হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্মব্যবসা থেকে মুক্তির পথসন্ধান

রিয়াদুল হাসান:
বর্তমানে গোটা মুসলিম বলে পরিচিত জনগোষ্ঠী আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি অনৈতিক কাজে লিপ্ত আছে। কেউ ধর্মব্যবসা করে খাচ্ছেন, কেউ তাকে দিচ্ছেন, কেউ মৌন থেকে সম্মতি দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবাই এই অবৈধ কাজের সাথে জড়িয়ে আছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে আমরা এই অন্যায় থেকে আমাদের সমাজকে মুক্ত করতে পারব?
শত শত বছর থেকে যখন একটি সিস্টেম, ব্যবস্থা কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে দাঁড়িয়ে যায় তখন এর সাথে বহু প্রতিষ্ঠান, বহু মানুষের জীবন ও কর্মসংস্থান জড়িয়ে যায়। তখন হুট করেই সেই ব্যবস্থাটি থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ বিষয় হয় না। তবু একটি জাতিবিধ্বংসী অন্যায় চিহ্নিত হওয়ার পরও চিরকাল চলতে পারে না। একে বন্ধ করার জন্য সর্বাত্মক সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ধর্মব্যবসার করাল থাবা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য আমাদের দুটো বিষয় করণীয়।
প্রথমত, প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা প্রচার ব্যতিত এই সংকট থেকে জাতি মুক্তি পাবে না। তাই ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি দলিল প্রমাণ ও যুক্তি সহকারে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সেগুলো পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। শত শত বছর ধরে এই মহাসত্যকে আড়াল করে মানুষকে অজ্ঞ বানিয়ে ধর্মব্যবসা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এখন সেই লুকানো সত্যকে সহস্রধারায় মানুষের দৃষ্টির সামনে মেলে ধরতে হবে। মানুষ সৃষ্টিগতভাবে যুক্তিশীল প্রাণী। তাই কোনো যৌক্তিক সত্যকে সে গ্রহণ না করে পারবে না। সাধারণ মানুষ যখন ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে সচেতন হবে তখন তাদের এই মানসিক ঐক্যই তাদের সমাজে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে। যে সমাজের প্রতিটি মানুষ ধর্মব্যবসাকে ঘৃণা করে সেই সমাজে কখনই ধর্মব্যবসা টিকে থাকতে পারবে না। অন্ধকার দূর করার একমাত্র পথ হচ্ছে আলোর আবির্ভাব ঘটানো। ধর্মব্যবসা সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই জানে না। তাদের সামনে সত্যের আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্জলিত করা হবে তখন তাদের অজ্ঞানতার অন্ধকার কেটে যাবে। ধর্মব্যবসা নির্মূল হলেই ধর্মান্ধতা, ধর্মের অপব্যবহার, কুসংস্কার, জঙ্গিবাদ সমস্তকিছু নির্মূল হবে। কারণ এটাই ধর্মের নামে প্রচলিত যাবতীয় বিকৃতির উৎসমূল।
ইতোমধ্যে জাতি জঙ্গিবাদের মত ভয়াবহ সঙ্কটে আক্রান্ত হয়ে গেছে যে সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা এত সোজা নয়। একটি ঘটনা হাজারো ঘটনার জন্ম দেয়, একটি যুদ্ধ বহু যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। প্রথম অন্যায়ের পরে পরবর্তী অন্যায়গুলো সংঘটনের ন্যায্যতা পেয়ে যায়। কাজেই জঙ্গিবাদ থেকে বেরিয়ে আসা এত সহজ নয়, কেননা জঙ্গিবাদের পক্ষে অনেক যুক্তি দাঁড়িয়ে গেছে যা আপাতঃদৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। এরই মধ্যে গুজব, হুজুগ, উন্মাদনা সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিভিন্ন দাবি আদায়ের নামে অসার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী। সাম্রাজ্যবাদীরা ওঁৎ পেতে আছে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য যেমনটা হয়েছিল সিরিয়া, ইরাক, মিশর ইত্যাদি দেশে। সুযোগ পেলেই তারা হামলে পড়বে। এই মুহূর্তে জাতিকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটা হলো ধর্ম আর ধর্মের নামে প্রচলিত অধর্মকে আলাদা করে সেই অধর্মকে পরিত্যাগ করতে হবে। ধর্মবিশ্বাসী প্রতিটি মানুষকে একটি কথার মধ্যে দাঁড়াতে হবে যে কোন ফকিহ, কোন মুফতি, কোন মৌলভি, কোন পীর সাহেব, কোন বুজুর্গ কী বলল সেটা আমরা দেখব না। আমরা দেখব আল্লাহ কী বলেছেন আর তার প্রেক্ষিতে রসুলাল্লাহ কী করেছেন। এর বাইরে আর কিছু আমরা মানবো না। এতে ধর্মকে অপব্যবহার করে স্বার্থ হাসিলকারীরা কে বেকার হয়ে গেল, কে কোন স্বার্থ থেকে বঞ্চিত হলো এটা আমাদের দেখার বিষয় না। কারণ রোগী যখন জীবন-মৃত্যু সংকটে পড়ে তখন অস্ত্রোপচার ছাড়া গতি থাকে না, করুণা দেখিয়ে লাভ হয় না। সেভাবে ধর্মব্যবসাকে আমাদের সমস্ত জাতি মিলে একত্রে বয়কট করতে হবে। যদি তা না করা হয়, যদি হারাম জেনেও ধর্মব্যবসায়ীদেরকে টাকা দিয়েই যাওয়া হয় তাহলে কোনোদিন ধর্মব্যবসা বন্ধ হবে না, ধর্মের নামে এই হারাম কাজ জারি থাকবে। ধর্মব্যবসায়ীরা খাবে কী এই প্রশ্নের উত্তর পূর্বে একবার দিয়ে এসেছি। আবারও সংক্ষেপে বলছি, সমাজের মানুষ যদি চায় তাহলে অল্প কিছু লোকের উপার্জনের জন্য একটি বৈধ পন্থা বের করে দেওয়া কঠিন কাজ নয়।
দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে কোনোদিন রক্ষা করবে না, সঠিক পথ দেখাবে না। বরং জাতিকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিয়ে যাবে। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় দীন সম্পর্কে প্রায় কিছুই শিক্ষা দেওয়া হয় না। বরং সুদভিত্তিক অংক, ব্রিটিশ রাজা- রানির ইতিহাস, ভ‚গোল, বিজ্ঞান, গণিত, পাশ্চাত্যের ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, পাশ্চাত্য বস্তুবাদী দর্শন ইত্যাদি শিক্ষার পাশাপাশি ধর্ম সম্পর্কে, বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে একটা বিদ্বেষভাব শিক্ষার্থীদের মনে প্রবেশ করানো হয়েছে। ওখান থেকে লক্ষ লক্ষ কথিত আধুনিক শিক্ষিত লোক বের হচ্ছেন যারা চরম আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। নিজেদের বৈষয়িক উন্নতি ছাড়া আর কিছুই তারা ভাবেন না। আবার মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাও আমাদেরকে সমান বস্তুবাদ শেখাচ্ছে। সেখান থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসা লোকেরা জনগণকে পরকালের পেছনে ছুটিয়ে দেন কিন্তু নিজেরা ছুটতে থাকেন বস্তুর পেছনে, অর্থের পেছনে। এ ক্ষেত্রে হালাল-হারাম, নীতি-দুর্নীতির কোনো তোয়াক্কা তারা করেন না। উভয় শিক্ষাব্যবস্থাই স্বার্থপর পয়দা করে এবং বিভক্তির শিক্ষা দেয়। বছর বছর দেশের হাজার হাজার মাদ্রাসা থেকে লক্ষ লক্ষ ছাত্র শিক্ষিত হয়ে বের হচ্ছে। তাদের অধিকাংশের সামনে জীবিকা অর্জনের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। এটা বাস্তবতা যে তাদেরকে বাধ্য হয়েই এই হারাম রোজগারের পথে পা বাড়াতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে এটা আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে এবং ব্রিটিশরা এটাই চেয়েছিল। এখন ধর্মব্যবসার উপর বহু লোকের জীবন জীবিকা নির্ভর করছে। কাজেই শিক্ষাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।
সমাজের শিক্ষিত সচেতন শ্রেণিটি বলে থাকেন, মাদ্রাসা শিক্ষার মান অনেক নিম্ন। সেখান থেকে যারা বের হন তারা কূপমণ্ডূক, আধুনিক দুনিয়া সম্পর্কে হাস্যকর রকমের অজ্ঞ। কিন্তু এই অজ্ঞতার ও অযোগ্যতার পেছনে দায়ী যে শিক্ষাব্যবস্থা সেটাকে সচল রেখে এই অভিযোগ করা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত। রাষ্ট্রের শিক্ষানীতিই কি এই অযোগ্য, কূপমণ্ডূক, জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর জনগোষ্ঠীকে তৈরি করছে না?
অথচ এই শিক্ষাব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন কোনো সরকার করতে সাহস করে না। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না যার একটি মাত্র কারণ, ভোট হারানোর শঙ্কা। সরকারে যারা থাকেন তারা মনে করেন, শিক্ষাব্যবস্থায় হাত দিলে তাদের উপর নাস্তিকতা, ধর্মবিদ্বেষের লেবেল লাগিয়ে দিয়ে ধর্মব্যবসায়ীরা জনগণকে প্রভাবিত করে তাদের গদি উল্টিয়ে দিবে। এই ভয়ে তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে সরকারি করার মেয়াদ পার করে দেন। এভাবেই যুগ যুগ ধরে ধর্মব্যবসায়ীর পরিমাণ জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। এই বছর দুই লাখ তো সামনে বছর চার লাখ। এদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য স্বভাবতই নতুন নতুন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। প্রতি বছর বাড়ছে মাদ্রাসার স্বার্থরক্ষায় মিছিলকারী ছাত্র-শিক্ষকদের সংখ্যা। জোরালো হচ্ছে ধর্মব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের হুঙ্কার। মাদ্রাসা শিক্ষা অর্থনীতির বিচারে একটি অনুৎপাদনশীল খাত। এই ধারায় শিক্ষিত মানুষগুলো সমাজের বোঝা হয়ে থাকেন বিধায় আজীবন হীনম্মন্যতায় ভোগেন। এই সুস্থ সবল মানুষগুলো যদি বিদেশে গিয়ে রোজগার করতেন তাহলে দেশেরও উপকার হতো।
আমাদের এই ধর্মব্যবসায়ী তৈরি শিক্ষাব্যবস্থা পরিহার করতে হবে কিন্তু ধর্মের শিক্ষা পরিহার করা চলবে না। বরং সবাইকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রকৃত ইসলামের প্রভাবেই মুসলিম জাতি একদিন জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে পৃথিবীর সকল জাতির শিক্ষকে পরিণত হয়েছিল। তারা কেবল মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা করে বসে থাকেন নি। তাই আমাদেরকে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে যেখানে প্রতিটি ছাত্র যেমন পার্থিব প্রয়োজনের বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে, তেমনি তারা ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সম্পর্কে জানবে। তারা হবে মিথ্যার বিরুদ্ধে, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, প্রতিবাদী সত্যের সৈনিক। তারা স্বার্থপর না হয়ে পরোপকারী হবে, দেশের জন্য, মানুষের জন্য নিজেদের জীবন-সম্পদকে উৎসর্গ করার প্রত্যয় নিয়ে তারা বড় হয়ে উঠবে। তারা নিজেরা বিশৃঙ্খলা করবে না, জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবে না- কাউকে করতেও দেবে না। তখন জাতি একটি মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে। ধর্মব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে ধর্মের আসল রূপের উদ্ভাসন হবে। আগাছাপূর্ণ জমিতে ফসল হয় না।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...