। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, বিধর্মীদের চেয়ে খ্রিষ্টানরা নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে বেশি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠলো।
ফলশ্রæতিতে, তখন সমাজের একটা শ্রেণি সর্বেসর্বারূপে সমাজকে শাসন করতে থাকলো আর একদল নিজেদের ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে মাতামাতিতে লিপ্ত থাকলো। তারপর হঠাৎ করেই একসময় পৃথিবীকে অটুট রাখার বাস্তব প্রয়োজনীয়তা মানুষের মনে নাড়া দেয়। সমাজের বুদ্ধিমান মানুষেরা তখন একটা নতুন প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তা হলো ধর্মতত্ত¡ (থিওলজি)। কিন্তু বুদ্ধিমানদের সেই চেষ্টা বৃথাই ছিল। কারণ তাদের তত্ত¡ ক্রমেই বিফল হতে থাকে।
আর এভাবেই মানুষ ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেললো। বেশিরভাগ মানুষ এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে নিজেদের সমস্ত শক্তি আর ক্ষমতা অন্য আরেকটি উন্নত পৃথিবীর আশায় (পরকালীন দুনিয়া) নিয়োজিত করল। তারা এই পৃথিবীর উন্নয়নসাধন করতে ভুলে গেল। আর ধীরে ধীরে বিদ্যমান পৃথিবীকে হয় মূল্যহীন না-হয় শয়তানের আখড়া ভেবে নিল। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলেই এই পরিণতি হলো।
একইভাবে ইসলাম ধর্মের শুরুতে যখন মহানবী (স.) একটি জাতি গঠন করলেন তখন এই জাতি ধীরে ধীরে বিস্তৃতিলাভ করতে থাকলো। কিন্তু একটা সময় যেভাবে খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা যিশুর প্রকৃত শিক্ষাকে পরিত্যাগ করেছিল তেমনি তারাও রসুলের শিক্ষা ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্যেই বিভক্তি সৃষ্টি করতে শুরু করলো। তারাও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক করতে থাকলো। তারা জাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ভুলে গেল। কী সেই উদ্দেশ্য? সেটি হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া দীন সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতির জীবনে প্রতিষ্ঠা করে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, যুক্ত রক্তপাত বিলুপ্ত করে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার কায়েম করা। এটা ভুলে গিয়ে তারা যখন নিজেরা নিজেরা দ্ব›দ্ব শুরু করলো তখন তাদের ভাগ্যেও ইহুদি জাতির মতোই পরাজয় নেমে এল। আল্লাহ তাদের প্রতি লানত করলেন, তাঁর গজব নাজিল করলেন। একদা শ্রেষ্ঠ জাতি মুসলিম হয়ে গেল পাশ্চাত্যের গোলাম। সেই গোলামী এখনও চলছে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...