হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্মের বিনিময় নেবার বিরুদ্ধে নবী-রসুলদের বক্তব্য

রিয়াদুল হাসান:
প্রতিটা দীন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যুগে যুগে এসেছে মানবতার কল্যাণের জন্য। যখন কোন সমাজ ধর্মকে বিকৃত করেছে তখনই অন্যায় অবিচারে ছেয়ে গেছে মানুষের জীবন; ফলশ্রুতিতে আল্লাহ পাক নবী-রসুলদের মাধ্যমে নতুন দীন বা জীবনব্যবস্থা পাঠিয়েছেন। নবী-রসুলগণ আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত নতুন দীনটির মর্মবাণী পূর্ববর্তী বিকৃত ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে প্রচার করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নানাভাবে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়েছেন। নবী-রসুলগণ শতনির্যাতন ও বাধা সত্ত্বেও তাঁদের সেই সংগ্রাম অর্থাৎ তওহীদের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা চালিয়ে গিয়েছেন। অবশেষে যখন আল্লাহর সাহায্যে ঐ দীন বা জীবনব্যবস্থা উক্ত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন সমাজ থেকে সকল অন্যায় অবিচার দূর হয়ে অনাবিল শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তথা দীনী কাজ করতে গিয়ে কখনো নবী-রসুলগণ বিনিময় গ্রহণ তো করেনই নি বরং তাদের সকল সহায়-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে গেছেন, দীন প্রতিষ্ঠার পরও তাঁরা অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। তাঁরা তাঁদের অনুসারীদের সাবধান করে গেছেন বিনিময় না নেয়ার জন্য। যতদিন ঐ ধর্মটি অবিকৃত থেকেছে ততদিন নবী-রসুলদের কোন অনুসারীও দীনের বিনিময় গ্রহণ করেন নি। কোনো যুক্তিতেই আল্লাহ পাক ও তাঁর নবী-রসুলগণ দীনের বিনিময় নেবার কোন সুযোগ দেন নি। সত্যের আহ্বানে বিনিময় না নিয়ে বরং ত্যাগ হল সত্যতার একটি নিদর্শন।
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ রসুলাল্লাহকে (সা.) সত্য প্রচারের বিনিময়ে কোনো মজুরি, সম্পদ, বিনিময় (payment, wealth, reward) গ্রহণ না করার জন্য অন্তত ছয়টি আয়াতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেছেন,
তুমি তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি কোরো না। এই বাণী তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র (সুরা ইউসুফ ১০৪)।
বল! আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভুক্ত নই (সুরা সা’দ ৮৬)।
বল! আমি এর (দীনের) বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো মজুরি চাই না (সুরা শুরা – ২৩)।
তবে কি তুমি তাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছ যা ওরা একটি দুর্বহ বোঝা মনে করে (সুরা তুর: ৪০)?
তাদেরকেই (নবীদেরকেই) আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনো মজুরি চাই না। এটা তো বিশ্ব জগতের জন্য উপদেশ (সুরা আনআম – ৯০)।
(হে মোহাম্মদ!) তুমি কি তাদের নিকট কোনো মজুরি চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই তো শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রেযেকদাতা (সুরা মুমিনুন: ৭২)।
প্রত্যেক নবী-রসুল তাদের জাতির উদ্দেশ্যে একটি সাধারণ ঘোষণা দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর কাছে। এ বিষয়ে নবী রসুলদের (আ.) বেশ কয়েকজনের ঘোষণা আল্লাহ দৃষ্টান্তস্বরূপ পবিত্র কোর’আনেও সন্নিবেশিত করেছেন।
নূহ (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট (সুরা হুদ-২৯)।
হুদ (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাই না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও বুদ্ধি (আক্ল) খাটাবে না (সুরা হুদ-৫১)?
নূহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো কেবল বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে (সুরা শু’আরা ১০৯)।
সালেহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা-১৪৫)।
লুত (আ.) এর ঘোষণা: এর জন্য আমি কোনো মজুরি চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা-১৬৪)।
নূহ (আ.) এর ঘোষণা: যদি তোমরা আমার কথা না শোনো তাহলে জেনে রাখ, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই নি। আমার প্রতিদান কেবল আল্লাহর নিকট এবং আমাকে মুসলিম (সত্যের প্রতি সমর্পিত) হওয়ার জন্য আদেশ করা হয়েছে (সুরা ইউনুস ৭২)।
হুদ (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাচ্ছি না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি এই বিশ্বজাহানের ¯্রষ্টা (সুরা শু’আরা ১২৭)।
শোয়েব (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো মূল্য চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা-১৮০)।
ধর্মের কোনো কাজ করে নবী ও রসুলরা পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না, সুতরাং তাঁদের অনুসারী উম্মতের জন্যও পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ নয়। তবু পূর্ববর্তী কেতাবধারী জাতিগুলোর মধ্যে একটি ধর্মজীবী পুরোহিত শ্রেণির উত্থান হয়েছিল যারা ধর্মের মূল শিক্ষাকে বিকৃত করে ফেলেছে। তাদের সেই অপকর্মের ইতিহাস পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বারংবার উল্লেখ করেছেন যেন আখেরি নবীর (সা.) উম্মাহর মধ্যে এমন ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর উদ্ভব না হয়। ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে রসুলাল্লাহ (দ.) এর একটি বাণী উল্লেখ করছি-
আল্লাহর রসুলও তাঁর জাতির মধ্যে যেন ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত শ্রেণী গজিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য তিনি তাঁর আসহাবদেরকে বার বার সতর্ক করে গেছেন। উবায়দা বিন সামেত (রা.) ছিলেন আসহাবে সুফফার অন্তর্ভুক্ত এক সাহাবী। তাঁকে রসুলাল্লাহ কোন এক গোত্রের লোকদেরকে কোর’আন শিক্ষা দিতে প্রেরণ করেছিলেন। সেই গোত্রের একজন ব্যক্তি উবায়দাকে (রা.) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার উদ্দেশ্যে একটি ধনুক ও তীর উপহার দিয়েছিলেন। উবায়দা (রা.) রসুলাল্লাহর দরবারে ফিরে এসে যখন সেই তীর ও ধনুক তাঁকে দেখালেন তখন রসুলাল্লাহ বললেন, “যদি তুমি আগুনের তীর গলায় জড়িত হওয়া পছন্দ করো তাহলে তুমি এটা গ্রহণ করো” (আবু দাউদ)।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সন্দেহ নেই। উবায়দাহ (রা.) কে কোর’আন শিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে যে উপহারটি দেওয়া হয়েছিল সেটা কোনো অর্থকড়ি নয়, ব্যক্তি ব্যবহার্য কোনো বস্তুও নয়। সেটা হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম হেতু ব্যবহারের জন্য একটি অস্ত্র। অথচ সেই অস্ত্রটি গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ হয়ে গেল, কেবল নিষিদ্ধই না, সেটা আখেরাতে আগুনের তীর হয়ে গ্রহণকারীর বুকে বিঁধবে এই কারণে যে, তিনি সেটা গ্রহণ করেছিলেন কোর’আন শিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে। এমন ঘটনা আরও আছে। রসুলাল্লাহর এই কথার পর দীনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে অর্থ উপার্জনের কোনো পথ খোলা রইল কি?
তা সত্ত্বেও বর্তমানের বিকৃত ইসলামে পয়সা ছাড়া কিছুই হয় না, জানাজার নামাজ পড়ালেও পয়সা দিতে হয়। তালবে-এলেম থেকে শুরু করে পীরে কামেল, গাউস কুতুব, মুফতি, শায়খ নামধারী আল্লামাগণ পয়সা ব্যতীত অধিকাংশই কোনো ধর্ম-কর্ম করেন না। পূর্ববর্তী বিকৃত ধর্মের আলেম ওলামা ও রূহানি সাধকরাও যে এমনই ভাবে মানুষকে দীনের সঠিক শিক্ষা থেকে, জান্নাতের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইতেন এবং ধর্মকে পুঁজি করে সম্পদের মালিক হতে চাইতেন – সেটাও আল্লাহও জানিয়ে দিয়েছেন সুস্পষ্টভাষায়। তিনি বলেছেন, “হে মো’মেনগণ! আলেম ও সুফিদের (আহবার ও রোহবান) মধ্যে বহুসংখ্যক তোমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে চলেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে মানবজাতিকে ফিরিয়ে রাখছে (সুরা তওবা ৩৪)। আমাদের বর্তমান সমাজেও ইসলাম এমনই ধর্মব্যবসায়ী আলেমদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...